সহমরণ

সহমরণ

গল্প শাহেদ আলী এপ্রিল ২০২৩

তোমরাতো অ্যাকুয়ারিয়াম পছন্দ কর। বিশেষ করে অ্যাকুয়ারিয়ামের রঙিন মাছের খেলা। আমাদের ছোট্ট দুটি অ্যাকুয়ারিয়ামে চারটি সোনালি মাছ ছিল। গোল্ডেন ফিশ। দুই রকমের চারটি মাছ, একটি দেখতে পুঁটি মাছের মতো, কিন্তু সোনালি, রঙিন, অপরটি দেখতে রাজরানীর মতো। সেও সোনালি রঙের। অযত্নে কি না জানি না, অ্যাকুয়ারিয়ামে পুঁটির মতো একটি মাছ মরে গেল। আমার খালি মনে হতো, এই মাছটি একা হয়ে গেছে। তার বড়ো দুঃখ, তার বড়ো কষ্ট। হয়তো একাকী অ্যাকুয়ারিয়ামে সাঁতার কাটতে ভয়ও পায়। তার খেলার সঙ্গী নেই। দুইজনে একসঙ্গে মিলে নাচানাচি করতো। রাত্রে দূর থেকে বসে দেখতাম অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ দুটি ঝিলিক দিচ্ছে। কী চমৎকার না লাগতো। আলো প্রতিফলিত হতো ওদের গা থেকে। মাছটির দুঃখ দূর করার জন্য ওকে রাখলাম প্রজাপতির মতো দুটি মাছের সঙ্গে। এখন একই অ্যাকুয়ারিয়ামে তারা হলো তিনজন। একদিন দেখলাম প্রজাপতির মত সোনালি মাছ দুটির একটি মরে গেছে। ভীষণ ব্যথা পেলাম মনে। তিনটিতে মিলে কি আনন্দেই না নেচে বেড়াতো পানিতে। 

এখন রইল ওরা দুইজন। পুঁটির মতো একটি সোনালি মাছ আর একটি প্রজাপতির মতো। মাছ একা থাকতে চায় না। তার খেলার সঙ্গী দরকার। দুজন, দু’জাতের হলেও তাদের মধ্যে ভাব হয়ে যায়। আমি একটু দূরে বসে রাত্রে ওদের খেলা দেখি, নাচানাচি দেখি। মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা দুজনে খুব কাছাকাছি হয়ে কী যেন শলা-পরামর্শ করছে। বুঝে উঠতে পারি না। দুজনেই তো সঙ্গী হারা। এই দুঃখ কি মাঝে মাঝে ওদের উতলা করে তোলে? কী পরামর্শ করে ওরা? ওদের ভাষা ওরাই বোঝে। আমরা তো বুঝি না। আমরা তো কেবল তাদের নাচ দেখি। 

মাছ দুটি আমাদের আনন্দের খোরাক, বিশেষ করে রাতে যখন ড্রয়িংরুমে কেউ থাকে না, তখন আমি চুপ করে বসে অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে চেয়ে থাকি। অন্ধকারে অ্যাকুয়ারিয়ামে ওরা যখন নাচে, সাঁতার কাটে তার ঝিলিক উদ্ভাসিত হয়। ওদের জন্য বিশেষ খাবার কেনা হয়। সেই খাবার পেলে ওরা আনন্দে মাতামাতি করতে থাকে। পানিতে অক্সিজেনের দরকার। সব সময় আমাদের খেয়াল থাকে না। তখন ওদের খুব কষ্ট হয়। আমার মেজো মেয়ে মাছগুলোর জন্য সব সময় নজর রাখে। এগুলো তারই শখের বস্তু। এখন আমারও সুখের বস্তু হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে এমন আনন্দ পাই যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, যার কোনো কূল নেই। সে একদিন বললো, মাছগুলো যাতে নিয়মিত অক্সিজেন পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। মাছগুলোর যে কখন অসুবিধা হয়, কষ্ট হয় তা বলতেও পারে না। 

অ্যাকুয়ারিয়ামে যারা মাছ লালন পালন করেন তাদের সব সময় এ দিকে নজর রাখতে হয়। পানিতে যে মাছগুলো ছুটাছুটি করে, আমরা অনেক সময় চিন্তাও করে দেখি না ওদের কী প্রয়োজন। আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের ওপর যারা নির্ভর করে তাদের কথা মনে রাখি না। তাই তাদের দুঃখ কষ্ট আমরা চোখে দেখি না। ভিন্ন প্রজাতির দুটি মাছ আজকে আমি একটি ক্ষুদ্র অ্যাকুয়ারিয়ামে রেখেছি, ওরা প্রাণের আনন্দে সাঁতার কাটে, পানির ভেতর ওলট পালট খায়, তখন আলো পড়লে ঝিলিক দেয়। বসে বসে দেখি। 

কয়েকদিন ধরে একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছি। অ্যাকুয়ারিয়ামের ওপর সব সময় চোখ রাখতে পারি না। মাঝে মাঝে ওদেরকে খুবই বিষণœ মনে হয়। মনে হয় ওরা যেন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মাছ দুটি খুব আস্তে আস্তে দম ফেলছে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলছে। আমরা স্থির করেছি, কাঁটাবন গিয়ে দুজোড়া মাছ কিনে নিয়ে আসবো। এনে পুঁটি মাছের মতো একটি সোনালি মাছ আমাদের অ্যাকুয়ারিয়ামের সোনালি পুঁটি মাছের সঙ্গে রাখবো। আর একটা প্রজাপতির মতো মাছ এনে রাখবো আর একটি অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রজাপতির মতো মাছটির সঙ্গে। তাতে করে হয়তো ওদের একাকিত্ব ঘুচবে। আমি চাই যে ওরা জোড়ায় জোড়ায় থাকুক। আনন্দে খেলুক। সাঁতার কাটুক। কিন্তু যানজটের জন্য কাঁটাবন যাওয়া হয় না। মাছের খাবারও ফুরিয়ে গেছে। শরীরটাও ভালো থাকে না বলে বাইরে বেরোতে উৎসাহ পাই না। মাঝে মাঝে ওরা কিছু না বললেও মাছগুলোর কষ্ট অনুভব করি। ওরাতো প্রাণী, প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর একটা আত্মিক যোগাযোগ আছে। ওরা বাতচিত না করলেও ওদের একের দুঃখ কষ্ট অপরের অন্তরে বেদনার ঢেউ তোলে। একে অপরকে বুঝতে পারে। সাঁতার কাটতে কাটতে ঝিলিক দিয়ে যখন হারিয়ে যায় তখন মনে হয় যেন নীরবে বলছে “বিদায়”! তখন ওদের মুখে আমি যেন হাসি দেখতে পাই। 

অ্যাকুয়ারিয়ামটা ড্রয়িং রুমে রেখেছি। ড্রয়িং রুমে বসলেই মাছের খেলা চোখে পড়ে। একদিন ঘুম থেকে উঠেছি একটু দেরিতে। ড্রয়িং রুমে বসে অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে নজর দিয়ে মনে হলো পানি স্থির হয়ে আছে, মাছের নড়াচড়া দেখছি না, এর মধ্যে কাজের মেয়ে তাওহিদা বললো, খালু আপনার মাছটি মরে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে অ্যাকুয়ারিয়ামের কাছে গিয়ে লক্ষ করি, দুটি মাছই মরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ভাসছে। ওরা দুটি কি পরামর্শ করে আত্মহত্যা করেছে? কিছু বুঝতে পারলাম না। কেবলই মনে হতে লাগলো, একাকী জীবন মাছ দুটির কাছে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। তাই শলাপরামর্শ করে এক সঙ্গে দুজনে মৃত্যুবরণ করেছে, সহমরণে গেছে।

*গল্পটি কথাশিল্পী শাহেদ আলীর সহধর্মিনী ভাষাসৈনিক ও সাহিত্যিক অধ্যাপিকা চেমন আরার সৌজন্যে প্রাপ্ত।

- সম্পাদক

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ