সৌরঝড়ের পূর্বাভাস

সৌরঝড়ের পূর্বাভাস

বিজ্ঞান এপ্রিল ২০১৩

সাকিব রায়হান সৌরঝড়ের কারণে শারীরিক ক্ষতি হয় বিমানচালক, কর্মী এবং যাত্রীদেরও। একই কারণে মহাকাশে অবস্থিত কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর ক্ষতি হয়। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যেই বাধা সৃষ্টি করে এই তেজস্ক্রিয়া। এই তেজস্ক্রিয়ার পেছনে সৌরঝড় কাজ করছে। সর্বপ্রথম সৌরঝড় পর্যবেক্ষণ করা হয় ১ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ সালে এবং সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে সম্প্রতি অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর ২০১২ সালে। কী এই সৌরঝড় বিজ্ঞানীদের মতে, সূর্যের ভেতরে পরমাণু বিক্রিয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণে তড়িৎগ্রস্ত কণা (মূলত ইলেকট্রন) বেরিয়ে আসে। সেই কণাগুলো পৃথিবীর মেরু অঞ্চল দিয়ে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে প্রবেশ করে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। একেই বলা হয় সৌরঝড়। সৌরঝড় মহাকাশের এক আকস্মিক ঘটনা। যার ফলে এর যথাযথ পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন গবেষকরা। শুধু মহাকাশই নয়, সেই কণার স্রোত প্রভাবিত করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকেও। বিজ্ঞানীরা জানান, পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে ভূচৌম্বক শক্তি কাজ করে। আর সে কারণেই ওই তড়িৎগ্রস্ত কণার স্রোত পৃথিবীর মেরু অঞ্চল দিয়ে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তড়িৎগ্রস্ত কণার স্রোত বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের ফলে ওই এলাকার আকাশে রঙ-বেরঙের খেলা (অরোরা) দেখা যায়। সৌরঝড়ের প্রভাব সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়া তড়িৎগ্রস্ত কণার স্রোতের মুখে পড়ে মাঝেমধ্যেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন যায় মেরু অঞ্চল দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ওই তড়িৎগ্রস্ত কণা ঢুকে পড়ার ফলেই মেরু এলাকায় বিমান চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। কখনও বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় মহাকাশে ভেসে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহও। তড়িৎগ্রস্ত কণার প্রভাবে সেগুলোর আয়ুও কমে যেতে পারে বলে গবেষকরা দাবি করেছেন। এক বিমানচালক জানিয়েছেন, মেরু অঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত সৌর বিকিরণ হলে বিমানের সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়। স্বল্প পরিমাণের বিকিরণে বিমান চলতে পারলেও বিমানে থাকা মানুষজনের শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর নিয়ম অনুযায়ী একজন বিমানচালক মাসে একবারের বেশি মেরু অঞ্চল দিয়ে যেতে পারেন না। বিমানচালকরা জানিয়েছেন, সাধারণত আমেরিকার একটি আবহাওয়া সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে মেরু অঞ্চলের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও অনেক সময় হঠাৎ সৌরঝড়ের মুখে পড়তে হয় তাদের। নাসার সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫৭০০ কেলভিন এবং বাইরের অংশের (করোনা) তাপমাত্রা প্রায় ১০ লাখ কেলভিন। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, সূর্য নিয়ে গবেষণায় নাসার নতুন আবিষ্কারের ফলে সৌরঝড়ের সমস্যা এবার সমাধান হতে চলেছে। সম্প্রতি নাসার টেলিস্কোপে সূর্যের বাইরের অংশে এক বিরাট চৌম্বকক্ষেত্রের ছবি ধরা পড়েছে। এ ছবি থেকে সৌরঝড়ের নানা অনাবিষ্কৃত রহস্য জানা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হেলিওফিজিক্স (সৌর পদার্থবিদ্যা) বিভাগের বিজ্ঞানী মধুলিকা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেছেন, ‘এই আবিষ্কার সূর্য সংক্রান্ত গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শুধু তাই নয়, সৌরঝড়ের অজানা তথ্য মহাকাশের আবহাওয়া সংক্রান্ত পূর্বাভাসেও সাহায্য করবে।’ সৌরঝড় নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানীদের দাবি, নাসার সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে মহাকাশে সৌরঝড় সংক্রান্ত নানা গবেষণা ও পূর্বাভাস জানা বা তুলনা করা সহজ হবে। সৌরঝড়ের অগ্রিম সতর্ক সংকেত পেলে মেরু অঞ্চলে বিমান চলাচল এবং কৃত্রিম উপগ্রহের রক্ষণাবেক্ষণেও সাহায্য করা যাবে বলে তাদের অভিমত। সূর্যের বাইরের অংশ (করোনা) ও সৌরঝড় নিয়ে অনেকদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে ভারত। সৌরঝড়ের গতিবিধির ওপরে নজরদারি চালাতেই তারা নতুন একটি কেন্দ্র গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু সৌরঝড়ই নয়, মহাকাশে আবহাওয়া সম্পর্কিত অন্য বিষয়গুলোও নজরে রাখবেন তারা। এই সৌরঝড় নিয়ে গবেষণার জন্য দেশের প্রথম গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হতে চলেছে কল্যাণীর মোহনপুরে। কেন্দ্রীয় সরকারি গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইআইএসইআর) ক্যাম্পাসে এটি গড়ে তোলা হবে। আর এজন্য চার কোটি টাকা মঞ্জুরও করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। গবেষকরা বলেছেন, বর্তমানে মহাকাশবিজ্ঞান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৌরঝড়ের দাপটে সেগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই ব্যাপারে সতর্কতা নিতেই এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি, বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে সমস্যা দূর করতেও উদ্যোগী হবেন তারা। কল্যাণীর ওই গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে বিমান চলাচল এবং টেলিকম মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ থাকবে। আইআইএসইআর-এর এক গবেষক জানিয়েছেন, মহাকাশে এ ধরনের কোনো ঘটনা আঁচ করলে সঙ্গে সঙ্গেই তা বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেওয়া হবে, যাতে অগ্রিম সতর্কতা নেওয়া যায়। জানানো হবে টেলিকম মন্ত্রণালয়েও। এর ফলে তারা মহাকাশে বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন। আগামী ২০১৬ সালে সূর্যের বাইরের অংশ বা করোনার ওপর নজরদারি চালাতে ‘আদিত্য’ নামে একটি মহাকাশযান পাঠানোর পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকল্পটিতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে এই কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরাই থাকবেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ