হিরু ও তার দলের আবিষ্কার

হিরু ও তার দলের আবিষ্কার

গল্প মার্চ ২০১৪

দেলোয়ার হোসেন

Hiruপাড়ার কিশোর ছেলেদের মধ্যে হিরু একটু দুরন্ত। চুপচাপ থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। একটা নতুন কিছু না করতে পারলে দিনটাই বুঝি মাটি হয়ে যায় তার। এ-পাড়া সে-পাড়া ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও মাঠঘাট, খাল-বিল এবং বনজঙ্গলে ঘুরতেও হিরুর ভালো লাগে। বয়স তেরো-চৌদ্দর বেশি নয়। পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের দলপতিও সে। দলের সবাই সৎ ও চরিত্রবান। হিরুর মনে একবার যা উদয় হবে, তা সে করেই ছাড়বে। পাড়ার ছেলেরাও হিরুকে খুব পছন্দ করে। ওর সঙ্গে-সাথে হইচই করে ওরাও আনন্দ পায়। দলের ছেলেদের নিয়ে খাল-বিলে ফাঁদ পেতে কানাবগি ধরে হিরু। ডাহুক ধরে। গাছ থেকে পেড়ে আনে পাখির ছানা। দুই দিন যতেœ রেখে আবার উড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া গ্রামের ঝোপঝাড় থেকে শিয়াল, বেজি তাড়া করে বেড়ায় দিনভর। তাই বলে হিরু যে পড়ালেখা করে না, তা কিন্তু নয়। হিরু উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। দুরন্তপনা করে বেড়ালেও সে তার স্কুলের পড়া সময়মতোই করে রাখে। এতো সব ঝামেলা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে তার আর স্কুলেই যাওয়া হয়ে ওঠে না। স্কুলের শিক্ষকরা বলেন, বাঁদরটাকে তো দেখছি না! কেউ বলে, স্যার হিরু বড় বিলে মাছ ধরতে গেছে। কেউ বলে, রজব সাপুড়ের সাপ ধরা দেখতে গেছে। হিরুদের বাড়ির পশ্চিমে আম-কাঁঠালের বাগান। বাগানের এক কোণে বাঁশঝাড়। পাশেই বেশ লম্বা একটা ডোবা। শেওলা আর কলমিলতায় ছেয়ে আছে ডোবার অর্ধেকটা। ডোবার চার ধার কেমন অন্ধকার অন্ধকার মনে হয়। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভূতের ভয়ে ওদিকে কেউ পা বাড়ায় না। ডোবার পাড়েই হিরুদের ফসলের জমি। সেই জমিতে গম বুনেছেন হিরুর বাবা। ওদিকটা নির্জন বলে সকাল-দুপুর ঝাঁক বেঁধে পায়রারা এসে গম খেয়ে যায়। ডোবার পাড়ের গাছ থেকে নেমে আসে ডোরাকাটা কাঠবিড়ালিরা। ওরা মনের আনন্দে নেচে নেচে গম খেয়ে আবার ফিরে যায় গাছের ডালে। হিরুর বাবা একদিন হিরুকে বললেন, সারাদিন টো টো করে বেড়াস, বাগানের পাশে গমের জমিটা একটু পাহারা দিতে পারিস না? পায়রা আর কাঠবিড়ালিরা গম খেয়ে তো শেষ করে দিলো। হিরু বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আর কিছু একটা ভাবলো। তারপরই সে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। মুহূর্তে পাড়া ঘুরে সাথীদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো সেই গমের জমিতে। একটা গাছের আড়ালে থমকে দাঁড়ালো সবাই। সাদা-কালো পায়রারা বাকুম বাকুম করে ঘুরছে আর মনের আনন্দে গমের দানা খচ্ছে। সঙ্গে দু’চারটি কাঠবিড়ালিও রয়েছে। হিরুর মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। দলের ছেলেদের বললো, তোরা বলতো কিভাবে পায়রাগুলা ধরা যায়! মোবারক বলল, জালের ফাঁদ পেতে ধরা যায়। আতিকুল বলল, আমাদের ঘরে ইলিশ ধরা পুরনো জাল আছে। স্বপন বললো, আমাদের বন্দুকটা নিয়ে এলে কেমন হয়? হিরু একটু অস্থির হয়ে বললো, গম খেয়ে তো শেষ করে দিলোÑ এখন কী করা যায়? হিরুর প্রশ্নের উত্তর দিলো না কেউ। হিরু একটু চিন্তা করে সবার উদ্দেশে বললো, তোমরা সবাই একটা করে ঢিল হাতে নাও। আমি ওয়ান, টু, থ্রি বললেই তোমরা পায়রাগুলো লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়বে। যদি দু-একটা পায়রাও আমরা মারতে পারি তাহলে সেই পায়রা দিয়েই আজ আমরা এখানে পিকনিক করবো। ছেলেরা পিকনিক করার কথা শুনে আনন্দে যে যার মতো কুড়িয়ে আনলো শক্ত মাটির ঢেলা, কেউবা ইটের টুকরা। হিরু ওয়ান, টু, থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে ঢিল ছুড়লো সবাই। ফর ফর শব্দে পাখা ঝাপটে উড়ে গেলো পায়রারা। একটা কেউ ঘায়েল করতে পারলো না ছেলেরা। ব্যর্থতায় সবার মন কেমন মলিন হয়ে গেলো। তার চেয়েও বড় কথা যে পিকনিক করা আর হলো না তাদের। হঠাৎ হিরু লক্ষ করলো তিন-চারটি কাঠবিড়ালি তখনো লেজ উঁচিয়ে গমের দানাগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দেখেই হিরু ছুটলো কাঠবিড়ালি ধরতে। কাছাকাছি যেতে না যেতেই কাঠবিড়ালিরা কিট কিট শব্দ করে লেজ তুলে তিন লাফে চলে গেলো গাছের চালে। শুরু হলো মজার খেলা। হিরুও ছাড়বার পাত্র নয়। সেও ডোবার পাশে হিজল গাছটায় উঠে গেলো। কাঠবিড়ালি হিরুকে দেখেই চলে গেলো মগডালে। হিরুও খুব সাবধানে একটা ডালে বসে অন্য একটি ডাল ঝাঁকাতে শুরু করলো। যে ডালে কাঠবিড়ালিটা চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ মড়মড় শব্দে চাল ভেঙে হিরু পড়লো ডোবার পানিতে। কাঠবিড়ালি এক লাফে অন্য ডালে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে হিরুর দিকে। হিরু পানিতে পড়েও এতোটুকু ঘাবড়ে না গিয়ে তখনই মনে মনে নতুন প্লান করে ফেললো। হা হা করে হাসতে হাসতে সাথীদের বললো, তোমরা সবাই পানিতে নেমে এসো। এই ডোবায় অনেক মাছ আছে। আমরা সবাই মাছ ধরবো। আর সেই মাছ দিয়েই আজ পিকনিক করবো। ছেলেরা নতুন করে পিকনিকের কথা শুনে আনন্দে সবাই লাফিয়ে পড়লো ডোবার পানিতে। পুরনো ডোবার তলায় পচা লতাপাতার মধ্য হাত দিতেই বড় বড় লাল কৈ, বড় বড় টাকি আর রয়না মাছ পেতে লাগলো সবাই। আনন্দে ছেলেরা তখন বেসামাল। দীপা নামের একটি মেয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা ড্যাগ নিয়ে এলো। আর ডাঙায় ছুড়ে দেয়া মাছগুলো কুড়িয়ে রাখতে লাগলো ড্যাগের মধ্যে। দেখতে দেখতে ওরা অনেক মাছ ধরে ফেললো। এর মধ্যে দু-একজন ডোবা থেকে উঠে এসেছে। মোবারকও উঠে আসবে কিন্তু পায়ের তলায় ও অন্য রকম কিছুর স্পর্শ অনুভব করলো। মনের মধ্যে কৌতূহল নিয়ে মোবারক ডুব দিলো সেখানে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো কয়েকটা বস্তা। বস্তার মধ্যে আঁকাবাঁকা শক্ত কিছু রয়েছে। ও ভেসে উঠেই হিরুকে ডাকলো। হিরু ভাইয়া এখানে এসে দেখো অনেক বস্তা। বস্তার মধ্যে কী যেন বাঁধা রয়েছে। মোবারকের কথা শুনে সবাই কেমন হাঁ হয়ে গেলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো কৌতূহল। তাহলে কি বস্তার মধ্যে কোনো গুপ্তধন! না কি কোনো বিপদের আলামত! হিরুর পানি খলবলিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো মোবারকের কাছে। তারপর দু’জনই এক সঙ্গে ডুব দিয়ে তুলে আনলো একটি বস্তা। সবার দৃষ্টি তখন ঐ বস্তার দিকে। হিরু মনের এলোমেলো ভাবনা ঝেড়ে ফেলে চটের বস্তাটা একটু ফাঁকা করে দেখলো ওর মধ্যে কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি বদনা-ঘটি। ওর আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে, এ সবই চুরির মালপত্র। ধরা পড়ার ভয়ে চোরেরাই লুকিয়ে রেখেছে এখানে। ওরা হযতো ভেবেছে এই ভুতুড়ে ডোবায় কেউ নামবে না আর এই জিনিসের খোঁজও কেউ পাবে না। অনেক ভেবেচিন্তে বস্তাটা আবার সেখানেই ছেড়ে দিলো হিরু। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হিরু ওর বাবাকে খবর পাঠালো। বাবা এসে সব ঘটনা শুনে তিনি তখনই হোন্ডা নিয়ে চলে গেলেন থানায়। এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ দারোগা এসে হাজির। তার পূর্বেই দীপা হিরুদের দলে যোগ দিয়ে মাছ কেটে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। অন্যরাও হাঁড়ি এবং চালডাল নুন, ঝাল এনে জমা করে রেখেছে। দারোগা পুলিশের কথা শুনে গাঁয়ের মানুষও এসে জড়ো হলো সেখানে। দারোগা এসেই হিরু ও তার দলের ছেলেদের কাছে নানান ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সব কিছু জানার পর থানা থেকে নিয়ে আসা দু’জন লোককে ডোবার পানিতে নামতে হুকুম করলেন। লোক দু’জন সারা ডোবায় ডুব সাঁতারে পানি ঘোলা করে তুলে আনলো তিনটি বস্তা। সব বস্তার মধ্যেই কাঁসা-পিতল। দারোগা সাহেব উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন, আপনারা অনেকেই হয়তো শুনেছেন গত পরশু কৃষ্ণনগর রায় বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা বাড়ির লোকদের বেঁধে রেখে ইচ্ছেমতো লুটপাট করে পালিয়ে গেছে। এই কাঁসা -পিতল সবই রায়বাড়ির লুট হওয়া জিনসপত্র। তারপর দারোগা সাহেব হিরুকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, তুমি যদি কাঠবিড়ালি ধরতে গিয়ে ডোবার পানিতে পড়ে না যেতে আর ডোবায় পড়ে গিয়ে মাছ ধরে বনভোজনের কথা না বলতে তা হলে তুমি ও তোমার দল এতো বড় একটা আবিষ্কারের সুনাম অর্জন করতে পারতে না। তোমাদের মনে কোনো পাপ নেই তাই ডাকাতি হওয়া এসব মালপত্র আমরা উদ্ধার করতে পারলাম। আশা করছি ডাকাতদেরকেও ধরতে পারবো। তোমাদের সকলকেই আমি অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি তোমরা বড় হয়ে এমনি করেই দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাবে। হিরু তখন কী বলবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। সে হঠাৎ বলে উঠলো, স্যার আমাদের বনভোজনে আপনারাও থাকেন না। বড় বড় সিঁদুরে কৈ মাছ আছে। হিরুর কথা শুনে দারোগা সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, জীবনে কৈ মাছ দিয়ে কখনো বনভোজন করিনি। তোমাদের সাথে থাকতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু আমাদের হাতে যে একদম সময় নেই। তোমরা আনন্দ করো তাতেই আমি খুশি হবো। দারোগা সাহেব দলবল নিয়ে চলে গেলেন। সাথে সাথে প্রাণখোলা আনন্দে হই হই করে উঠলো হিরু ও তার দলের ছেলেমেয়েরা। তখন মাথার ওপর থেকে একটু হেলে পড়েছে সূর্য। গাছের ছায়ায় মাটির হাঁড়িতে উপছে পড়ছে ভাতের ফ্যান। কেউবা গরম তেলে ভাজছে সিঁদুরে কৈ। সেই আনন্দে বাতাসও যেন ডিগবাজি খেতে খেতে ছুটে চলেছে দূর থেকে আরো দূরে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ