স্মৃতিখেকো  -নাবিউল হাসান

স্মৃতিখেকো -নাবিউল হাসান

গল্প মে ২০১৭

কক করে শব্দটা করার পর বাচ্চাগুলো এক নিমিষে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়লো মুরগিটার।
কেরোসিনের কুপিটা নিভানোর ৩০ সেকেন্ডও সময় গড়ায়নি। রাত ১০টা বেজে ৩৫ মিনিট পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর কেবলমাত্র শুয়েছি। বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার, গ্রামের লোকজন রাত অল্প হতেই ঘুমিয়ে যায় চুপচাপ। শুধুমাত্র ছাত্ররাই একটু দেরি করে ঘুমায়, তাও শহরের তুলনায় অনেক আগেই শেষ করে তারা। বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার হয়ে যায় চারপাশে। এরই অপেক্ষা করছিল ধুরন্ধর শেয়ালটা।
ঘরের পেছন দিকে বেড়ার পাশে চুপ করে বসে ছিল সুনসান। ছোট্ট একটু ফাঁক ছিল পুরনো বাঁশের বেড়াটার। এক হামলাতেই গলা ধরে ফেলেছিল মুরগিটার। দ্বিতীয় কোনো শব্দ করার সুযোগ মেলেনি তার। ঝটপট করে আবার জ্বালালাম কুপিটা।
দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একমুঠো পাটকাঠিতে আগুন লাগিয়ে মশাল তৈরি করলাম। এর আগে একদিন শুধু বাচ্চা নিয়ে দক্ষিণে বাঁশ ঝাড়টার দিকে দৌড় দিয়েছিল বনবিড়াল। প্রথমে বুঝতে না পেরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঘন বাঁশঝাড় ঘেরা পুকুরটার দিকে দৌড়াতে থাকি। বড় আগুনের ব্যবস্থা না করে শুধু কুপি নিয়ে ছুটছিলাম জঙ্গলের দিকে। যে কুপি হাতে নিয়ে সামান্য হাঁটতে শুরু করলে আগুন নিভে যায়, সে কুপি নিয়ে দৌড়ানোর পরও নিভছিল না, সে কথা মনে হলে এখনও অবাক হই। মুরগির বাচ্চার চিক চিক শব্দ অনবরত কানে আসছিল আর আমিও দৌড়াচ্ছিলাম পেছনে পেছনে। ঘন ঝোপের পুকুরটা পার হয়ে যাই অনায়াসে। আগে যেটি নানা উদ্ভট কাহিনীর জন্ম দিয়েছিল। বাজার শেষে গভীর রাত করে ফিরছিলেন শরাফত চাচা, অগত্যা ছোট বাচ্চার কান্না শুনে তড়িঘড়ি সাইকেল থেকে নেমে পড়েন। পুকুরের পানির ওপর কলাপাতায় শুয়ে ‘ওয়া ওয়া’ করে কান্না করছিল সদ্য প্রসবিত একটা শিশু। পাড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গভীর পানির দিকে এগোতে থাকে কলাপাতা। পরিস্থিতি অনুভব করতে পারেন বেচারা। দ্রুত কেটে পড়েন সেখান থেকে।
রমজান মেম্বার বাঁশতলার মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন পুকুর পাড়ে। মুরগির বাচ্চার চিঁউ চিঁউ শব্দ এবার কিছুটা পূর্ব দিক থেকে ভেসে আসছিল। অসহায় বাচ্চাটার প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ দেবার মতো নয়। অন্তরটা তার প্রতি মায়ায় বিগলিত হচ্ছিল। দৌড় দিলাম সেদিকেই। দেখতে দেখতে কখন যে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গিয়েছি টের পাইনি। ততক্ষণে নিভে গেছে কুপি। আমার বাসা থেকে ৪০০ মিটার দূরে কুড়–ম নদীর তীরে অদ্ভুত সে জঙ্গল। দিনের বেলাতেই যেখানে রাজ্যের অন্ধকার। একা যেতে সাহস পায় না কেউ। খালাতো ভাই হাসিনুর একবার কুচকুচে কালো অদ্ভুত জন্তু দেখে বড় ভয় পায়। কয়েকদিন জ্বরে ভুগেছিল সে। মেহেরুন আপাও সেখানকার দুর্গন্ধ পেয়েছিলেন নাকে। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠতেন তিনি।
সন্ধ্যাবেলা ক্ষেত নিড়ানির পর, বড় ভাই মাছ ধরতে নেমেছিলেন পাশের পুকুরটাতে। আস্ত মোটা একটা মাগুর মাছও ধরেন তিনি। হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে উঠে তাঁর শরীর। সেদিন থেকে জিনের আছর হয়ে ভুগতে থাকেন নানা রোগে। জঙ্গলের চারদিক থেকে ভেসে আসে অসংখ্য মুরগির বাচ্চার শব্দ। এইভাবেই স্মৃতি হরণ করেছিল মামুনের দাদী তথা মোন্নাফ মামার বৃদ্ধা মায়ের। তাঁর অন্যতম শখ ছিল ছাগল পালন করা। অনেক ছাগল ছিল বৃদ্ধার বাড়িতে। সন্ধ্যায় সব ঠিক ঠাক করে রাখার পরও রাতে যদি কোনো ছাগল হালকা চেঁচাতো, অমনি বিছানা ছেড়ে উঠে আসতেন সমস্যা হলো কি না তা দেখতে। একদিন বাসার বাইরে ভুট্টাক্ষেত থেকে ক্রমাগত ছাগলের ডাক শুনতে পান তিনি। ছোট্ট একটা কুপি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মুহূর্তেই। বাড়ির অন্য সদস্যরা কেউ টের পাননি তাঁর কর্মকাণ্ড। ভুট্টাক্ষেত পার হয়ে পশ্চিম দিকে বিলের ধারে চলে যান তিনি। এবার ছাগলের ডাক ভেসে আসে তাঁর উত্তর দিকের কবরস্থান থেকে। ততক্ষণে নিভে যায় কেরোসিন কুপি। বিকট একটা চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায় মামুনদের। বৃদ্ধার অনুপস্থিতি টের পেয়ে খুঁজতে থাকে এদিক সেদিক। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হয় কবরস্থানের পাশ থেকে।
তারপরও দ্বিতীয়বার ভুল করতে যাচ্ছিলাম আমি। অন্ধকারেই ছোট লাঠিটা দিয়ে জঙ্গল সরিয়ে খুঁজছিলাম মুরগির বাচ্চা। চারদিকের একসঙ্গে চিঁউ চিঁউ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি অনবরত। বুকের মধ্যে দুরু দুরু করছে হৃৎপিণ্ডটা। আম্মার ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পাই। কিন্তু নিজের উপস্থিতি বোঝাতে তাঁর জবাব দেয়ার মতো শব্দ গলা থেকে বের হচ্ছিল না। মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে করতে আর মায়ের ডাক অনুসরণ করে ফিরে এসেছিলাম বাসায়। অল্পের জন্য বেঁচে যাই স্মৃতিখেকোর খপ্পর থেকে।
সেই থেকে মনে ধারণা জন্মেছিল বড় আগুনের ব্যবস্থা না করে এসব অভিযানে নামা ঠিক নয়। পাটকাঠির মশালটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের পশ্চিম দিকে লেবু তলার দিকে ছুটে যাই। উঠানটার অর্ধেক অংশই পশম ছড়িয়ে পড়েছিল। নমুনা দেখে মনে হলো পশ্চিম পাশেই নিয়ে গেছে মুরগিটাকে। খড় গাদাটার পাশে হঠাৎ শেয়ালটাকে দেখতে পেলাম। কিন্তু তার মুখে মুরগি ছিল না। তাহলে কি ছেড়ে দিয়েছে মুরগিটাকে? ছোট বোন রতœা আর মাকে ডাক দিলাম ভালো করে খুঁজতে। কলা গাছের আড়ালে খানিক পর আবার দেখতে পেলাম শেয়ালটা। আরো মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে থাকলাম আহত মুরগিটা। কিন্তু না, আধা ঘণ্টা ধরে সম্ভাব্য সব জায়গাতেই খোঁজা শেষ। কোথাও পেলাম না। এবার বুঝতে পারলাম মুরগিটাকে যে শেয়ালটা নিয়ে গেছে সেটা নিরাপদ দূরত্বেই চলে গেছে। পরের শেয়ালটা অন্য আরেকটা। আমাকে বোকা বানানোর নিখুঁত দায়িত্ব পালন করেছে সে। এটাও যে স্মৃতিখেকোর কাজ কেবল সেটাই বুঝিয়ে দিল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ