সৌম্যর পড়ার সাথী -তমসুর হোসেন
গল্প জুলাই ২০১৮
সন্ধ্যায় সৌম্য পড়তে বসে। ছবি আঁকা, অঙ্ক কষা আর ইংরেজি পড়া তার কাজ। অঙ্ক এবং ছবির কাজ শেষ করেছে সে। ইংরেজি তার কাছে কঠিন মনে হয়। তবু সে মনোযোগ দিয়ে তা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে। ‘টু লিটল ব্ল্যাকবার্ড সিটিং অন এ ওয়াল, ওয়ান নেমড্ পিটার ওয়ান নেমড্ পল।’ পড়াটা হতে চাচ্ছে না। মুখস্থ না হলে সারের কানমলা খেতে হবে। কানমলা খেলে সারা দিন আনন্দ লাগে না। মা এসে আলো জ্বালিয়ে গেল। তখন সে বইয়ে এত ব্যস্ত থাকল যাতে মনে হয় পড়ায় নিমগ্ন আছে। মা শাসিয়ে গেল, ‘অন্য দিকে খেয়াল দিবি না। পড়া মুখস্থ হওয়া চাই। এক পড়া তিন দিন পড়ছ।’ মায়ের কথা না শুনে সৌম্য আরও জোরে জোরে পড়তে লাগল। একটা ঝিঁঝিঁ প্রতিদিন ঝামেলা করে। ওর চেয়ে বেশি চিৎকার করে ঝিঁঝিঁটা। সৌম্য বিরক্ত হলো। এমন হলে পড়া হবে কী করে। সে ঘর থেকে বের হয়ে ঝিঁঝিঁটাকে বলতে লাগল: ‘চুপ কর। অনেক হয়েছে। দয়া করে চুপ কর এবার।’ ‘তোমার সমস্যা কী? তুমি যে চিল্লাচ্ছ?’ ‘আমি চিল্লাচ্ছি! কে বলেছে? আমি তো পড়ছি।’ ‘কী পড়াটা যে হচ্ছে!’ ‘পড়া হচ্ছে না মানে। কি বলতে চাও তুমি?’ ‘এক পড়া প্রতিদিন পড়লে ভালো লাগে?’ ‘এক পড়া পড়ছি? বলত কী পড়েছি আমি?’ ‘ঝিটিঙ ঝিটিঙ ব্ল্যাক বার্ড। এই পড়া পড়নি?’ ‘এই শুনেছ? স্যার তোমার চামড়া রাখবে না।’ ‘তোমার স্যার বাজে লোক। ফাঁকি মেরে টাকা নিয়ে যায়। আমার কোন মাস্টার নেই।’ ‘তুমি কার কাছে শেখ।’ ‘নিজে নিজে শিখি।’ ‘তোমার পড়া ভুল। আমার স্যার ছবিও এঁকে দেয়।’ মা সৌম্যকে ডাকতে থাকে। নুডল্স নিয়ে এসেছে মা। নুডল্স খেয়ে পড়তে হবে। মা পড়া আদায় করে নেবে। এটা প্রতিদিনের রুটিন। মা ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। জানালার ওধারে গোলাপ গাছের পাশে সৌম্য কথা বলছে। মা রেগে বলে: ‘অন্ধকারে কী করছ তুমি? ‘কলম খুঁজছি।’ ‘ওখানে কলম গেল কী করে?’ ‘পড়ে গেছে।’ টর্চ নিয়ে মা কলম খুঁজতে লাগল। কলম পাওয়া গেল না। মা ঘরে এসে কলমদানি পরীক্ষা করল। সব ঠিক আছে। কলম থাকার পরও সে লাল কলম নিয়েছে। কলমদানিতে দুটো কলমই আছে। তাহলে হারাল কোনটা। রেগে মেগে লাল হয়ে মা বলতে লাগল: ‘কলম হারানোর গান ধরেছিস?’ ‘পড়ে গেল জানালা দিয়ে।’ ‘তোমাকে নিয়ে আর পারছি না।’ ‘আজ পড়ব না। ঘুম পাচ্ছে। সকালে পড়ব।’ ‘সে কথা বললেই হতো। কলম হারানোর নাটক করছ কেন?’ ‘আমি বুঝি নাটক জানি। কিছু পড়ে গেছে। কাল দেখে নিও।’ সৌম্য জাগার আগে মা অনেক খোঁজাখুজি করল। কিন্তু কিছুই পেল না। মা ভাবল, কী খোঁজার জন্য সৌম্য বাইরে গেছে।’ সে তো ভয়কাতুরে। একা বাইরে যায় না। বিষয়টি নিয়ে ভাবল মা। কিন্তু সৌম্যকে কিছুই বলল না। সন্ধ্যায় সৌম্য পড়তে বসল। গত রাতের পড়াটা মুখস্থ হয়নি। কেন যে পড়াটা মুখস্থ হচ্ছে না ভেবে পায় না সৌম্য। সকালে স্যার কান মলেনি সত্য, কিন্তু এমন শাসিয়েছে যাতে ওর পিলে কাঁপছে। জানালার দিকে মুখ করে সে মন লাগিয়ে পড়তে লাগল। আজ আর ঝিঁঝিঁটা সমতালে শব্দ করল না। শুধু ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁটিঙ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁটিঙ বলে চুপ হয়ে গেল। ও থেমে গেল কেন? বেশ তো তাল মিলিয়ে পড়ছিল। শব্দহীন অস্বস্তির চেয়ে ওর ঐক্যতান খারাপ নয়। চুপি চুপি বলল সৌম্য। ‘কি ব্যাপার, আজ পড়ছ না যে?’ ‘আজ আমি পড়ব না।’ ‘কেন পড়বে না?’ ‘আমার শরীর খারাপ। খুব জ্বর এসেছে।’ ‘ঔষধ খাওনি?’ ‘ঔষধ! আমাদের তো ঔষধ খেতে নেই।’ ‘কি বলছ? অসুখ করেছে ঔষধ খেতে হবে না?’ ‘ঔষধ খেলে বাঁচতে হবে না।’ মা সৌম্যকে খুঁজল। টেবিলে খোলা বই। সৌম্য ঘরে নেই। পড়া ছেড়ে কোথায় যায় ছেলেটা। এবার মা ওকে ডাকল না। চুপি চুপি জানালার ওপাশে গেল। ওর কান্ড দেখে অবাক হলো মা। ভয়কাতুরে ছেলে অন্ধকারে বসে কার সাথে কথা বলছে? ‘ঔষধ খেলে সবাই বাঁচে। আর তুমি বলছ বাঁচবে না।’ ‘পোকা মারতে কি ব্যবহার করা হয়। তুমি বলো?’ ‘কেন, পোকা মারার ঔষধ।’ ‘তাহলে, সে ঔষধ আমি খাবো?’ কার সাথে কথা বলছে সৌম্য। আশপাশে তো কেউ নেই। পোকা মারার ঔষধ ও কি করবে। ছেলেটা বাজে হয়ে গেছে। ‘কার সাথে কথা বলছ সৌম্য?’ আচমকা প্রশ্ন করে মা। বেশ সমস্যা হয়ে গেল। মাকে কী বলবে সে। সে পোকার সাথে কথা বলছে জানতে পারলে মা অলক্ষুণে কান্ড শুরু করবে। থতমত খেয়ে সৌম্য বলল, ‘হিশু করতে এসেছি আম্মু। সবুজ ভাইয়া ফুলের গাছে ঔষধ ছিটাতে বলেছে।’ ‘তোমার কয়টা ফুলের বাগান?’ ‘ফুলের বাগান লাগালে ঔষধ ছিটাব।’ হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে সৌম্যকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দেয় মা। দাঁত কটমট করে বলে, ‘কালকের পড়াটা হয়েছে?’ ‘ওটা পড়া আমি পড়ব না।’ ‘কেন পড়বে না?’ ‘অন্য পড়া দাও। এটা পড়া আমার পড়তে ভালো লাগে না।’ ‘এ কথা শুনলে স্যার কি বলবে? কান টেনে ছিঁড়বে।’ ‘কান ছিঁড়লে হলো? ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। তুমি বলছ কান ছিঁড়বে?’ সৌম্য বেশ বাজে হয়ে গেছে। মা ওকে নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে লাগল। পড়া ছেড়ে অন্ধকারে ফুলের গাছের কাছে ও কি করতে যায়। পুটপুট করে কার সাথে কথা বলে। পোকা, ঔষধ এসব কথা ওর মুখে এল কি করে। পরের দিন সৌম্যকে পড়তে দিয়ে মা দরজার পাশে ঘাপটি মেরে থাকল। সৌম্য পড়তে লাগল, ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার, হাউ আই ওনডার হোয়াট ইউ আর।’ সৌম্যর সাথে তাল মিলিয়ে পোকাটা জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘ঝিটিঙ ঝিটিঙ লিটল স্টার হাউ আই ঝিটিঙ হোয়াট ইউ আর।’ পোকার পড়া শুনে সৌম্য রেগে গেল। ওর পড়া গোলমাল করে দিচ্ছে পাজি পোকা। টুইংকল টুইংকল না বলে ও বলছে ঝিটিঙ ঝিটিঙ। আর ওনডারের স্থানে ও বলছে ঝিটিঙ। সৌম্য বাইরের দরজা খুলে বের হয়ে বলতে লাগল, ‘এসব কি পড়া হচ্ছে?’ ‘কেন, ঠিকই তো পড়ছি।’ ‘ঠিকই পড়ছ? তাহলে টুইংকল না বলে ঝিটিঙ বলছ কেন?’ ‘সেটা আমার খুশি।’ ‘বাজে অভ্যেস বাদ দাও। ভাল করে পড়ার চেষ্টা কর।’ ‘আমি এর চেয়ে ভালো পড়তে পারব না।’ ‘কেন পারবে না?’ ‘পোকারা এর চেয়ে ভাল পড়তে পারে না।’ সৌম্যের সব কথা শোনে মা। তাহলে সৌম্য পোকার সাথে কথা বলে। সব কথা মাকে বলে সৌম্য। কিন্তু এ বিষয়টা গোপন করছে কেন। সৌম্যকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মা। ‘তোমার পড়ার সাথী দরকার। তাই না সৌম্য?’ ‘সাথী হলে ভালো হয়। একা বিরক্ত লাগে।’ ‘রিপনকে ডেকে নাও। দু’জনে পড়বে।’ ‘ওকে আসতে দিলে তো।’ ‘তাহলে কার সাথে পড়বে?’ ‘থাক। ও সবের দরকার হবে না।’ ‘সাথী তোমার আছে।’ ‘সাথী আছে মানে! কি বলছ তুমি?’ ‘বাগানে গিয়ে যার সাথে কথা বললে।’ সৌম্যর আর কোনো পড়ার সাথীর দরকার পড়ে না। সন্ধ্যা হলে ঝিঁঝিঁটা মিষ্টি শব্দে পড়া তৈরিতে সহযোগিতা করে। স্কুলে যখন সে বিমর্ষ মনে বসে থাকে তখন গাছের ডালে বসে পাতায় দোলা দিয়ে সে গান শোনায়। রাতে যখন সৌম্যের চোখে ঘুম আসে না তখন নারকেলের চিকন পাতায় চাঁদের জোছনা ঢেলে সে অনেক দূরের সুর এনে চোখের পাতায় ছড়িয়ে দেয়। তখন সে ঘুমের নদীতে সাঁতার কেটে দূরের অচেনা দ্বীপে হারিয়ে যায়।
আরও পড়ুন...