সূর্যঘড়ি

সূর্যঘড়ি

বিজ্ঞান সোহেল রানা আগস্ট ২০২৩

সময় নির্ধারণের জন্য আমরা ঘড়ি ব্যবহার করে থাকি। বর্তমানে রয়েছে অত্যাধুনিক ঘড়ি। ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটা দিয়ে সময় বুঝতে যেন অসুবিধা না হয় সেজন্য আছে স্মার্ট ঘড়ি।

ঘড়ি আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। সেই সময়ে মিসরীয়রা আবিষ্কার করেছিল জমি মাপজোখ করার পদ্ধতি। মাপজোখ করতে গিয়ে তারা সময়কেও পরিমাপ করতে চেয়েছিল। সময় পরিমাপের জন্য তারা আবিষ্কার করল ‘সূর্যঘড়ি’ বা ‘ছায়াঘড়ি’। এটি প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর ও ব্যাবিলনে এর উৎপত্তি। ঘড়িটি আজও টিকে আছে। এর সেকেন্ড ও মিনিটের কাঁটা নেই, নেই কোনো টিকটিক শব্দ।

সূর্যঘড়ি সময় দেয় একদম নিখুঁত। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর, এ নিয়েই সূর্যঘড়ি।

মাত্র ৭০০ বছর আগে লাতিন শব্দ ক্লক্কা থেকে এসেছে ক্লক। ক্লক্কা মানে ঘণ্টি। যদিও ইতিহাসে এই মূল্যবান সূর্য ঘড়ির আবিষ্কারক হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়নি। তবে সূর্য ঘড়ির ব্যবহার শুরু হয় মিসরীয় সভ্যতায়। তারাই প্রথম প্রকৃতিনির্ভর অর্থাৎ সূর্য-ঘড়ি নির্মাণ করেছিল। মিসরে সূর্যঘড়ি ছাড়াও আগুনঘড়ি, বালিঘড়ি, পানিঘড়ি নামক বিভিন্ন ঘড়ির ব্যবহার ছিল। 

সূর্যঘড়ি বানাতে তখন খোলা জায়গায় লাঠি পুঁতে রাখা হতো। সেই লাঠিকে ঘিরে মাটিতে ছোটো বড়ো কয়েকটি চক্র দিয়ে দেওয়া হতো। চক্রের ওপর বিভিন্ন সঙ্কেত দেওয়া থাকত, যা দিয়ে বিভিন্ন প্রহর বোঝায়। সূূর্র্যের আলোর কারণে লাঠির ছায়া মাটির ওপর পড়ত, আর সেই ছায়ার চিহ্ন দেখে সময় নির্ধারণ করা হতো। 

ইউরোপিয়ানরা এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। তবে ১৪ শতকের দিকে নির্মিত ঘড়িগুলো শুধু ঘণ্টা নির্দেশে সক্ষম ছিল, মিনিট বা সেকেন্ডের হিসাব দিতো না। তাছাড়া বর্তমান ঘড়ির দুই ঘণ্টা ছিল সেই ঘড়ির হিসাবে এক দিন। অর্থাৎ একদিনে ঘড়িটি মাত্র দু’বার ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতো। 

১৬৫৬ সালে গ্যালিলিওর ধারণা থেকে পেন্ডুলাম চালিত প্রথম কার্যকর ঘড়ি আবিষ্কার করেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন। সেই ঘড়িটির পেন্ডুলাম ডানে-বামে হেলেদুলে বেশ ভালোভাবেই ঘুরিয়ে দিতো মিনিট ও ঘণ্টার খাঁজকাটা চাকতিগুলো।

তবে প্রথম দিকে পেন্ডুলামের দুলুনির মাত্রা ছিল অনেক, প্রায় ৫০ ডিগ্রি। পরে তা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে পেন্ডুলাম ঘড়ির পেছনে প্রথমবারের মতো জুড়ে দেওয়া হলো ব্যাটারি। তারপর একের পর এক আবিষ্কার হতে থাকে আধুনিক ঘড়ি।

সূর্যঘড়িকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় সানডায়াল। এটি একটি কৌশল বলা যায়। যা সূর্যের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে। সাধারণ নকশার সূর্যঘড়িতে সময় নির্ণায়ক শৈলী হিসেবে ধারালো প্রান্তবিশিষ্ট একটি চিকন রড থাকে। 

সূর্যঘড়ির মাধ্যমে দিনের বেলায় সময় নির্ধারণ করা গেলেও রাতের বেলায় সেটা সম্ভব হতো না। তখনকার সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে মানুষকে ভাবিয়ে তুলল। ফলে তারা লক্ষ করলো রাতের আকাশে। রাতের আকাশে এমন এক নক্ষত্রের সন্ধান করতে লাগল, যা সব সময় এক দিক থেকে অন্যদিকে যাবে। অবশেষে পেয়েও গেল। দেখতে খুব উজ্জ্বল আর একটু লম্বা। 

নক্ষত্রটি আকাশের উত্তর দিকে ওঠে আর ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়, শুধু তাই না এটি মেরুকে কেন্দ্র করে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে থাকে, যা দিয়ে অনায়াসে সময় নির্ধারণ করা যায়। এর নাম ‘ক্যাসিওপিয়া’। দেখতে অবিকল ইংরেজি ডি অক্ষরের মতো। এই ‘তারাঘড়ি’ প্রথম আবিষ্কার করে জার্মানরা।

তারা ঘড়ির পর আসে পানিঘড়ি। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাল নাগাদ মিসরীয়রা প্রথম পানি ঘড়ি আবিষ্কার করেন। একটি ফানেলের মধ্যে পানি ভরে রাখা হতো, আর সেই ফানেলের নিচে লাগানো হতো এক সরু পাইপ। ফানেলের পানি সরু পাইপ বেয়ে পড়তো একটি জারে। সেই জারের মধ্যে একটা হালকা কর্ক রাখা হতো। পাত্রের অপর প্রান্তে লাগিয়ে দেওয়া হতো দাঁতযুক্ত একটা সময় নির্দেশক কাঁটা।

ফানেল থেকে ধীরে ধীরে পানি চলে আসতো জারে, জারে যত পানি পড়তো কর্ক ততই ভেসে উঠত। সেই সঙ্গে সময় নির্দেশক কাঁটা ঘুরতে আরম্ভ করত, যা বলে দিতো সময়। গ্রিকরা একে বলত ‘ক্লিপসেড্রা’।

এরপর এলো ‘বালুঘড়ি’। প্রায় বারোশ’ বছর আগে এর প্রচলন শুরু হয়। বালুঘড়ি ছিল কিছুটা পানিঘড়ির মতো। তবে এ ঘড়ির জন্য প্রয়োজন হয় একটা ফানেল, যার মাঝখানটা চ্যাপ্টা। ফানেলের ওপর দিয়ে কিছুটা বালি ফানেলের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হতো। অপেক্ষাকৃত সরু ও মিহি দানার বালি ফানেলের চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে নিচে পড়তো। ফানেলের নিচের অংশে রাখা হতো একটি স্কেল। স্কেলের মাধ্যমে বালুর জমা হওয়ার পরিমাণ দেখে সময় নির্ণয় করা হতো।

রাতের বেলা মানুষ ঘড়ির বিকল্প হিসেবে মানুষ আবিষ্কার করে ফেলল ‘মোমঘড়ি’। চীন দেশেই প্রথম আবিষ্কার হয় ‘মোমঘড়ি’। সূর্যঘড়ির পদ্ধতিতে এই ঘড়ি তারা ব্যবহার করত। অন্ধকার ঘরে তারা একটা মোমবাতি জ্বালাত। সেই আলোর কাছাকাছি রাখা হতো কোনো মানদণ্ড। মোমের আলো গিয়ে পড়ত সেই মানদণ্ডে। মানদণ্ডের সামনের অংশ আলোকিত হতো আর পিছনের অংশে পড়তো এর ছায়া। মোম যত ছোটো হতো ছায়া তত দীর্ঘ হতো। এই ছায়া পরিমাপ করে মানুষ সময়ের পরিমাপ করত। তবে সূর্যঘড়ির ব্যবহার ছিল ব্যাপক।

আমাদের দেশেও আছে সূর্যঘড়ি। যদিও অন্যগুলোর মতো এটিও এখন অচল। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বলধা গার্ডেনে রয়েছে প্রাচীন সূর্যঘড়ি। বলধা গার্ডেন যে শুধু গাছগাছালির মনোরম পরিবেশের জন্যই আকর্ষণীয়, তা কিন্তু নয়। এর আকর্ষণের আরেকটি কারণ এই সূর্যঘড়ি। 

বলধা গার্ডেন সম্পর্কিত বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, গাজীপুর জেলার বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বলধা গার্ডেনের সূচনা করেন। তখন থেকেই সূর্যঘড়িটি ঐতিহ্যবাহী এ বাগানের শোভা বৃদ্ধি করে আসছে। প্রতি বছরই এই ঘড়ি সংস্কার করা হয়। 

ঘড়ির পাশে বড়ো বড়ো গাছ ও ভবন তৈরি হওয়ায় এখন আর আগের মতো রোদ পড়ে না ঘড়ির ওপর। ফলে সূর্যঘড়ি তার কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। এই সূর্যঘড়িতে দিকনির্দেশক তীরের ফলার মতো আনূভূমিক লোহার পাত রয়েছে। লোহার পাতের নিচে একটি গোলাকার চাকতিতে ছায়া পড়ে। ১৮০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো এ চাকতির ভেতরের ছয় থেকে ১৯ পর্যন্ত অঙ্ক-দাগাঙ্কিত আছে। দাগগুলোর চিহ্ন নির্দেশক সংখ্যাগুলো ঘণ্টা নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার হয়।

সূর্যঘড়ির লোহার পাতটির ওপর সূর্যের আলো পড়লে তার ছায়া সমতল চাকতির যে অঙ্কের ওপর পড়ে তখন ততটা বাজে। এর পাশে আর একটি ছোটো আকৃতির মিনিট নির্দেশক রয়েছে। সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর ছায়ার অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটে। আর ছায়ার অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সময়েরও পরিবর্তন হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ