স্পেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ

স্পেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ

ভ্রমণ সেপ্টেম্বর ২০১৩

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম

২৯ এপ্রিল ২০১২, ৩টা ১৫ মিনিট লোকাল দোসেল ড্রোপ ডবুবব থেকে স্পেনের মাদ্রিদ। কোন কিছু চেনা-জানা নেই। কিভাবে যাবো? রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার কারণে জার্মানির ডানেলা আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে নাস্তা খেলাম। তিনি বিমানবন্দর যাবার জন্য বাসে উঠিয়ে দিলেন। বাসের কোন হেলপার নেই, কন্ডাক্টর নেই, শুধু ড্রাইভার টিকেট কাটেন। নির্দিষ্ট সময় পার হলে দরজা লক করে ছেড়ে দেন। এর পর কী হবে, নেমে বিমানে উঠবো কী করে জানা নেই। ঘটনাক্রমে বাসস্ট্যান্ডে ডানেলা একজন জার্মানি কলেজ পড়–য়া স্টুডেন্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ঐব রং ইধহমষধফবংযর, যব রিষষ মড় ঃড় গধফৎরফ, যবষঢ় যরস ঢ়ষবধংব. সে বলল, ওকে। বাস যথারীতি সময়মতো বিমানবন্দর পৌঁছালো। নামলাম। ওই শিক্ষার্থী বলল, ঋড়ষষড়ি সব. আমি তাই করলাম। তিনি বড় ব্যাগ নেয়ার কারণে তাকে অন্য গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে বলে আমাকে আমার নির্দিষ্ট গেট দেখিয়ে বললেন, ঞযধঃ মধঃব রং ুড়ঁৎ, রহ মধঃব. ওসসরমৎধঃরড়হ, ঢ়ধংংঢ়ড়ৎঃ ইত্যাদি চেক করার পর সোজা ঢুকলাম ভেতরের গেটে। ওই শিক্ষার্থীর সাথে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করলেও ব্যক্তিগত কোন পরিচয় হয়নি। তিনি শুধু পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। দুই. মাদ্রিদ বিমানবন্দরে নামলাম। রিসিভ করার জন্য কিশোরকণ্ঠের লেখক ও ভক্ত নুরুল আলম বাঘা এলেন। আমি বিমানবন্দর থেকে নেমে সরাসরি রাস্তায় চলে গেলাম। হালকা বৃষ্টি, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বিমানবন্দরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা হাঁটছি আর হাঁটছি কিন্তু বাঘা ভাইয়ের দেখা মিলছে না। সাথে মোবাইল ছিল। কিন্তু তা জার্মানির বিমানে বন্ধ করার কারণে পিন কোড ভুলে গেছি। তাই তা আর ওপেন করা যাচ্ছিল না। পরে কী মনে করে হঠাৎ আবার ভেতরে প্রবেশ করলাম। হায়রে বাঘা ভাই! লম্বা হাতাওয়ালা এক ছাতা হাতে শীতের কারণে কুঁজো হয়ে আছেন। আমি তাকে ডাকলাম, কী ভাই বসে আছেন! আমি তো প্রায় ৫০ মিনিট ধরে আপনাকে খুঁজছি। কেন? ফোন দিলেই হতো। ফোনটা কাজ করছিল না। অনেককে অনুরোধ করছিলাম কিন্তু কেউ তা শুনেনি। অবশ্য কী করে শুনবেন, সবাই তো বিভিন্ন স্থান থেকে আগত। দ্বিতীয় কথা হলো ওখানে কল খুবই কস্টলি। তবে ইউরোপের পুলিশ ও লোকাল মানুষ খুবই হেলপফুল। তাদের কাছে কোনো লোকেশন জিজ্ঞাসা করলে অথবা কোন লোকের কাছে জরুরি কলের অনুরোধ করলে তা রক্ষা করেন। এরপর বাঘা ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। মেট্রো ট্রেন। অটো সিস্টেম টিকেট কাউন্টার। একটি কার্ড দাম ১০ ইউরো। এই টোকেন কার্ড দিয়ে ট্রাম হোক আর ট্রেন হোক যে কোন মেট্রো সার্ভিসে ১০ বার ওঠা যাবে। আমরা টিকিট নেয়ার পর পাতাল পথে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে শুধু ঢুকছি আর ঢুকছি। অনেক গভীরে গিয়ে উঠলাম ট্রেনে। সময়মতো ছেড়ে যাবে, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছবে, কোন রকম নড়চড় হয় না। যাই হোক অবশেষে বাঘা ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। তখন ৭টার মতো বাজে। মাগরিব হতে আরো দুই ঘণ্টা বাকি। প্রচণ্ড ক্ষুধার কারণে দেশীয় আমেজে বিদেশী খাবার খেলাম। রাত সাড়ে ৯টায় মাগরিবের নামাজ পড়লাম। আর এশার নামাজ রাত সাড়ে ১১টায়। ইউরোপে প্রায় বছরের বেশির ভাগ সময় রাত ছোট আর দিন বড় হয়। যে কারণে ইউরোপের লোকদের রোজা রাখতে হয় ১৮-১৯ ঘণ্টা। নামাজের সময় প্রতি মাসেই পরিবর্তন হয়ে থাকে। মাসিক নামাজের সময়সূচি মসজিদ থেকে বিতরণ করা হয়। ৩০ এপ্রিল ২০১২ বিকেল বেলায় রেথিরো পার্কের উদ্দেশে যাত্রা। পায়ে হেঁটে বাসা থেকে কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার। বাস, ট্রাম ও মেট্রো আছেÑ কিন্তু এ পথ বাঘা ভাইদের জন্য কোনো ব্যাপারই না। তারা ২০-৩০ কিলোমিটার প্রতিদিন হেঁটে থাকেন। আমরা যে হাঁটি না এটা হয়তো বাঘা ভাই ভুলে গেছেন। যাই হোক, হাঁটছিÑ আর হাঁটছি। আর মাঝে মাঝে কোথাও বসার জায়গা পেলে বসে পড়ছি। পা ব্যথা হয়ে যায়। তবু হাঁটতে হবে। ভাইজান আমাকে না হাঁটিয়ে ছাড়বেন না। ৫-৬ কিলোমিটার হাঁটার পর আমি আর পারছি নাÑ বললে এবার ভাইজানের একটু দয়া হলো। এই ডান পাশ থেকে একটা ট্রাম আসে ৩ মিনিট পর। ঠিক ৩ মিনিট পর ট্রামটা এলো। আমরা উঠে পড়লাম। যথারীতি সেই কাক্সিক্ষত পার্কের নিকট পৌঁছলাম। নেমেই রাস্তা সংলগ্ন লেকের কয়েকটি ছবি তুললাম। বাঘা ভাই বললেন, পার্ক একটু সামনেÑ পুরো পার্কটি লেক দ্বারা ঘেরা। লেকে চমৎকার অনেক হাঁস ভাসছে। অন্যরকম দেখতে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এরকম মনোমুগ্ধকার লেকে হাঁস পানিতে ভাসার মনোলোভা দৃশ্য! কেউ এদেরকে বিরক্ত করে না। প্রথমে গেলাম লেকের পাড়ে। কিছু কাঠের বাধা বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা। এব কাঠের ওপর ওরা উঠে নাচানাচি করে। পড়ে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। কারণ কাঠের নিচে নেট বাঁধা আছে। যে কারণে নির্ভয়ে ওরা নাচানাচি করে। পাশেই গেরিলা মার্কা বিশাল পাইপের গর্ত বাচ্চারা একদিকে ঢুকে ছেচরা করে নিচে পড়ে দারুণ এনজয় করে ওরা। এরই পাশে একটি চমৎকার ব্রিজ। গাড়ি চলে না, শুধু মানুষ হাঁটে। বিনোদনের জন্য। ডিজাইনটা বেশ সুন্দর হওয়ার কারণে সবার মন কাড়ে। দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ছবি তুললাম। তিনজন বৃদ্ধ মহিলা স্প্যানিশ ভাষায় আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল ... (বাঘা ভাইয়া বাংলায় তরজমা করে জানালেন)- ‘তোমরা আনন্দ করছো, ছবি তুলছো আমরা তো পারছি না। আমাদের খুব ভাল লাগছে।’ তখন আমার মনে হলোÑ লাইতাশ শাবাবু ইয়া উদ, ‘আহা যৌবন যদি ফিরে আসিত।’ আর তাদের জন্য দুঃখ পেলাম। কারণ ইউরোপে বুড়ো-বুড়িরা খুবই অসহায় থাকেন। কয়েকজন বুড়ো-বুড়ি একসাথে হাঁটেন পার্কে, রাস্তায় ও বিভিন্ন বিনোদন পার্কে। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার মত যেখানে সেখানে অবস্থান করে। একই পরিবারের অনেক সদস্য এক সাথে থাকতে দেখা যায় না। অনেক বুড়ো বুড়ি তাদের সহায়-সম্পদ সিটি করপোরেশনকে দান করে দেয় আর তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেয় সিটি করপোরেশন। এবার হাঁটলাম অনেক দূর। আর যত হাঁটি ততই মন ভরে যায়। অনেক শিশু তাদের বাবা-মায়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ আবার শিশুদের পাশাপাশি কুকুর নিয়ে ঘুরছে। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ যাতে শিশুর গায়ে না লাগে সে জন্য গাড়ি আশপাশ ও উপরে চমৎকার করে পলি/রেকসিন মুড়ানো। সন্তানের হেফাজতের জন্য এতোসব আয়োজন অথচ সেই সন্তানেরা বাবা মাকে ছেড়ে যায়। এটাই বড় দুঃখের বিষয়। এবার ফেরার পালা। বাঘা ভাই বলল, আমরা একজন বাংলাদেশী আজমল ভাই, গ্রামের বাড়ি ভোলা। তার বাসা এখানে-চলেন ওনার বাসায় যাই। ভদ্রলোকের বাসায় গেলে পরে তিনি ও তার স্ত্রী আমাদের এমনভাবে সমাদর করলেন যেন তারা আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনেন। এরকম মুহূর্তেই আপন করার লোক খুবই কম আছে। এরপর বাসায় আসলাম। কাসেনো পার্কে ভিজিট ঢুকতেই বিশাল গাছের বাগান। পার্কটি লেক, বিশাল পুকুর, ফুলের বাগান নার্সারি দ্বারা সাজানো একটি বাগান। একটি নার্সারির গাছগুলো এমনভাবে সাজানো যা দেখলে যে কারও মন ভরে যায়। এখানে কয়েকটি ছবি তুললাম। কতদূর এগিয়ে দারুণ একটি সার্কাস দেখলাম। সামনে এগোতেই দেখি বিশাল আকৃতির পুকুর। পুকুরে দারুণ একটি স্টিমার, স্পিড বোট। পরিবারগুলো নিজেদের মত করে ভাড়া নিয়ে ওইগুলো চালাচ্ছে। পুকুরের এক পাড়ে শিশুদের জন্য  নানান ধরনের খেলনা সার্কাস প্রদর্শনী ও ভিক্ষুকদের শাহি কায়দায় ভিক্ষা বিজনেস। যে কোন ভিক্ষুককে দেখলে ভিক্ষুক বলে মনে হয় না। তাদের দেখে মনে হয় তারা গানের আসর বা কোন বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী কছে। কোথাও গরু, মহিষ বা কোন প্রাণীর রূপ ধারণ করে সেজেগুজে অভিনয় করে ভিক্ষা করছে। যার এক পাড়ে চমৎকার কিছু মূর্তি সেখানে যে যার মত করে ছবি তুলে থাকে। অন্য পাড়ে চশমা বা ছোটখাটো দোকান দিয়ে বসেছে আফ্রিকানরা। পাশে এক ঝাঁক কবুতর। আর এক পাড়ের একটু দূরে গিয়ে দেখি গোলাপ ফুলের বাগান। সাদা-লালসহ নানান জাতের গোলাপ ফুল। কয়েকটি বড় টপ রয়েছে লেকজাতীয়। আর পানিতে ভাসছে হাঁস। মনে হয় কেউ এই হাঁসগুলো পুষছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এগুলো সরকারিভাবে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রাখা হয়েছে। কেউ এগুলো ধরা তো দূরের কথা পারলে খাবার দিয়ে খুশি থাকে। ফুলের বাগানে শিশুরা ফুল ধরে ধরে ছবি তুলছে আর আনন্দ করছে। তাদের বাবা মা অথবা দাদা-দাদীর সাথে। বেশ কয়েকজন বুড়ো-বুড়িকে মনোযোগ সহকারে ফুলের ছবি তুলতে দেখে অন্যরকম একটি আনন্দ অনুভব হয়েছে। এই কয়েক দিনের স্পেন ভ্রমণ প্রকৃতির প্রতি আরো প্রেম বাড়িয়ে দিল। বার বার মনে মনে ভাবছি আবার কবে ফিরব ঐ খানে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ