শৈশবে ঈদের স্মৃতি- মুহম্মদ মতিউর রহমান

শৈশবে ঈদের স্মৃতি- মুহম্মদ মতিউর রহমান

স্মৃতিকথা মে ২০২০

আমার গ্রামের নাম চর বেলতৈল। ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা, সবুজ-শ্যামলে ঘেরা একটি গ্রাম। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার অন্তর্গত। বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রামের মধ্যে এটিও একটি। আলাদা তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। বাংলাদেশের সবগুলো গ্রামই তো সুন্দর, সবুজ-শ্যামলে অপরূপ, মধুময়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এ গ্রামই আমার পৈতৃক নিবাস। শিশুকাল থেকে এ গ্রামের ছায়া-ঢাকা, খাল-নালাবেষ্টিত মায়াময় মনোরম পরিবেশে আমি বেড়ে উঠেছি। তাই আমার গ্রামটি আমার কাছে অনন্য। এ গ্রামেই কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের এক স্মৃতিময়, মধুর আনন্দঘন মুখর অধ্যায়। আজ প্রৌঢ়ত্বের উপক‚লে দাঁড়িয়ে মনের দুয়ার খুলে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের মধুময় স্মৃতিরা এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। সেই সাথে মনে পড়ে আমার ছোটবেলার আনন্দময় খেলাঘর মাতৃস্নেহের মতই মমতাময়ী ঘন-নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন চর বেলতৈল গ্রাম। শীতের সকালে সোনালি রোদ্দুরের গায়ে ঠেস্ দিয়ে দুধ-পিঠা খাওয়ার সে হরিণ-চপল দিনগুলোর স্মৃতি এখনো আমার অলস মুহূর্তে মনের অলিন্দে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়, তখন প্রাণে তারুণ্যের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পুরনো স্মৃতির নিবিড় অরণ্যে হারিয়ে যায় মন। কিছুক্ষণের জন্য আমি বিহŸল হয়ে পড়ি, আনন্দ-বিষাদের এক মিশ্র অনুভূতিতে আমি চঞ্চলিত হই। অতীত জীবনের অনেক স্মৃতির ভারে আমি আচ্ছন্ন, ভারাবনত হয়ে পড়ি।
চর বেলতৈল থেকে তিন মাইল দূরে চর নারিনা গ্রামে আমার নানার বাড়ি। করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত চর নারিনা গ্রাম। নদী-ভাঙনে গ্রামের অবস্থান বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে নানার বাড়ি কখনো নদীর এপারে আবার কখনো ওপারে স্থানান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে নদীর দক্ষিণ পাড়ে নানার বাড়ি অবস্থিত। ১৯৫০ সালের দিকে নদীভাঙনের ফলে নানার বাড়ি উত্তর পাড় থেকে দক্ষিণ পাড়ে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৩৭ সালে আমার যখন জন্ম হয় তখন নানার বাড়ি ছিল নদীর উত্তর পাড়ে। ছোটবেলায় এ নদীতে কত যে ডুব-সাঁতার খেলেছি তার ইয়ত্তা নেই। নদীতে অনেক সময় মাছ ধরেছি। নদীর পাড়ে পানির নিচে গর্তে হাত ঢুকিয়ে বেলে মাছ ধরেছি। নতুন জোয়ারের পানিতে নদীর দু’ক‚ল যখন প্লাবিত হতো, তখন স্রোতের উল্টো দিকে গামছা পেতে মাছ ধরেছি, অল্প পানিতে বালু মাটির ওপর হেঁটে বেড়ানো চিংড়ি মাছ হাতিয়ে খালই ভর্তি করেছি।
বর্ষা শেষে নদীর দু’ক‚ল যখন ধূসর বালুতে ফকফক করতো, তখন সে বিস্তৃত বালুচরে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দলবেঁধে গোল্লাছুট, কানামাছি, ফুটবল, ভলিবল ইত্যাদি নানাজাতীয় খেলায় পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি মলিন মুহূর্তগুলোকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছি। ছোটবেলার সে হাসি-খেলার দিনগুলো কত যে আনন্দময় ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। নিজের বাড়ি আর নানার বাড়ির মধ্যে আমার কোনো পার্থক্য ছিল না। ছোটবেলায় মায়ের সাথে আমরা এগারো ভাই-বোন একসঙ্গে নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। প্রাইমারি পাসের পর (তখন প্রাইমারি স্কুল ছিল চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত) নানার বাড়িতে থেকেই আমি নারিনা মাইনর স্কুলে (পঞ্চম থেকে অষ্টম পর্যন্ত) পড়াশুনা করেছি। স্কুলের দাপুটে হেড মাস্টার ছিলেন আমার মামা হাফিজুর রহমান (মুক্তিযোদ্ধা)। নানা-নানীর আদরে আমি তখন স্বচ্ছন্দে সেখানে নিজের বাড়ির মতোই থেকেছি। মামা-মামীরা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। নানা-নানীর বড় নাতি হিসেবে আমার আদর-যতœ সবার কাছে একটু বেশিই ছিল। নানা সবসময় আমাকে কাছে কাছে রাখতেন। অনেক গল্প শুনাতেন। পীর-আউলিয়া-দরবেশ ও ইসলামের নানা কাহিনী ছিল তার গল্পের প্রধান উপজীব্য। মা আর নানীর আদরের মধ্যে কখনো কোনো পার্থক্য উপলব্ধি করিনি।
আমার গ্রামের দু’টি প্রধান গৌরবময় ঐতিহ্য। প্রথমটি হলো বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মুসলিম কথাশিল্পী মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত এ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১৮৬০ সালে। তাঁর নামে গ্রামের নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা আছে। দ্বিতীয়টি হলো আমার দাদা মুনশী ওয়াহেদ আলী পণ্ডিত ১৮৯২ সালে এ গ্রামে ‘খাস চর বেলতৈল বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা কাল থেকে তিনি প্রধান শিক্ষক এবং আমার দাদী মোসাম্মাৎ রমিছা খাতুন দীর্ঘ ৬০ বছর কাল শিক্ষকতা করে নারী শিক্ষা প্রসারে অনন্য অবদান রাখেন। নারী জাগরণের অগ্রদূতী হিসেবে পরিচিত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার ১৭ বছর পূর্বে একটি অজপাড়াগাঁয়ে আমার দাদা এবং দাদী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গ্রামের প্রতিটি মেয়েকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করে তোলেন। ব্রিটিশ আমলে আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন এমএ মজিদের লেখা ‘পাবনা জেলার সংক্ষিপ্ত ভ‚গোল’-এ পড়েছি- “চর বেলতৈল গ্রাম নারী শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ।” তা ছাড়া, শৈশব থেকেই লোকমুখে একটি প্রচলিত প্রবাদ শুনে আসছি- “যদি শিক্ষিতা কনে পেতে চাও, চর বেলতৈল গ্রামে চলে যাও।”
১৯৩০ সালে বালিকা বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আমার আব্বা আবু মুহম্মদ গোলাম রব্বানী ‘খাস চর বেলতৈল বালক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করে তিনি সেখানে হেডমাস্টার নিযুক্ত হন। আমি সে স্কুলেই লেখাপড়া করেছি। আমার মতো গ্রামের সব ছেলেই সেখানে লেখাপড়া করেছে। ১৯৫২ সালে আমার দাদা এবং দাদী উভয়ে একত্রে অবসর গ্রহণ করলে বালক ও বালিকা দু’টি বিদ্যালয় একীভ‚ত হয় এবং আমার আব্বা তার প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। আমার আব্বার অবসর গ্রহণের পর আমার মেজো ভাই আব্দুর রাজ্জাক ফেরদৌসী প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। শিক্ষার আলোকে আলোকিত একটি গ্রামে শিক্ষার হার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। গ্রামে শতাধিক ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষক ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পদে নিযুক্ত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন। গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। বর্তমানে এ গ্রামে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি দাখিল মাদরাসা, একটি হাফিজিয়া ফোরকানিয়া মাদরাসা, চারটি পাকা মসজিদ, দুটি খেলার মাঠ, একটি সরকারি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি প্রবীণ নিবাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
চর বেলতৈল গ্রামের উত্তর পাশে কাঁটাখালি বিলের ধারে বিশাল ঈদগাহ্ ময়দান। পার্শ্ববর্তী সাত গাঁয়ের লোক বছরে দুই ঈদের নামাজ এখানে একসঙ্গে আদায় করেন। নামাজ শুরুর অনেক আগে থেকে বক্তৃতা শুরু হয়। এ মাঠে বিভিন্ন সময় ঈদের জামাতে বক্তৃতা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক, বাংলা একাডেমির প্রথম স্পেশাল অফিসার সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহসহ এলাকার অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে যখনই বাড়িতে ঈদ করতে গেছি, তখনি এ মাঠে ঈদের জামাতে আমিও বক্তৃতা দিয়েছি। নামাজের পর সকলের সাথে কোলাকুলি করেছি। নামাজ শেষে গ্রামের শিক্ষিত যুবকেরা দলবেঁধে গ্রামের পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে পোলাও, কোর্মা, খিচুড়ি, ফিরনি খেতাম। আমাদের গ্রামে কোন অমুসলিম বসবাস করে না। তবে ঈদের দিন বিকাল বেলা গ্রামের মাঠে নানারকমের খেলাধুলা ও শিশুদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হতো, সেখানে পার্শ্ববর্তী গ্রামের অনেক হিন্দু যুবক এসে অংশগ্রহণ করতো। বড়দের সালাম, সমবয়সীদের শুভেচ্ছা আর ছোটদের আদর করে, হৈচৈ করে কাটত ঈদের সারাটা দিন। সারা গ্রামে তখন ঈদের উৎসব। সে উৎসবে ধনী-গরিব সকলে শরিক হতো। কত আনন্দমুখর পরিবেশে সে ঈদের দিনগুলো সকলে মিলে একসাথে উদ্যাপন করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখন আর বাড়িতে ঈদ করার সুযোগই হয় না।
শৈশবে দেখেছি, গ্রামের শিক্ষিত লোকজন যারা বিভিন্ন স্থানে চাকরি-বাকরি করতেন, ঈদের ছুটিতে তারা বাড়ি আসতেন। গ্রামের যেসব ছাত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতো, তারাও ঈদের ছুটিতে সকলে বাড়ি আসতো। ঐ সময় কয়েকদিন পর্যন্ত গ্রামে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হতো। খেলাধুলা, নাটক, বিভিন্ন সভা-সমিতি-অনুষ্ঠান ইত্যাদি কর্মসূচি থাকতো। ছাত্রদের জন্য বিশেষ ধরনের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হতো। প্রায় প্রতিদিনই এ-বাড়ি-ও-বাড়ি নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হতো। আমাদের বাড়িতে ছিল ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বালিকা বিদ্যালয় আর আমাদের পাশের বাড়িতে ছিল বালক বিদ্যালয়। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল খেলার মাঠ। স্কুলে নানারূপ অনুষ্ঠানের আয়োজন আর মাঠে ছেলেমেয়েদের-বড়দের নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা। আমার আব্বা ছিলেন সব আয়োজনের মধ্যমণি। আমার চাচা কলেজে পড়তেন, গ্রামের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া সবাই এসে ভিড় করতো আমাদের বাড়িতে। ঈদ উপলক্ষে নানারকম উৎসবের আয়োজন হতো। আমার বয়স তখন খুবই কম, তবু বড়দের সাথে আমিও থাকতাম। বড়দের সকল অনুষ্ঠান প্রাণভরে উপভোগ করতাম এবং ছোটদের অনুষ্ঠানে নিজে অংশগ্রহণ করে অফুরন্ত আনন্দ পেতাম।
শৈশবে ঈদ, বিশেষত রোজার ঈদে সবচেয়ে বেশি মজা হতো। বাইরে যারা থাকতো, তারা প্রায় সকলেই এ সময় ছুটিতে বাড়ি আসতো। নতুন পোশাক, ভালো ভালো খাবার, মজার মজার অনুষ্ঠান, গ্রামের এবং বাইরে থাকা সকল মানুষের একত্র সমাবেশে এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হতো। খাবার মধ্যে পোলাও, বিরিয়ানি, ফিরনি, সেমাই, খিচুড়ি, গোশত, পরোটা, দই, নানারকম পিঠা ইত্যাদি প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি হতো। যারা গরিব, তারাও ধনীর ঘরের নানা উন্নতমানের খাবারের ভাগ পেতো ঈদের দিন। ঈদ ছিল ধনী-গরিব সকলের জন্য। ইসলামের সাম্য, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন ফুটে উঠতো ঈদের দিন। গ্রামে তখন টিভি ছিল না। রেডিও ট্রানজিস্টর কদাচিৎ চোখে পড়তো। তবে তখন গ্রামোফোনের চল ছিল। কোথাও কোন বাড়িতে গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজলে সারা গ্রামের লোকজন সেখানে এসে ভিড় করতো। ঈদের সময় এরকম গ্রামোফোন বা ‘কলের গানের’ ব্যবস্থা হতো অনেক সময়। কলের গানে সাধারণত কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে শুনে গ্রামের মানুষ উদ্দীপ্ত-উজ্জীবিত হতো। আমার আব্বাও গান লিখতেন, গাইতেন। ঈদের সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান লিখে এবং গেয়ে সকলকে মুগ্ধ করতেন। আমি ছোটবেলা থেকেই আমার আব্বার কণ্ঠে তাঁর রচিত এবং নজরুল ইসলামের গান শুনেছি। নজরুলের প্রতি তখন থেকেই আমার অগাধ শ্রদ্ধা।
শৈশবে ঈদের দিন নানারকম মেলার আয়োজন হতো। সাধারণত ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নানারকম আকর্ষণীয় পণ্য, খাদ্য ও মিষ্টান্ন মেলায় বেচাকেনা হতো। যাদের পকেটে পয়সা থাকতো, তারা সেগুলো কিনতো। কিন্তু সেখানে অনেকের পকেটেই পয়সা থাকতো না। বিশেষত ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে পয়সা থাকতো না। তবে ঈদের দিন বাবা-মা বা বড়রা ছোটদেরকে অনেক সময় দু-চার পয়সা বা দু-চার আনা দিতেন। তা দিয়ে অনেকে শখের জিনিস কেনাকাটা করতো। ঈদের দিনগুলো ছিল খুব সহজ-সরল কিন্তু আনন্দ-উত্তেজনায় মুখর।
শৈশবে ঈদ উপলক্ষে যেসব অনুষ্ঠান হতো, তা ছিল সবই নির্মল আনন্দায়ক। এখন যেমন ঈদের সময় নানারকম আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা হয়, তখন এসব ছিল না। এখন ঈদের দিন নানারকম নাচ-গান, নাটক-সিনেমা, রেডিও-টিভির বিবিধ অনুষ্ঠান, আনন্দমেলা, এমনকি জুয়া ও নানারকম অনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় এবং সেসব অনুষ্ঠানে যোগদান করে মানুষ ঈদের পবিত্র অনুভ‚তি জলাঞ্জলি দেয়। তখন এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে দেখিনি। ঈদের দিন নানারকম নির্মল আনন্দানুষ্ঠানে প্রাণের চাঞ্চল্যে ভরে উঠতো গ্রামের ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর।
রোজার ঈদ হয় একমাস রোজা পালনের পর। রোজা পালনের উদ্দেশ্য প্রবৃত্তির দমন। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মহান ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভই রোজা পালনের উদ্দেশ্য। একমাস রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের পয়লা তারিখে ঈদুল-ফিতর উদ্যাপিত হয়। ঈদের জামাতে সকলে মিলে দু-রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা হয়। তারপর মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করে ইসলাম তার যে সমাধান দিয়েছে, সে সম্পর্কে মুসল্লিদের অবহিত করা হয়। সবশেষে মহান আল্লাহর কাছে সমবেতভাবে নিজের, স্বজন-পরিজনদের গুনাহখাতা মাফ চেয়ে দেশের তথা বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়। এরপর পরস্পর কোলাকুলি করে উদার ভ্রাতৃত্বের পরিচয় প্রদান করে। ঘরে ঘরে উন্নত খানা তৈরি হয়। ঈদের দিন সকলে মিলে সে খানা খায়। গরিব, মিসকিন কেউ অভুক্ত থাকে না ঈদের দিন। ঈদ হলো সর্বজনীন উৎসব। মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহানুভ‚তি প্রকাশের দিন হলো ঈদের দিন। সকল হিংসা-বিদ্বেষ, নীচুতা-সংকীর্ণতা, ক্রোধ-অহমিকা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে উদার মানবতা প্রকাশের দিন ঈদের দিন। সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা সকলে আল্লাহর বান্দা। তাঁর নির্দেশ পালনেই মানবজীবনের সার্থকতা। জীবন ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহর নির্দেশ পালনকারীরাই কেবল পরকালীন অনন্ত জীবনে জান্নাতের অপরিমেয় সুখ-শান্তি উপভোগ করবে। ঈদের দিনের এটাই শিক্ষা।
তাই ঈদের দিনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ভালো জামা-কাপড় পরা, উত্তম খানাপিনা খাওয়া ভালো। কিন্তু এ দিনে শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও এ ধরনের ব্যবস্থা করা উত্তম। এ জন্য ইসলামে সদ্কায়ে ফিতর, জাকাত, সদ্কা ইত্যাদি প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে বিত্তহীনরাও ভালো জামা-কাপড়, খানাপিনার ব্যবস্থা করতে পারে। তা ছাড়া, ঈদের দিন প্রত্যেকের বাড়িতে যে খানাপিনার ব্যবস্থা হয়, তা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও গরিব-দুঃখী-মিসকিন সকলকে নিয়ে খাওয়া উত্তম। কেউ যেন নিজেকে দুঃখী-গরিব বা বঞ্চিত না ভাবে। এটাই হলো ঈদের প্রকৃত শিক্ষা। এ দিন কোনরূপ খারাপ বা অনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্পূর্ণ হারাম। অনেকে না জেনে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঈদের দিনের পবিত্রতা যাতে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সকলের সতর্ক থাকা কর্তব্য।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ