সোনালি ঈদের চাঁদ

সোনালি ঈদের চাঁদ

বিশেষ রচনা অক্টোবর ২০১৩

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

‘স্যার গোশতো নেবেন, ভালো গোশতো। এক্কেবারে বাছাই করা গোশতো।’ আচমকা এমন ডাকে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে ছেলেটি। গায়ে আধাপুরনো একটি শার্ট, জিন্সের প্যান্টটাও বেশ রঙচটা। চেহারায় মলিনতা থাকলেও মেধার ঝিলিক ওর চোখে মুখে। চটপটে ধরনের শুদ্ধ উচ্চারণের কথা যে কাউকেই কাছে টানার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ আছে আমার। কিন্তু গোশতো কেনার কোনো পরিকল্পনা নেই। আত্মীয়ের বাড়িতে কুরবানির গোশতো পৌঁছে দিয়ে ফিরছি। এক কথায় না করতে পারলাম না। ধীর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ওর নাম জিজ্ঞেস করতেই ঝটপট উত্তর, নাসিম, নাসিমুল হুদা। সুন্দর নাম তো, লেখাপড়া করো? গরিবের আবার লেখাপড়া স্যার, পড়ি, ক্লাস ফোরে। গোশতো বিক্রি করছো কেন, তোমরাই তো খেতে পারো। পারি স্যার, খাওয়ার মতো গোশতো আছে, মায়ে পাইছে আমিও পাইছি। মায়েরটা খাবো আমারটা বেচে সামনের বছরের খাতা-কলম কেনার টাকা জোগাবো। ভালো বুদ্ধি না স্যার? খাইলেই তো খাওয়া। অবাক হলাম তার কথায়। টলোমলো পানিও উঁকি দিলো চোখের কোনায়। ঈদ আসে ঈদ যায়। খুশির যে বারতা নিয়ে ঈদ আসে তা কি সকলের ঘরেই পৌঁছে? হ্যাঁ, পৌঁছে। হয়তো ধনীদের মতো করে নয়; নাসিমদের মতো স্বপ্নবোনা দুঃখীদের মতো করে। ওরাও তো মানবশিশু। ওদেরও একটা মন আছে, আছে শিশুসুলভ আহ্লাদের আকাক্সক্ষা। ওরাও বেড়ে উঠছে আমাদের শিশুদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া শরীর নিয়ে। ওদেরও তো স্বপ্ন আছে মানুষ হওয়ার। ঈদুল আজহা আসছে। এটাকে কুরবানির ঈদ বলা হয়ে থাকে। কোন কোন এলাকায় এটাকে বকরা ঈদও বলে। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদারদের কঠোরতার কারণে গরু কুরবানি করা যেত না বলে ছাগল কুরবানি দিয়েই কুরবানির হক আদায় করতে হতো। আরবিতে বাকারা মানে গরু আর গ্রামীণ ভাষায় ছাগলকে বলা হতো বকরী। এ বকরী কুরবানি দিয়েই বাকারা অর্থাৎ গরু কুরবানির হক আদায় করার চেষ্টা করা হতো বলেই এটাকে বকরা ঈদ বলা হয়। যাহোক, ঈদুল আজহা মূলত কুরবানির উৎসব। তাই এ ঈদে সাধারণত নতুন পোশাক কেনার ভিড় খুব বেশি থাকে না। এ ঈদে কে কতো ভালো পশু আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানি করতে পারে তারই সর্বোচ্চ নাজরানা পেশ করতে হয়। এই কুরবানির নাজরানা শুরু হয়েছে হযরত ইবরাহিম (আ) এর সময় থেকে। তিনিই আমাদের মুসলমানদের জাতির পিতা। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় নবী এবং বন্ধু। এ জন্য তাঁকে ইবরাহিম খলিলুল্লাহ বলা হয়ে থাকে। খলিল মানে বন্ধু, অর্থাৎ খলিলুল্লাহ মানে আল্লাহর বন্ধু। মহান আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য স্বপ্নের মাধ্যমে কুরবানি করার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি হাজার হাজার উট, দুম্বা, ছাগল কুরবানি দিলেও আল্লাহ খুশি হননি। তিনি তাঁর প্রিয় জিনিসকে কুরবানি দিতে বলেন। এতে হযরত ইবরাহিম (আ) ভাবলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে ইসমাঈলই (আ) তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ হয়তো তাঁকেই কুরবানির নাজরানা হিসেবে চাচ্ছেন। নিজের একমাত্র সন্তান ১৩ বছরের কিশোর পুত্রকে জবাই করা কি সহজ কথা?! অনেক ভেবে চিন্তে দেখলেন তিনি। শেষে ভাবলেন, সন্তানটি আমার পরিচয়ে বড় হলেও এটি তো আসলে আমার না। এ তো আল্লাহরই। কারণ তিনি যদি না দিতেন তাহলে কি আমি সন্তানের পিতা হতে পারতাম!? আসলেই তো সত্যি! আমরা সবাই পিতা-মাতার সন্তান হলেও মূলত আল্লাই তো আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি যদি আমাদেরকে দুনিয়ায় না পাঠাতেন তাহলে কি আমরা আসতে পারতাম? না কক্ষনোই না। তাহলে আমরা আসলে কার সম্পদ অর্থাৎ আমাদের মালিক কে? নিশ্চয়ই আল্লাহ। এ রকম হাজার ভাবনার ভিড় ঠেলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, আল্লাহর সম্পদ আল্লাহই চাচ্ছেন। সুতরাং আমার এতে আফসোসের কী আছে? তিনি তাঁকে কুরবানি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। বাড়ি থেকে অনেক দূরে মিনায় নিয়ে গিয়ে তাকে বললেন, বাবা, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন যে, আমি যেন আমার প্রিয় জিনিসকে কুরবানি করি। বলতো আমার প্রিয় জিনিস কী? হযরত ইসমাঈল (আ)-এর আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন। কী অবাক কাণ্ড! তেরো বছরের একজন সদ্যকিশোর আল্লাহর রাহে জীবন দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করলেন না। পিতা-পুত্র উভয়ই আল্লাহর খুশির দিকে তাকিয়ে সব ভালোবাসা কুরবানি দিচ্ছেন। হযরত ইসমাঈল (আ) শুয়ে পড়লেন কুরবানি হওয়ার জন্য। আল্লাহর নামে ছেলের গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন পিতা। হায়রে করুণ দৃশ্য! কিন্তু কারো মনে কোন দুঃখ-কষ্টের লেশমাত্র নেই। কারণ এটা যে আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর হুকুম যতো কঠিনই হোক তাতে কষ্টের কিছুই থাকে না। কারণ তারা দু’জনই তো আল্লাহর খাস গোলাম। আল্লাহর ভালোবাসায় যারা নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে তারা তো জীবন দেয়ার মধ্যেই সুখ খুঁজে পায়। কিন্তু হায়! একি! ছুরি তো কাটছে না। একবার, দু’বার, তিনবার চেষ্টা করেও ছুরি কাটছে না। সিজদায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন নবীÑ হায় আল্লাহ! তুমি আমাকে কী পরীক্ষায় ফেললে! আমার অপরাধ কী? তুমি আমার কুরবানি কবুল করছো না কেন? আল্লাহর হুকুম মতো শেষবারে আবার ছুরি চালিয়ে দিলেন। কুরবানি হয়ে গেলো। চোখ খুলে দেখলেন তার প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ) তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, আর কুরবানি হয়ে আছে একটি দুম্বা। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলোÑ হে ইবরাহিম! তোমরা বিজয়ী হয়েছো। কুরবানিতে পশু জবাই করা হলেও আল্লাহ মূলত মানুষের হৃদয়ের বিশুদ্ধতা আর ভালোবাসার টানকেই পরীক্ষা করেন। আসলে কার প্রতি আমাদের দরদ, আল্লাহর প্রতি না জিনিসের প্রতি, এটা প্রমাণ করার জন্যই কুরবানি। কুরবানির পশুর গোশতো, হাড্ডি, চামড়া, রক্ত কোনো কিছুই কি আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়? না যায় না। যায় শুধু হৃদয়ের বিশুদ্ধতা, পরিশুদ্ধ নিয়ত আর তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসাÑ ত্যাগের নাজরানা। তাই এ কুরবানি যেন আমাদের নিজেদের প্রদর্শনী আর ভোগের জন্য না হয়। হারাম উপার্জনের লক্ষ টাকা দামের পশু কুরবানির মধ্যে কোন সার্থকতা নেই; বরং হালাল উপায়ে অর্জিত সাধ-সাধ্যের সমন্বয়ে অল্প মূল্যের পশু কুরবানিতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে পারে। তবে কুরবানিতে যেমন বিলাসিতার সুযোগ নেই তেমনি যেন বখিলতা না পেয়ে বসে সেটাও মনে রাখতে হবে। নিয়তের বিশুদ্ধতা যেন থাকে আর এর গোশতো যেন গরিব দুঃখীদের ঘরে যথাযথভাবে পৌঁছে যায়; আমি গোশতো খেয়ে মজা করার সাথে সাথে যেন সেই পরিবারেও গোশতো পৌঁছে যায়, যাদের জন্য গোশতো-ভাত খানিকটা স্বপ্ন আর উৎসবের মতো; সে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। গ্রামের কোনো কোনো মানুষের কুরবানিতে গোশতের ভাগবাটোয়ারায় বেশ সচেতনতা লক্ষ করা গেলেও শহরে খানিকটা এলোমেলো ভাব পরিলক্ষিত হয়। সামান্য কিছু গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে বাকিটা ফ্রিজে ভর্তি করার একটা মানসিকতা লক্ষ করা যায়। এটা ঠিক নয়। আমাদের উচিত হক অনুযায়ী মুস্তাহাব নিয়মে গোশতোকে তিন ভাগ করেই বণ্টনের চেষ্টা করা। আর গরিবদের প্রাপ্য ভাগকে করুণা হিসেবে নয় তাদের অধিকার এবং আমাদের পৌঁছানোর দায়িত্ব মনে করেই দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। শহরের সব গরিব মানুষ হয়তো সে গোশতের কিছু অংশ রাস্তার মোড়ে বিক্রি করে দিতে পারে, তাই বলে তাদের মাহরুম করার কোন সুযোগ নেই। হতে পারে সেই গোশতো বিক্রি করেই নাসিমদের মতো শিশুদের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ার একটা টুকরো আলো হিসেবে আমাদের কুরবানি কাজে লাগতেও পারে। সোনালি চাঁদটাও তাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে খুশির ঈদ আর সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি; তাদের ভাগ্যেও উঠে আসতে পারে এক টুকরো সোনালি ঈদের চাঁদ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ