হাজী শরীয়তুল্লাহ বিশ্বাসী চেতনার প্রতিকৃতি

হাজী শরীয়তুল্লাহ বিশ্বাসী চেতনার প্রতিকৃতি

স্মরণ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ জুলাই ২০২৩

হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি। আমরা সবাই তার নাম জানি। জন্মের পরে তিনিও আমাদের সম্পর্কে জেনেছেন। আমাদের সম্পর্কে মানে সমকালের ইতিহাস সম্পর্কে। দেখেছেন চালচিত্র। অবাক হয়েছেন। কষ্ট পেয়েছেন। নীরবে কেঁদেছেন। আলোর পথ খুঁজেছেন। আলোর দিকে ডেকেছেন। ঘর ছেড়েছেন। দেশ ছেড়েছেন। জ্ঞানের জন্য ছুটেছেন। নিজেকে গড়ার জন্য ঘুরেছেন। অবশেষে জাতিকে র্শিক, বিদআত এবং পরাধীনতা থেকে বাঁচানোর সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাইতো তিনি স্মরণীয়। তিনি বরণীয়। তিনি অনুকরণীয়। অনুসরণীয়। 

ময়লা হলেই পরিষ্কার করার দরকার হয়। ভেঙে গেলে কিংবা জরাজীর্ণ হলেই সংস্কার প্রয়োজন। ব্রিটিশের প্রভাবে বাংলার মুসলিম সমাজ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। তাইতো সংস্কার দরকার। এই সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি উৎসাহ পেয়েছেন আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব থেকে। অনুপ্রাণিত হয়েছেন ভারতীয় উপমহাদেশের শাহ ওয়ালীউল্লাহ এবং সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর ধর্মচিন্তা থেকে। তিনি মুসলমানদের ইসলাম নির্ধারিত ফরজসমূহ পালনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন। এ কারণেই তাঁর আন্দোলনের নাম ফরায়েজি আন্দোলন। শুধুমাত্র বাংলা নয়, বরং সর্বভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তিনি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম ১৭৮১ সালে। মাদরীপুরের শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুরের নিকটস্থ শ্যামাইল গ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতা আবদুল জলিল মারা যান। এসময় তাঁর চাচার কাছে থাকেন চার বছর। শরীয়তুল্লাহ ছিলেন খুবই মেধাবী। অতি ছোটো বয়সেই স্থানীয় শিক্ষকদের কাছে পাঠ শেষ করে ফেলেন। 

শরীয়তুল্লাহর স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো মানুষ হবার। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে মৌলভী বাসারত আলীর কাছে আশ্রয় লাভ করেন। তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। সেখানেই লেখাপড়া করতে থাকেন শরীয়তুল্লাহ। তাঁকে আরো বড়ো হতে হবে। তাই আরবি-ফারসিতে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি হুগলীর ফুরফুরায় যান। সেখানে তিনি কিছুদিন ভালোভাবে লেখাপড়া শেখেন। এরপরে চলে যান মুর্শিদাবাদে। সেখানে তাঁর অপর এক চাচা আশিক মিয়া থাকতেন। মুর্শিদাবাদে আরও এক বছর ভালোভাবে আরবি-ফারসি শিক্ষা করেন তিনি। তারপর চাচা আশিক মিয়ার সাথে মাদারীপুর নিজ গ্রামে রওনা হন। যাত্রাপথে ঝড়ের কবলে পড়েন সবাই। নৌকাডুবে তাঁর চাচার পরিবারের লোকজন মারা যান। শরীয়তুল্লাহ কোনো রকমে বেঁচে যান। মনভাঙা হয়ে তিনি মাদারীপুর না গিয়ে পুনরায় কলকাতা ফিরে আসেন। 

নতুন জীবন শুরু হলো শরীয়তুল্লাহর। মৌলভী বাসারত আলীর সাথে তিনি ১৭৯৯ সালে মক্কায় রওয়ানা হন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি আরবি, ফারসি এবং ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘকাল আরবে অবস্থান করে হজ্বব্রত পালন শেষে ১৮১৮ সালে বাংলায় ফিরে আসেন। 

বাংলার মুসলমানদের অবস্থা তখন খুব খারাপ। তিলে তিলে মুসলমানদেরেকে ধ্বংস করেছে ইংরেজরা। টাকা নেই, সম্পদ নেই। লেখাপড়াও নেই। সংস্কৃতিও বদলে দিয়েছে।

মুসলমানদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের বিত্তশালী বানিয়েছে। হিন্দুরা এখন জমিদার। সম্পদশালী। তারাও ক্ষমতার দাপট দেখাতো। কথায় কথায় মুসলমানদের ওপর ট্যাক্স বসাতো। মুসলিম নাম রাখলে ট্যাক্স। দাড়ি রাখলে ট্যাক্স। সূর্যাস্ত আইন, ওয়াকফ সম্পত্তি দখল। কখনও পাঁচশালা, কখনও দশশালা কখনো বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ সব করে মুসলমানদেরকে নিঃস্ব বানিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে মুসলমানেরা সমাজের গরিব মানুষে পরিণত হয়।

লেখাপড়া না থাকলে মানুষ অন্ধের মতো হয়ে যায়। যে যা বলে সেটাই সত্য মনে হয়। তাইতো সমাজে শিরক, বিদআত ছড়িয়ে পড়লো। অশিক্ষিত মুসলমানেরা পীরের নামে মানত করতো। কবরে সিজদা দিতো। নামাজ-কালামের বালাই নেই। আজান দেওয়া নিষেধ। গরু কুরবানি নিষেধ। গরুর গোশত খাওয়া নিষেধ। হিন্দুদের পূজায় অংশ নিতে হতো। পুজোয় চাঁদা দিতে বাধ্য করতো। বিয়ে শাদিতে হিন্দুদের রীতিনীতি পালন করতে হতো। না মানলে জরিমানা গুনতে হতো। 

বাংলার মুসলমানদের এ অবস্থা দেখে হাজী শরীয়তুল্লাহ খুব কষ্ট পেলেন। তিনি ভাবলেন মুসলমানদেরকে সচেতন করতে হবে। তাদের লেখাপড়া শিখাতে হবে। ইসলামী শরিয়তের জ্ঞান দিতে হবে। তিনি হিন্দুদের পূজা-পার্বণে চাঁদা দেওয়াকে হারাম ঘোষণা করলেন। এমনকি পুজো দেখতে যেতেও নিষেধ করলেন। তিনি মুসলমানদের ধুতি ছেড়ে ইসলামী লেবাস পরতে বললেন। সবাইকে তওবা করতে বললেন। নতুনভাবে ইসলামী জীবনযাপন করতে অনুরোধ করলেন। সকল প্রকার শিরক ও বিদআত থেকে দূরে সরে যেতে বললেন। তিনি মুহররমের তাজিয়া উৎসব নাজায়েজ ঘোষণা করলেন। করব পূজা, পীর পূজা, মানুষকে সেজদা দেওয়াকে তিনি শিরক হিসেবে ঘোষণা দিলেন। মুহররমে মাতম করা, গাজী-কালু, খাজা খিজির বা পঞ্চপীরের গুণ গাওয়া এগুলোকে বললেন বিদআত। তাঁর শিষ্যদের তিনি পীর শব্দের বদলে উস্তাদ ও মুরিদ শব্দের বদলে সাগরেদ ব্যবহারের নির্দেশ দেন। উস্তাদ মানে শিক্ষক আর সাগরেদ মানে ছাত্র। মসজিদগুলো সংস্কার করার উদ্যোগ নিলেন। আজান এবং নামাজ চালু করলেন। সবাইকে তাওহিদের শিক্ষা দিতে থাকলেন। 

হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের মাঝে সংস্কার চেতনা জাগিয়ে তুলতে শুরু করেন। অবহেলিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ তাঁর এই আন্দোলনে শরিক হন। তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁর নির্দেশ ও পরামর্শ মতো জীবনযাপন শুরু করেন। তাঁর এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় অবহেলিত সাধারণ কৃষক শ্রেণি। তিনি প্রচার করেন যে, হালাল রুজি মুসলমানদের ইবাদতের পূর্বশর্ত। যারা জুলুম অত্যাচার করে জীবিকা নির্বাহ করে আল্লাহ তাদের ইবাদত কবুল করেন না।

হাজী শরীয়তুল্লাহ সমাজ থেকে বৈষম্য, হিংসা ও বিদ্বেষ সরিয়ে ফেলতে কাজ করেন। তিনি মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সুদৃঢ় একতা গড়ে তোলেন। তিনি প্রচার করেন যে, মানুষের জন্ম হয়েছে একই আদমের সন্তান হিসেবে। সুতরাং মানুষ মূলত পরস্পর ভাই ভাই। যে কোনো ভাইয়ের বিপদে অপর ভাইয়ের সাহায্য করা একান্তই কর্তব্য।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে কালো আইন চাপিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে ভূমিকর ছাড়াও নানা প্রকার কর চাপিয়ে দেয় কৃষকদের ওপর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণির পত্তনিদারের উদ্ভব হয়েছিল। জমিদারগণ পত্তনিদারদেরকে জমির মধ্যস্বত্ব ও কর আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করতো। তারাও অত্যাচার করতো কৃষকদের ওপর। হাজী শরীয়তুল্লাহ এ বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। এ সবের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, যারা ফসল ফলাবে তারাই ভোগ করবে। চাষিরাই জমির প্রকৃত মালিক। জমির ফসল চাষিদেরই প্রাপ্য। তাতে জমিদারের কোনো অধিকার নেই। শরীয়তুল্লাহ জমিদার-জোতদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কৃষকদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভূমিকর দিতে বলেন। তার অতিরিক্ত সকল প্রকার ট্যাক্স দিতে নিষেধ করেন। সংস্কার আন্দোলনে প্রায় বারো হাজার কৃষক তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হয়। 

ব্যক্তি জীবন সুন্দর হলে পরিবার সুন্দর হয়। ভালো পরিবার গঠিত হলে সমাজও সুন্দর হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে ইসলামী আদর্শের আলোকে গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করেন। সবাইকে সব ধরনের অনৈসলমিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন। পূজা-পার্বণের চাঁদাসহ ও বাড়তি ট্যাক্স দিতে নিষেধ করেন। তার অনুসারীরা সকল প্রকার ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে। ইসলামের সঠিক পদ্ধতি মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তারা নিয়মিত নামাজ আদায় ও রোজা পালন করে। ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি টুপি পরিধান করা শুরু করে।

হাজী শরীয়তুল্লাহর এ সংস্কার আন্দোলন সকলেই মেনে নেয়নি। হিন্দুরা তো বিরোধিতা করেছেই। খোদ মুসলমানদের অনেকেই বিরোধী হয়ে ওঠে। হিন্দু জমিদারদের সহায়তায় তারাও আন্দোলনের বিরোধিতা শুরু করে। শরীয়তুল্লাহর অনুসারীদের ওপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে রামনগর গ্রামে তার অনুসারীদের সাথে বিরোধী পক্ষের বিবাদ বাধে। অবশেষে তা দাঙ্গা-হাঙ্গামার রূপ নেয়। জমিদারগণ সরকারের সাহায্য নিয়ে মুসলমানদেরকে রামনগরের পার্শ্ববর্তী প্রধান প্রচার কেন্দ্র নয়াবাড়ি থেকে বহিষ্কার করে।

নয়াবাড়ি থেকে বহিষ্কারের পর হাজী শরীয়তুল্লাহ সতর্কতা অবলম্বন করেন। তাঁর সংস্কার আন্দোলনের প্রচারকেন্দ্র মাদারীপুরের অন্তর্গত বাহাদুরপুর গ্রামে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে থেকে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেন। সেখানকার মুসলমানদের মধ্যেও বিপুল সাড়া জাগে। গ্রামে গঞ্জে তাঁর অনেক অনুসারী তৈরি হয়। এমন সময়ে ১৮৪০ সালে ৫৯ বৎসর বয়সে তিনি নিজ গ্রামে ইন্তেকাল করেন। 

সত্যিকার অর্থে হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন বাংলার যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। বিশ্বাসী চেতনার প্রতিকৃতি। তাঁর ইন্তেকালে আন্দোলন থেমে যায়নি। তাঁর পুত্র মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে বাংলার বিভিন্ন জনপদে সংস্কার আন্দোলনের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ