সবুজের গ্রাম   -রফিক মুহাম্মদ

সবুজের গ্রাম -রফিক মুহাম্মদ

গল্প জুন ২০১৮

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে। গ্রিলের ফাঁকে এক চিলতে ধূসর আকাশ দেখা যাচ্ছে। পুরো আকাশটা দেখার জন্য জানালার কাচ সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পারে না। সবুজের মনটা খারাপ হয়ে যায়।
দুপুর বেলার এই সময়টা তার কিছুতেই কাটতে চায় না। খাওয়া দাওয়া সেরে এ সময় বাসার প্রায় সবাই যে যার রুমে ঘুমিয়ে পড়ে। ওর সমবয়সী আরাফ জেগে থাকলেও একা একাই কম্পিউটারে গেম খেলে। একটা ছোট বাক্সের মধ্যে একা একা কী খেলা যে খেলে তা আল্লাই জানে। গ্রামে থাকতে সবুজ এই ভরদুপুরে বন্ধুদের সাথে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করে সময় কাটিয়েছে। তা না হলে স্কুলের পাশের বাগানে এ গাছ থেকে ওগাছে ঘুরে বেড়িয়েছে পাখির ছানার খোঁজে। চৈত্র-বৈশাখ মাসের ভরদুপুরে পুরো বাগানজুড়ে থাকে সুনসান নীরবতা। পাখিরাও এ সময় চুপচাপ বাসায় বসে ডিমে তা দেয়। কোন বাসায় ছোট ছোট বাচ্চা থাকে। এ সময় বন্ধুদের নিয়ে পাখির বাসায় হানা দেয়। আজাদ, ছালাম, হারেছ, দুলাল ওদের নিয়ে একবার ফিঙের বাসায় হানা দিতে গিয়ে মহা বিপদে পড়েছিল। সবুজ আর দুলাল ওরা দু’জন কড়ই গাছে উঠেছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা। কড়ই গাছের আগায় ফিঙে পাখির বাসা। কাছাকাছি যেতেই বাসার ভেতর থেকে ফুরুত করে উড়ে যায় একটি ফিঙে। এর পর ছেঁ ছেঁ করে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে তুলে। শুধু তাই নয় পাখিটা উড়ে উড়ে এসে বাসার কাছে থাকা সবুজের মাথায় মুখে আঁচড় এবং ঠোকর দিতে থাকে। পাখির ঠোকরে, আঁচড়ে সবুজের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। নিচ থেকে অন্যরা পাখিকে লক্ষ করে ঢিল ছোঁড়ে তবুও দূরে যায় না। ছেঁ ছেঁ করে চিৎকার করে আর উড়ে উড়ে এসে সবুজের মাথায় মুখে হামলা করে। পাখির চিৎকার শুনে স্কুল থেকে ইসলাম স্যার বেরিয়ে আসেন। দৃশ্যটা দেখে তিনি বলেন, এই সবুজ-দুলাল তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আয়। যদি জোড়া পাখিটা চলে আসে তাহলে কিন্তু ঠোকরিয়ে তোর চোখ মুখ ছিঁড়ে ফেলবে। স্যারের কথায় সেদিন গাছ থেকে নেমে এসেছিল সবুজ আর দুলাল। ইসলাম স্যার সেদিন বলেছিলেন, পাখির বাসা থেকে আর কোনদিন বাচ্চা নিবি না বুঝলি? বাচ্চার জন্য মা পাখিটা কী করে দেখেছিস? মায়ের বুক থেকে বাচ্চা কেড়ে নিলে মায়ের খুব কষ্ট হয়। এমন কাজ আর কখনো করবি না।
ইসলাম স্যার ওদের গাঁয়েরই লোক। সবুজদের বাড়ির তিন চারটা বাড়ি পরে ইসলাম স্যারদের বাড়ি। স্যারকে সবুজ চাচা বলে ডাকে। সবুজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। এর পরে আর স্কুলে যেতে পারেনি। ইসলাম স্যার হাইস্কুলের মাস্টার। সবুজের আর ইসলাম স্যারের কাছে পড়তে হয়নি। তাই ইসলাম স্যারকে সে চাচা বলেই ডাকে। সবুজের বাবা সরুজ আলী দিনমজুর। চার সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। চৈত্র মাস এবং কার্তিক মাস এলে গ্রামে অভাব দেখা দেয়। কাজকাম তেমন একটা থাকে না। তখন কোন কোন দিন পুরো পরিবার নিয়ে উপোস থাকতে হয়। একার আয়ে কিছুতেই সংসার চালাতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে সবুজের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। তাকে গ্রামের পাঠান বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দেয়। সবুজ পাঠান বাড়িতে ক্ষেতে খামারে কাজ করে। মাঠে গরু চরায়। গরুর পাল নিয়ে যখন মাঠে যায় তখন তার অন্য বন্ধুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। তা দেখে সবুজের বুকটা হু হু করে ওঠে। সবুজের খুব ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখবে। কিন্তু তা আর হলো না। অভাবের সংসার চালাতে এই বয়সে তাকেও ক্ষেত মজুরের কাজ করতে হচ্ছে। সবুজ এখন স্বপ্ন দেখে তার ছোট ভাই শুভকে নিয়ে। যত কষ্টই হোক শুভকে সে স্কুলে পড়াবে। ভাইকে সে লেখাপড়া শিখাবে।
পাঠান বাড়িতে ছয় মাস কাজ করার পর ওই বাড়ির বড় মেয়ে সবুজকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। বারো তেরো বছরের ছটফটে সুন্দর ছেলেটি বড় বাড়ির বড় মেয়ের খুব ভালো লেগে যায়। সবুজের বাবা-মা প্রথমে রাজি হয়নি। পরে পাঠান বাড়ির বড় মেয়ের পীড়াপীড়িতে এবং মাসে এক হাজার টাকা বেতনের কথায় রাজি হয়ে যায়।
ঢাকায় যাবে এ কথা শুনে সবুজতো আনন্দে আত্মহারা। টিভিতেতো দেখেছে ঢাকায় চিড়িয়াখানা, শিশুপার্কে ওর মতো ছেলে-মেয়েরা কত মজা করে আনন্দ করে। বড় ফুফুর সাথে গিয়ে সেও শিশুপার্কে চিড়িয়াখানায় ঘুরবে আনন্দ করবে। আজ প্রায় দু’মাস হতে চললো সবুজ ঢাকায় এসেছে অথচ একদিনও সে চিড়িয়াখানায়, শিশুপার্কে যেতে পারেনি। আসার পর থেকে এই বাসার মধ্যে তার সময় কাটছে। সকালে আরাফের সাথে গাড়িতে করে স্কুলে যায়। আরাফের ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে বাসায় চলে আসে। এর পর ফুফার সাথে গাড়িতে করে বাজারে যায়। বাজার থেকে ফিরে সারাদিন আর কোন কাজ নেই। সারাক্ষণ শুয়ে বসে তার সময় কাটে। আরাফের কখন কি লাগে সে দিকে লক্ষ রাখাই সবুজের কাজ। আরাফতো সারাদিন কিছুই চায় না। বেশির ভাগ সময়ই কম্পিউটারে গেম খেলে সময় কাটায়। খাওয়ার সময় হলে বড় ফুফু এসে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। এত বড় ছেলে হয়েছে অথচ নিজ হাতে এখনো খেতে পারে না। মা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। সবুজ প্রথমে এটা দেখে অবাক হয়েছে এবং মুচকি মুচকি হেসেছে। এখন আর হাসে না। শুধু খাওয়া নয় আরাফকে তার মা নিজ হাতে গোসল পর্যন্ত করায়। আর সবুজ সে তো নিজে বন্ধুদের সাথে নদীতে ঝাঁপিয়ে গোসল করে। সাঁতরিয়ে নদীর এপার থেকে ওপারে যায়। নদীর পাড়ের কদমগাছে উঠে সেখান থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ে। সবাই মিলে ডুব সাঁতার খেলে। এভাবে নদীতে গোসলের কী যে মজা কী যে আনন্দ তা আরাফ কি কখনো বুঝবে? সবুজ এখানে আসার পর থেকে বাথরুমে গোসল করছে। এখানে এভাবে গোসল করে মনে হচ্ছে তার যে গা ভিজছে না। সে গোসল করছে এমনটাই মনে হচ্ছে না।
ঢাকায় আসার সময় সবুজের মনে খুব আনন্দ ছিল। চলে আসার সময় ওর বাবা-মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। বলেছিল, ‘বাজান সাবধানে থাহিস’। সবুজ তখন হাসি মুখেই বলেছিল, ‘তোমরা কোনু চিন্তা কইর না। ঢাহায় কত আনন্দ কত মজা। আমি খুব বালা থাকবাম মা। আমার লাইগ্যা ভাইবো না। তোমরা ভালা থাইক্কো মা।’
জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকে সবুজ। দুচোখে ভেসে ওঠে ওর গ্রামের দৃশ্য। আজাদ ছালাম দুলাল ওরা নদীতে সাঁতার কাটছে। সবুজকে ডাকছে, আয় নেমে পড় সবুজ। সাঁতরে আমরা ওপারে যাবো। সবুজের মা সবুজকে ডাকছে, কই গেলিরে সবুজ....।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ