সত্যবাদী কৃষক    -তমসুর হোসেন

সত্যবাদী কৃষক -তমসুর হোসেন

গল্প মার্চ ২০১৬

এক দাঁড়কাক একটি মোহর কুড়িয়ে পেল। সে মোহরটি কৃষকের ঘরের চালে লুকিয়ে রাখল। প্রতিদিন এসে সে মোহরটি বের করে ঠোঁট দিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। কাকেরা কোথাও কিছু রাখলে তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। কিন্তু দাঁড়কাক মোহরের কথা ভুলে যায় না। সে বুঝতে পারে এটি সাধারণ জিনিস নয়। সে ভাবে এটি তার জীবনে অনেক উপকারে লাগবে। পশ্চিমের আমুলে দাঁড়কাকের বন্ধু বাস করে। হুট করে সে তার বাড়িতে বেড়াতে আসে। বন্ধুকে নিয়ে সে নানান জায়গায় বেড়াতে যায়। তার গ্রাম মুরলি ছেড়ে সে যায় অতি পরিচ্ছন্ন শহর সামিরায়। সেখানে পরিত্যক্ত দালানের কার্নিশে গদি পেতে আরামের ব্যবস্থা করে। তারপর দোকান থেকে খাবার এনে মজা করে খায়। আর মনের আনন্দে মনোরম জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। শহরের বিভিন্ন স্থানের সৌন্দর্য দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। এখানে খাবারের কোন অভাব নেই। হোটেলের মালিকরা কাকদের সামনে খাবার ছড়িয়ে দেয়। তারা ওদের ক্ষতি হতে দেয় না। শহরের বাসিন্দারাও কাকের ক্ষতি করে না। তারা মনে করে যে শহরে কাক না থাকলে মানুষের জীবনে বিপদ নেমে আসে। দাঁড়কাকের নাম বিবিক্ত আর তার বন্ধুর নাম নিমিত্ত। বিবিক্ত বলল,
‘বন্ধ,ু কেমন লাগল সামিরা?’
‘অপূর্ব! এমন শহর আমি দেখিনি।’
‘ভাবছি মুরলি ছেড়ে সামিরায় আসব। এখানে কত সুবিধা।’
‘আমিও ভাবছি একটা কথা।’
‘কী কথা বন্ধু। আমাকে খুলে বল।’
‘এমন শহরে বাস করলে বাচ্চারা শান্তিতে থাকবে। পশ্চিমে শীত খুব বেশি।’
‘তাহলে দেরি করছ কেন? ভাবী আর বাচ্চাদের জলদি নিয়ে আস।’
‘দেশে ফিরে তোমার ভাবীকে সব বলব। ও রাজি হলে চলে আসব।’

সামিরা থেকে বাড়ি ফেরে বিবিক্ত। বন্ধুকে তাগাদা দিতে থাকে সামিরায় আসার জন্য। তার মন শহরে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠে। গাছপালা সমৃদ্ধ শীতল পরিবেশে চলা ফেরায় কত স্বাচ্ছন্দ্য। খাবারের কত প্রাচুর্য। সেখানকার বাসিন্দারা কাকের দিকে একটা ঢিলও ছোড়ে না। উঁচু গাছে বাসা বেঁধে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে সে হেসে খেলে দিন কাটাতে পারবে। কোন মোহর ব্যবসায়ীর কাছে মোহরটি বিক্রি করতে পারলে সে হবে বিত্তবান কাক। তার স্বগোত্রীয়রা পশমের যোগ্যও হতে পারবে না। বন্ধুকে নিয়ে সে একটা দোকানও খুলতে পারে। মোহরের কথা মনে হতেই সে কৃষকের বাড়ি যায়। সে ঠোঁট দিয়ে সাবধানে মোহরটি বের করে চোখ ভরে দেখে। সামিরার জীবনধারা পরখ করে নিমিত্তেরও মন সেখানে আসবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু তার স্ত্রী কুঞ্জিতা যদি আমুল ছেড়ে সামিরায় না আসতে চায়। সে জন্য সে দেশে ফেরার সময় বন্ধুকে সাথে নেয় যাতে সে কুঞ্জিতাকে ভালো করে বুঝাতে পারে।

আমুলে তখন শীত জেঁকে বসেছে। শীতের জন্য সেখানকার লোকেরা ঘরের দরজা বন্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে সময় কাটায়। বন্ধুদের বাড়িতে এসে দাঁড়কাক বিবিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়ল। কারণ সে ঠান্ডা একটুও সহ্য করতে পারে না। গাছের ডালে নিমিত্তের বাসাটি বরফের আস্তরণে ঢেকে যায়। তখন নিমিত্ত পরিবার নিয়ে পাহাড়ের গুহায় চলে যায়। শীতের তীব্রতার জন্য অসুস্থ শরীরে দেশের উদ্দেশে যাত্রাও করতে পারে না। নিমিত্ত যে গুহায় আশ্রয় নেয়, তার চারপাশে কোনো খাদ্য এবং পানীয়ের ব্যবস্থা নেই। যার কারণে তারা খুবই কষ্টে সঙ্কীর্ণ গুহার ভেতরে দিনাতিপাত করতে থাকে। নিমিত্ত এবং তার স্ত্রী বিবিক্তের সেবাযতেœর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা তীব্র শীত উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হয়ে খাদ্য এবং ওষুধ সংগ্রহ করে এনে বিবিক্তকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করে। বন্ধু এবং তার পতœীর কষ্ট দেখে বিবিক্ত খুব ব্যথিত হয়। সে তাদেরকে এই শীতে বাইরে বের হতে নিষেধ করে।
‘তোমরা করছটা কী! এই ঠান্ডায় বের হলে অসুখ করবে।’ বিবিক্ত বলে।
‘তুমি ভেবো না বন্ধু। ঠান্ডা কোন ক্ষতি করবে না আমাদের।’
‘ক্ষতি করবে না মানে। বড় কোন অসুখ হলে কেমন হবে তখন।’
‘আপনি একটুও চিন্তা করবেন না মেজবান। আমরা জলদি চলে আসব।’ নিমিত্তির স্ত্রী বলে।

পাটির বিছানায় শুয়ে বিবিক্ত ভাবে শীতটা কমলেই হয়। বন্ধুকে নিয়ে সে খুব তাড়াতাড়ি এদেশ ছেড়ে নিজ দেশে চলে যাবে। তারপর কৃষকের ঘরের চাল থেকে মোহর খুঁজে নিয়ে সামিরায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করবে। সামিরায় যা সুন্দর পরিবেশ দুই বন্ধুতে কারবার করে অনেক বড়লোক হবে। বন্ধুর স্ত্রী সুখনকে সে সব কথা বুঝিয়ে বলে। এখানে তো তারা অনেক কষ্টে দিন কাটায়। আর ওখানে দোকানের মালিকরা কাককে না খাওয়ালে নিজে পানি পর্যন্ত মুখে দেয় না। আর একটা কথা হলো ওখানে কাকরা রীতিমত দোকান দিয়ে ব্যবসা করতে পারে।
‘আপনি যা বলেন ভাবী এখানে আর থাকা চলবে না। এত শীতে কি বাস করা সম্ভব।’
‘বাপ-দাদার বসত ছেড়ে অন্যখানে যাওয়াটা কি ভালো হবে? ’
‘ভালো হবে না মানে! বলছেন কী? গিয়ে দেখুন না। বড়লোক হতে ক’দিন লাগে।’
‘দুই বেলা খাবার জোটে না আবার বড়লোক।’
‘ভাবী, ওটা কথার কথা বললাম। আসলে সামিরার পরিবেশ খুব ভালো।’

শীত কমে যেতে অনেক সময় লেগে গেল। এর মধ্যে বিবিক্ত বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল। একজন ওঝা ডেকে এনে নিমিত্ত তার জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করল। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল সে। শীত কেটে গেলে আমুলের আকাশে রোদ দেখা দিলো। রোদের তেজে পথঘাট থেকে কুয়াশা কেটে যেতে লাগল। গাছেরা রোদের উষ্ণতা পেয়ে নবীন কিশলয়ে সজ্জিত হতে লাগল। দাঁড়কাক গুহায় মুখে বসে প্রতিদিন রোদের কিরণ গায়ে মাখে। বন্ধু তাকে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল থেকে প্রজাপতি এবং পাকা পাকা বনডুমুর এনে খাওয়ায়। বন্ধুর আতিথ্যে খুবই তৃপ্ত হয় বিবিক্ত। বন হোগলার ফুলের রসে ঠোঁট ডুবিয়ে সে বন্ধুকে বলে,
‘নিমিত্ত, কী ভাবলে?’
‘কোন বিষয়ে বলছ?’
‘বারে ভুলে গেলে। সামিরায় ব্যবসা করার কথা কী ভাবলে।’
‘বিষয়টা নিয়ে বেশ ভেবেছি। কিন্তু তোমার ভাবী একদম শুনতে চায় না।’
‘ওনার কী সমস্যা?’
‘এখানে ওর সবাই আছে। বিপদ আপদে দেখা হয়।’
‘ভাবলাম তোমাকে নিয়ে সামিরায় গিয়ে দোকান দেবো। নিমিত্ত বিষয়টা ভেবে দেখ।’
‘ঠিক আছে। তবে এখন বোধ হয় হবে না। লোকজনের কাছে পাওনা আছে। বিষয়সম্পত্তির ঝামেলা। দেখি কী করা যায়।’
‘আমি তো থাকতে পারছি না। কালই চলে যাবো। তুমি ঝটপট সব সেরে নাও।’
‘কালই যাবে মানে? তোমার শরীর এখনও খারাপ। আগে সেরে ওঠো।’

বিবিক্ত আর দেরি করতে চায় না। মোহরের কথা ভেবে তার মনটা বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটা পুরনো গাছের কোটরে সে যদি মোহরটা লুকিয়ে রাখত। তাহলে তার এত দুশ্চিন্তা হতো না। শীতকালে কৃষকরা তাদের ঘর মেরামত করে। সে যে কৃষকের চালে মোহর লুকিয়ে রেখেছে সে যদি ঘর মেরামত করে থাকে তাহলে হয়েছে। এ জন্মে তাকে আর মোহর ফিরে পেতে হবে না। নিমিত্ত যত জোর করতে লাগল বিবিক্ত ততই বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। অবশেষে নিমিত্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য তৈরি হলো। একদিন সুন্দর সকাল দেখে দুই বন্ধু মুরলীর দিকে যাত্রা শুরু করল। দুর্বল হওয়ার কারণে বিবিক্ত ঠিকমত উড়তে পারে না। বিবিক্ত সাথে খাবার এবং পানীয় নিয়ে এসেছে। বন্ধুকে বিশ্রাম, খাদ্য এবং সাহসের মাধ্যমে উজ্জীবিত করে বাড়িতে পৌঁছে দেয় নিমিত্ত।
সন্ধ্যার সময় বাড়ি পৌঁছে বিবিক্ত বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সারারাত তার ঘুম হয় না। মোহর না পেলে সামিরায় দোকান দেয়া হবে না। বন্ধুকে সে কথা দিয়েছে। আহা! সামিরা কত সুন্দর শহর। বিছানায় সে শুধু এপাশ ওপাশ করতে থাকে। তা দেখে তার স্ত্রী তুলশী বলে,
‘বেশ তো বন্ধুর বাড়িতে থেকে এলে। ঘুমাচ্ছ না কেন? ওদের কথা মনে পড়ছে বুঝি?’
‘ওখানে আমার অসুখ করেছিল। তাই দেরি হয়েছে। তুমি একবার হীরের খোঁজ করেছিলে?’
‘কৃষক ঘরের চাল বদলে দিয়েছে।’
‘বল কী! তুমি কিছু বলনি?’
‘আমি কী বলব? আমাকে পাত্তা দেবে?’
‘পাত্তা দেবে না মানে? তাই বলে নিজের জিনিসের কথা বলতে হবে না?’
‘তুমি গিয়ে বল। বন্ধুর বাড়ি যেয়ে ফেরার নাম নেই।’

সকালে কৃষকের বাড়িতে যেয়ে মাথা ঘুরে যায় বিবিক্তের। পুরনো চাল বদলে কৃষক সেখানে নতুন চাল তৈরি করেছে। মন খারাপ করে একটা গাছের ডালে বসে থাকে সে। কৃষক মনে হয় বাড়িতে নেই। থাকলে তার গলার আওয়াজ পাওয়া যেত। বাজারে যেয়ে টুকরি ভরে ফল নিয়ে আসে সে। তুলশীকে বলে সে যেন কৃষকের সাথে সম্মান সহকারে কথা বলে। গাছের ডালে বসে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা। মসজিদে নামাজ পড়ে প্রসন্ন মনে বাড়ি ফেরে কৃষক। এমন সময় তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কাক দম্পতি। তারা কৃষককে ফলের টুকরি দিয়ে আদবের সাথে কথা বলে,
‘আপনার চালে একটা মোহর রেখেছি। আপনি ঘরটা নতুন করেছেন।’
‘মোহরের কথা আমি কিছুই জানি না। মজুর লাগিয়ে ঘর সারিয়েছি। তারা তো কিছু বলেনি।’
‘তাহলে আমাদের কী হবে? ওটা আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয়।’
‘আমাকে আগে বলতে পারতে। এখন আমি কী করতে পারব। মজুররা কি স্বীকার করবে?’
‘মজুরের নাম বললে আমরা খোঁজ করব। পরে আপনি ব্যবস্থা নেবেন।’

কৃষকের কাছে মজুরের নাম জেনে নিয়ে কাক দম্পতি তাদের বাড়িতে দিনরাত অনুসন্ধান করতে লাগল। কৃষকও লোক লাগিয়ে মোহরের খোঁজ করতে লাগল। একদিন কৃষক দেখল তার বাড়ির পেছনের বাগানে মোহরটা পড়ে আছে। মোহর পেয়ে কাককে ডেকে পাঠাল কৃষক। কাকেরা এল দলবল সহকারে আনন্দিত মনে। বিবিক্তকে মোহরটা দিয়ে দিলো কৃষক। খুব আনন্দ হলো সেদিন। নানা জায়গা থেকে দামি দামি জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে কাকেরা কৃষকের বাড়িঘর ভরে দিলো। সবার সামনে কৃষক বিবিক্তকে নিজের ধর্মপুত্র বলে মেনে নিলো। একটা পরিপাটি ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। সামিরায় গিয়ে ব্যবসা করার আর কোনো প্রয়োজন থাকল না তার।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ