শহরের টোকাই

শহরের টোকাই

গল্প নাহিদ জিবরান এপ্রিল ২০২৩

বাসা থেকে বের হয়ে মেইন রোড দিয়ে হাঁটছি! আশপাশে তাকাতেই চোখে পড়লো পথের ধারে কত মানুষের বসবাস। কিভাবে তারা দিন কাটায় কেউ কি খবর রাখে! 

হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুরের দিকে চলে গেছি। সেখানে যেয়ে চিন্তা করলাম একটু স্টেশনের দিকে যাই। খানিকক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ছেলে ডাস্টবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটির দিকে লক্ষ্য করলাম কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছে সে কিছু খুঁজছে! আমি ভাবতে লাগলাম সে হয়তো বোতল খুঁজছে! বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর আমি সেই ছেলেটির কাছে গেলাম। তাকে ডেকে বললাম তুমি কী খুঁজছো? ছেলেটি কিছু না বলে চুপ করে আছে। 

তার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। খুব সম্ভবত সে ক্ষুধার্ত। 

আমি তাকে বললাম তুমি কিছু খাবে! সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম তুমি কী খাবে, আস্তে করে বললো আপনি যা খাওয়ান। ছেলেটিকে নিয়ে গেলাম ভাতের হোটেলে। তার হাত দুটোর দিকে তাকালাম ধুলায় কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। আমি ছেলেটির হাত দুটো সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিলাম। হোটেলের লোকজন আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। 

ছেলেটিকে বললাম তোমার নাম কী। উত্তরে বললো রাজা! রাজার চেহারা দেখে উপায় নেই সে টোকাই। শ্যামলা বর্ণের চেহারা। চেহারাটি মায়াবী। বয়স আনুমানিক ১০ হবে। আমি তাকে বললাম, রাজা তুমি খাবারের অর্ডার দাও আমিও খাবো তোমার সাথে। এ কথা বলেই দু’জন হাসলাম। রাজা খাবারের অর্ডার দিতে দ্বিধাবোধ করলো বুঝতে পারলাম। আমি খাবারের অর্ডার দিলাম। রাজাকে প্রশ্ন করলাম তুমি এখানে কিভাবে এলে তোমার বাবা মা কোথায়। 

রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো তার জীবনে ঘটে যাওয়া কথাগুলো।

রাজা! 

নামের ভেতরই কেমন যেন একটা বড়লোক বড়লোক ভাব। যে কেউ শুনলে হয়তো ভাববে ভালো পরিবারের কোনো ছেলের নাম। 

কিন্তু না রাজা নামের ছেলেটি একজন টোকাই। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কাগজ কুড়ায়, বোতল কুড়ায়। 

সারাদিন পর যা পায় তাই দিয়ে রাতে একটা রুটি কিনে খায়। এমনকি কোনো কোনো দিন না খেয়েই থাকে। সাধারণত টোকাইদের জীবন যেমন হয় ওর জীবনও তার বিপরীত নয়। সারাদিন রাজার রাস্তার রোদ বৃষ্টিতে কাটে। রাতে সে একটু ঘুমাবে ভালোভাবে তারও উপায় নেই। কেননা মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই ওর। রেললাইনের ধারে না হয় ফুটপাথ ও বিছানা। সকালের কড়া রোদের ঝলকানি মাটিতে পড়ার আগেই যেন রাজার ঐ ছিপছিপে শরীরটা ঝলসে দেয়। ছিপছিপ হবেই বা না কেন, কোনো দিন একবেলা খাবার জোটে আবার কোনো দিন আধবেলাও জোটে না। মাঝে মাঝে তো পেটের জ্বালায় ডাস্টবিনের বাসি পচা খাবার খেতেও দুবার ভাবে না। খাবেই বা না কেন পেটের জ্বালায় তো লোক কত কিছু করে। চুরি, ডাকাতি এমনকি মানুষ পর্যন্ত মারে। আর রাজা তো পচা খাবার খায়। চুরির চেয়ে পচা খাবারই ভালো বলে মনে হয়। কী করবে এছাড়া তো উপায়ও নেই। 

অন্যান্য টোকাইরা যখন নেশা করা নিয়ে ব্যস্ত সেখানে রাজা সম্পূর্ণ আলাদা। নেশা করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে ছিনতাই করতে বলা হয়। এতে অসম্মতি জানালে রাজাকে মারধর করে। সমাজের কাছে টোকাই মানে সবার কাছে ঘৃণিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত। সবাই কথা শোনায়। কারো খাবারের দিকে চোখ গেলেই শুনতে হয় কটু কথা- রাক্ষসের মতো তাকিয়ে আছিস কেন? জীবনে চোখে দেখিসনি?

আবার অন্য দিক থেকে কেউ বলে উঠে ছোটলোক টোকাই এর বাচ্চা দেখবে কোথা থেকে। কারো কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। নোংরা জামা বলে। যেখানে পেটে দু’মুঠো ভাত জুটাতে পারে না সেখানে জামা-প্যান্ট কিনবে কোথা থেকে। অশ্রুভেজা চোখে রাজা তাকায় সবার দিকে।

শুধু তাকাতেই পারে কিছু বলতে আর পারে না। বলবে কী করে ও যে টোকাই। সবাই গাল মন্দ করে রাস্তার ছেলে বলে। বিশেষ করে টোকাই বলে। মাঝে মাঝে রাজা ভাবে এ কেমন জীবন দিয়েছে আল্লাহ। সেখানে মানুষের লাথি গুঁতা খেতে খেতে জীবন শেষ হয়ে যায়। মায়ের সাথে সেদিন সেও কেন ট্রেনে কাটা পড়লো না তাও ভাবে। সেদিন মরে গেলে হয়তো এই দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো জন্মের মতো। এতো কষ্টের মাঝেও সে হাসতে থাকে আর বলে- কী দেইখা মা আমার নাম রাজা রাখছিল। মায় বাঁইচা থাকলে আজ শুনবার পারতাম। আমার নাম রাজা রাখছিলো কেন। এইডা ঠিক আমি দেখতে এট্টু সাহেব গো মতো। 

এসব কথা বলে রাজা ভাত খেতে লাগলো! রাজার কথা শুনতে শুনতে আপনা আপনি অশ্রুশিক্ত হয়ে গেছি আমি। ওর কথাগুলো বাস্তবমুখী। ও যদি আমাদের মতো করে বেড়ে উঠতো তাহলে হয়তো ওর ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতো।  

আমি রাজাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে এলাম। বললাম, যখনই ক্ষুধা লাগবে আমাকে ফোন দিবে যেখানেই থাকি না কেন তোমার খাবারের ব্যবস্থা করে দিবো। আর হোটেলের ম্যানেজারকে রিকুয়েস্ট করে বললাম রাজা যখনই আসবে তাকে ফিরিয়ে দিবেন না। ম্যানেজারও আন্তরিকতার সাথে আমাকে বললেন ঠিক আছে ভাই আমার যতটুকু আছে আমি তাকে খাওয়াবো ইনশাআল্লাহ। 

এ কথা বলার পর রাজা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি তাকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম আর আল্লাহর কাছে রাজার জন্য বেশি বেশি দোয়া করলাম তাকে যেন ভালোভাবে রাখেন। আপনাদের চারপাশে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস- চাইলে আপনিও একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতেন পারেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ