শিশু জাগরণে নজরুল
প্রবন্ধ নিবন্ধ নাসির হেলাল আগস্ট ২০২৩
কাজী নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। মাত্র একুশ বাইশ বছর বয়সে তিনি বিস্ময়কর কিছু কবিতা নিয়ে আবির্ভূত হন। যা বাঙালি পাঠককে রীতিমতো চমকে দেয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সমকালীন সকল কবি-সাহিত্যিকগণ তা বিস্ময়ের সাথে অবলোকন করেন। এ সময় তাঁর ‘শাত-ইল আরব’, ‘কোরবানী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কামাল পাশা’, ‘মোহররম’ প্রভৃতি সাড়াজাগানো কবিতাগুলো ছাপা হয়। এরপর ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে একরাতে রচনা করেন সেই বিস্ময়কর কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে পাঠক মহলে প্রচণ্ড হইচই পড়ে যায়। তরুণ কবি নজরুল ইসলাম বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কবিতাটি ছাপা হয় ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘সাপ্তাহিক বিজলী’ পত্রিকায়। বিপুল পাঠক চাহিদার কারণে পত্রিকাটি আরও দু’বার ছাপতে হয়। মোট ২৯০০০ কপি ছাপা হয়। সে সময়ের জন্য তা ছিল বিস্ময়কর।
এই বিস্ময়কর বা দানবীয় প্রতিভাধর কবি বড়ো, ছোটো, মুটে-মজুর, কামার-সুতার, কৃষক-শ্রমিক সবার জন্য লিখেছেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলের জন্য জাত-পাত ছাড়াই লিখেছেন। তিনি ছিলেন মানুষের কবি, মানবতার কবি। বিশ্বে তাঁর মতো উদার, বড়ো মনের কবির সংখ্যা হাতেগোনা। এতবড়ো, এত মহান যে কবি তিনি কিন্তু ছোটোদের জন্যও অনেক লিখেছেন। আমরা সবাই তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে জানি। অবাক বিষয় তিনি ছোটোদেরকেও বিদ্রোহের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি মনে করতেন, আজকে যারা শিশু আগামী দিনে তারা বড়ো হবে এবং তারাই দেশের হাল ধরবে, দেশের কর্ণধার হবে। অতএব তাদের গড়ে তুলতে হবে। তাই তিনি ছোটোদেরকে গড়ে তোলার জন্য রচনা করেছেন ছোটোদের উপযোগী প্রচুর কবিতা। তিনি লিখেছেন-
ফুলের বনে ফুল ফোটাবো অন্ধকারে আলো
সূয্যি মামা বলবে উঠে খোকন সোনা ভালো?
বলবো মামা, কথা কওয়ার নেইকো সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙবো ঘুমের দ্বার।
রবির আগে চলব আমি ঘুম ভাঙা গান গেয়ে
জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে। (সাতভাই চম্পা)
এখানে কবি ছোটোদেরকে সমস্ত ভালো কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। অন্ধকারসম অন্যায়কে দূরে ঠেলে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কথা বলেছেন। সূর্য যেমন আঁধার ঠেলে শুভসকালের সূচনা করে, তেমনি ছোটোরাও খারাপ কিছু না করে ভালো কাজ করবে। ছোটোদের এ কাজ দেখে অনেকেই তাকে বা তাদেরকে প্রশংসা করবে কিন্তু কাজ পাগল ছেলেরা তখন বলবে- এখন ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। তারা ভালো কাজের সন্ধানে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে- পাহাড়-পর্বত, নদী সাগর সবই তাদের পদানত হবে।
আর এ সব করতে গিয়ে অনেক বিপদ-আপদের সম্মুখীন তাদের হতে হবে। এমনকি মৃত্যুও সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। তাই কবি লিখেছেন-
‘বজ্র আলোকে মৃত্যুর সাথে হবে পরিচয়
জয় জীবনের জয়
শক্তিহীনের বক্ষে জাগাব শক্তির পরিচয়
জয় জীবনের জয়।’ (জয় জীবনের জয়)
‘জাগো প্রাণ অফুরান’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
‘দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান / গাহে আজি উদ্ধত গান।
লঙ্ঘি গিরিদরী /ঝঞ্ঝা-নূপুর পরি
ফেরে মন্থন করি অসীম বিমান। (জাগো প্রাণ অফুরান)
এ কবিতায়ও কবি ছোটোদেরকে সকল প্রকার বাধাবিঘœ অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘কিশোরের স্বপ্ন’ কবিতায় কবি বলছেন-
‘মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইরে যাওয়ার বেশে, / রইবো না আর আঁচল-ঢাকা গাড়ি-আঁকা দেশে। / মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইরে যাওয়ার বেশে।’ (কিশোরের স্বপ্ন)
এ কবিতায় বাঙালি মায়ের শাশ্বত চিত্র তুলে ধরেছেন কবি। বাঙালি মায়েরা তাদের সন্তানকে ছোটো ছোটো বলে আঁচল তলে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু কবি এর ঘোর বিরোধী। তিনি চান ছোটোরাও মায়ের আঁচল থেকে বেরিয়ে আসুক। তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক। চোখ মেলে দেখুক আল্লাহর সৃষ্টি সম্ভারকে, আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে।
ঐ একই কবিতায় কবি বলেছেন-
‘ম্যালেরিয়ায় ভুগব না মা,/ মরব না তোর কোলে,
ডাকতে তোরে দেব না মা,/ চাকরের মা বলে।’
বাঙালি মায়েরা সন্তানকে অনেক সময় বেশি আদর দিয়ে নষ্ট করে ফেলে। এমনকি ঐ অতিরিক্ত আদরের ফলে সন্তান আলস্যের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে সে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
‘প্রভাতী’ কবিতায় কবি জগতের সব খোকাখুকুদের ডেকে বলছেন-
‘ভোর হোলো/ দোর খোলো/ খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে/ জুঁই-শাখে/ ফুল-খুকী ছোট রে!
রবি মামা/ দেয় হামা/ গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান / গায় গান/ শোনো ঐ রামা হৈ! (প্রভাতী)
কবি নজরুল ইসলাম শিশুদেরকে আলসেমি না করে ভোরবেলা অর্থাৎ ফজরের ওয়াক্তেই ঘুম থেকে উঠে পড়ার জন্য তাকিদ দিয়েছেন। সকাল সকাল ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাছাড়া পড়াশোনা, অন্যান্য কাজগুলোকে সহজে করে ফেলা যায়। ঐ সময় রাতের আঁধার ভেদ করে যেন রাঙা জামা গায়ে রবি মামাও হাসতে থাকে।
‘জিজ্ঞাসা’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
‘রব না চক্ষু বুজি/ আমি ভাই দেখব খুঁজি
লুকানো কোথায় কুঁজি/ দুনিয়ার আজব খানায়।’ (জিজ্ঞাসা)
দুনিয়াকে দেখার, সৃষ্টি জগতের কোথায় কী আছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য কবি ছোটোদেরকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কবি আল্লাহর সৃষ্টির কোথায় কী গোপন আছে, লুকানো আছে তার চাবি খুঁজে বের করে তা দেখার জন্য বলেছেন। পবিত্র কুরআন মজিদেও আল্লাহ মানুষকে তাঁর সৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য নভোমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলকে দেখতে বলেছেন।
‘সকাল বেলার পাখি’ কবিতায় কবি যেন পুরোজাতিকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন-
‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে/ উঠবো আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে,/ উঠবো আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’/ মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি আলসে মেয়ে/ ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল, তাই বলে কি/সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা/ কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে মা গো/রাত পোহাবে তবে। (সকাল বেলার পাখি)
ছোটোদের জাগরণের জন্য, ছোটোদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য কবি নজরুল ইসলামের এই একটি কবিতাই যথেষ্ট। মা ও সন্তানের মধ্যে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কবি শিশুদের মনের দুয়ারে কড়া নেড়েছেন। ভোরবেলা যেমন পাখি কিচিরমিচির ডেকে প্রভাতের ঘোষণা করে, দিনের আগমনের বার্তা দেয়- ঠিক তেমনি কবিতার শিশুটি ভোরের মুয়াজ্জিন হতে চায়। মায়ের বারণ- ‘রাত এখনো শেষ হয়নি, অতএব ঘুমাও।’ মায়ের কথার উত্তরে শিশুটি বলছে, ‘তুমি একটা আলসে মেয়ে, তুমি ঘুমিয়ে থাক। এখন যদিও সকাল হয়নি, তবে সকাল হবেই। আর তা তোমার ছেলের জেগে ওঠার মধ্য দিয়েই।’ অসম্ভব সুন্দর বার্তা, জাগরণের বার্তা কবি এখানে দিয়েছেন। কবিতাটি শুধু শিশু জাগরণের জন্য নয়, বড়োদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
‘সংকল্প’ কবিতায় কবি বলেছেন-
‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’
শিশু-কিশোররাও অনেক চিন্তাভাবনা করে। বড়োরা তাদেরকে যতই ছোটো ভাবুক তারাও অনেক কিছু বোঝে। তাই তারা আর ঘরে বসে সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। তারা ঘুরেফিরে দেখতে চায়, কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কী ঘটছে। এমনকি-
‘পাতাল ফুঁড়ে নামবো নীচে
উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগৎ দেখবো আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ (সংকল্প)
শিশু-কিশোররা এমন অ্যাডভেঞ্চারমূলক চিন্তা করে যা অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়। উক্ত উদ্ধৃত লাইন দুটিতে কবি সেরকম কল্প ভাবনার উল্লেখ করেছেন। যা কবিতাটি রচনার একশো বছর পর তা বাস্তবের মুখোমুখি। আজ ডিজিটাল যুগে মোবাইলের কল্যাণে পুরো পৃথিবীই আমাদের হাতের মুঠোয়।
কাজী নজরুল ইসলাম যুগের তুলনায় চিন্তার দিক থেকে ছিলেন অনেক অনেক বেশি অগ্রগামী। সেজন্য তাঁর রচনাবলি শতবর্ষ পরেও পাঠক সাধারণকে পথের দিশা দিচ্ছে। তাঁর রচিত শিশু সাহিত্য আগামী দিনেও আমাদের শিশুদের পথ দেখাবে বলে আমার বিশ্বাস।
আরও পড়ুন...