লোভে পাপ পাপে মৃত্যু  -আহমদ আজহার

লোভে পাপ পাপে মৃত্যু -আহমদ আজহার

গল্প আগস্ট ২০১৮

সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না আমার।
কী যেন নেই। অথচ সবই আছে। বাবা-মায়ের আদর। বোনের ভালোবাসা। সব কিছুই পরিপূর্ণ ছিলো। কিন্তু কিছুতেই মনটাকে স্থির করতে পারছিলাম না।
কাজে মন বসতো না। বাইরে যেতে ইচ্ছে করতো না। আবার ঘরের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না। কী যে এক পীড়াদায়ক যন্ত্রণা ছিলো সেটা বুঝানোর মতো শক্তি আমার ছিলো না।
একদিন রাতে ভাবছি কী করা যায়। একদিনের জন্য কি কোথাও ঘুরে আসবো। আবার এটাও চিন্তা করছি হাতে তো অনেক কাজ। কাজ ফেলে কিভাবে যাই। আবার চিন্তা করছি একদিনের জন্যই তো। কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না। মোবাইলটি হাতে নিয়ে কতক্ষণ গেমস খেলতে লাগলাম। নাহ! সেটাও আর বেশিক্ষণ ভালো লাগছে না।
চিন্তা করতে করতে ফজরের আজান দিলো। আমি ওজু করে নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসার কোনো সম্ভাবনাই দেখছি না। দেরি না করে দরজায় তালা মেরে বাইরে বেরুলাম। হাঁটতেও ভালো লাগছে না।
সাথে কেউ থাকলে ভালো লাগতো। অন্তত কিছুক্ষণ কথা তো বলতে পারতাম। চট করে বন্ধুকে ফোন দিলাম। দেখি ফোনটা ধরে কি না। কিছুক্ষণ ট্রাই করার পর ফোনটি রিসিভ করলো। ঘুমন্ত অবস্থায় বললো কিরে এতো সকালে ফোন দিলি, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি। আমি বললাম না! একটু চুপ করে থাকলাম। সিয়াম বললো কী হয়েছে বন্ধু আমাকে বল! কোথায় তুই। আমি বললাম সি-ব্লকে আছি তুই কি আসতে পারবি। আমাকে সিয়াম বললো, তুই মাঠের সামনে থাক আমি আসছি।
নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। কারণ আমার ঘুম হয়নি তাই আমি বের হলাম। কিন্তু বন্ধুতো ঘুমিয়ে ছিলো কেন তাকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ ভাবনার মধ্যে থাকলাম। হাস্যকরও বটে! কোনো কিছু নিয়ে ভাবছি না। তারপরও কী যেন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি নিজেও তা উপলব্ধি করতে পারছি না। সিয়াম সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাকে ঝাঁকি দিয়ে বললো, কিরে বন্ধু তোর কী হয়েছে। এভাবে বসে আছিস কেন? আমার তখন হুঁশ ফিরলো। আমি বললাম না তেমন কিছু নয়। সারারাত ঘুমাতে পারিনি তো তাই আর কি!
সিয়াম বললো আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিস বসে থাকার জন্য। চল হাঁটি আর কথা বলি। আমি বললাম চল তাহলে। হাঁটতে হাঁটতে সিয়ামকে বললাম, আচ্ছা তোর দাদার বাড়ি কোথায় রে। সিয়াম একটু অবাক হয়ে বললো, এতদিন পর হঠাৎ এই কথা কেনরে বন্ধু? আমি বললাম না এমনি মনে হলোতো তাই বললাম। সিয়াম বললো বি-বাড়িয়ার শেষ মাথায়। অনেক সুন্দর জায়গা। আমি কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম আমাকে নিয়ে যাবি!
সিয়াম বললো সেখানে তো আমার কেউ থাকে না। আমি বললাম কেউ থাকে না এটা কি বললি আমাকে। সিয়াম বললো, এক চাচা থাকে সেখানে তাদের বাড়িতে যাওয়া যাবে। আমি বললাম ও সেতো ভালো তাহলে চল আজকে যাই।
সিয়াম একটু ভেবে বললো তাহলে আজকে রাতে যাই কি বলিস তুই। আমি আর কি বলবো মন তো চাচ্ছিল এখনই চলে যাই। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এ্যালোভেরার শরবত খেয়ে বাসায় চলে এলাম। মনটা কেমন যেনো একটু ভালো হয়ে গেল ফুরফুরা মেজাজ। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমও চলে এলো। আম্মু আমাকে ডাকছে সেই কখন থেকে। আমি ঘুম থেকে উঠছি না। ছোট বোন এসে আমাকে ডাকছে আমার কোনো হুঁশ নেই। না পেরে গায়ে পানি ঢেলে দিলো আর আমি লাফ মেরে উঠলাম। উঠে দেখি আমার সারা শরীর ভেজা। আম্মুকে বললাম কী ব্যাপার এতো ডাকছো কেন। সকালের নাশতা খেয়ে নাও। আমি বাইরে যাবো। আমি বললাম আচ্ছা নিচ্ছি। আম্মু আমাকে নাশতা দিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি হাতের টুকিটাকি কাজ সেরে নিলাম। বাসায় তখনও কিছু বলিনি। কী বা বলবো!
ভালো লাগছিলো না কিছুই। বের হওয়ার সময় বললাম সিয়ামের বাড়িতে যাচ্ছি দুই দিন থাকবো। আব্বুজান আর কিছুই না বলে বললেন টাকা আছে সাথে। আমি বললাম জি আছে। তারপর কাছে ডাক দিয়ে আরও কিছু টাকা দিয়ে দিলেন। সিয়ামের বাসায় গেলাম। সিয়ামের আম্মু আমাকে ভাত খেতে বললেন। আমি না বলা সত্ত্বেও জোর করে খাইয়ে দিলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সিয়ামকে বললাম চল এবার বাসা থেকে বের হই। সিয়াম বললো হ্যাঁ চল এবার বের হই। আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
শ্যামলী বাসে উঠলাম মতিঝিল থেকে। বাসের ভেতর অনেক গল্প করলাম। এক সময় ক্লান্তি চলে এলো। দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সুপারভাইজার আমাদের দুজনকেই ডাকছেন। চোখ মুছতে মুছতে বললাম কী হয়েছে ভাই। বললেন আপনাদের এখানে নামতে হবে। সিয়ামকে ডাক দিলাম। ও উঠে বলছে আমাদের ভুল হয়ে গেল আমরা অনেক সামনে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি করে বাস থেকে নামলাম। নেমে একটা অটো করে সিয়ামদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। তখন ধানের মৌসুম। অটো তে করে যাচ্ছি আর দু’পাশের মনোরম পরিবেশ দেখছি। খুবই ভালো লাগছে আমার। সিয়ামদের বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। রাজবাড়ীর মত দেখতে। অনেক পুরনো দালান বাড়িটা।
সিয়াম বললো কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? ভেতরে আয় আরও অনেক কিছুই দেখার বাকি আছে। ভেতরে ঢুকে দেখি অনেক বড় বড় রুম। ঢাকার বাড়িওয়ালারা তো মুরগির খোপ বানিয়ে রেখেছে। তাতেই মনে হতো কত বড় রুম। আর এটা দেখে তো মনে হচ্ছে ভেতরে ক্রিকেট খেলা যাবে। সিয়ামের কাছে আমার অনেক প্রশ্ন জমা হতে থাকলো। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা খেয়ে আমরা চলে গেলাম বাড়ির পেছনের দিকে।
যেতেই দেখি বড় একটা দীঘি। কী সুন্দর! আমি সিঁড়ি দিয়ে পানিতে নামবো এমন সময় সিয়াম আমাকে নামতে নিষেধ করলো। আমি পানিতে না নেমে তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা তোদের দীঘি, তাহলে আমি কেন নামবো না। সিয়াম মাথাটা নিচু করে বললো, চল আমবাগান আছে সেখানে যাই। কথা ঘুরিয়ে ফেললো। তখন আমি একটু একটু আঁচ করতে পারছি। ওর চাচা সিয়ামের কাছে এসে বলছে বাবা এতো দিন পর এলে কেন? প্রায়ই তো আসতে পারো। সিয়াম বললো চাচা পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকিতো তাই আশা হয় না। আমার বন্ধু আসতে চাইলো তো তাই সময় করে চলে এলাম। চাচা বললেন, তোমরা গল্প করো। আরো অনেক জায়গা আছে সিয়াম তোমার বন্ধুকে দেখাবে সব কিছুই, এই কথা বলে চলে গেলেন।
সিয়াম বললো চল সামনে পুকুর পাড় আছে সেখানে গিয়ে বসি। ওর কথামতো সেখানে গেলাম। গিয়ে বসতে না বসতে সিয়াম বললো আমার দাদার বাবা অনেক ধনী ছিলেন। তিনি মারা যাবার সময় আমার দাদাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দালান বাড়ি, দীঘি, আমবাগান, আড়াইশো বিঘা মাঠের জমি, পুকুর, বাজারে পঞ্চাশটি দোকান, আরোও কত কী! আমি শুনে অবাক হলাম। বললাম তাহলে তোদের অবস্থা তো আমাদের থেকে অনেক বেশি। সিয়াম ধমক দিয়ে বললো আমি কি বলছি আগে শোন তারপর কথা বলিস। আমি আবার ওর কথায় মনোযোগী হলাম।
সিয়ামের দাদা মারা যাবার সময় সকল সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের নামে দিয়ে যান। সেখান থেকেই শুরু হলো হিংসা, হানাহানি, ঝগড়া-বিবাদ। আমার বাবা শুধু পড়ালেখা করেছে। আর কেউ এর ধারের কাছে যায়নি। এতো অর্থসম্পদ দেখে কেউ আর লোভ সামলাতে পারেনি। রাজার হালে থেকেছে খেয়েছে। কেউ চিন্তাও করেনি যে সামনের দিনগুলোতে কিভাবে চলবে। সম্পদ ভাগাভাগি শুরু করে দিলো। আমার বাবা বাড়িতে থাকতো না দেখে বাবার ভাগ না দিয়েই চাচা, ফুফুরা ভাগবাটোয়ারা করে নিলো। এভাবে চলতে থাকলো দিন।
চাচারা বিলাসিতা করতে গিয়ে জমি, দোকান বিক্রি করে খেতে লাগলো। যেহেতু এত জমিজমা আছে সেহেতু কাজকর্ম না করলেও চলবে। এরকম ধারণা ছিলো তাদের। যে যার জমি ইচ্ছেমতো বিক্রি করছে আর খাচ্ছে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে। এক সময় দেখলো বাড়ি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার বাবা বাধা দিলেন। বললেন বাড়িটা অন্তত তোমরা রাখ। এটা বাপ-দাদার ভিটেমাটি। কে শুনে কার কথা! বিক্রি করে দিলো। এভাবে চললো আরো কিছুদিন।
সিয়াম কথা বলছে আর আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে আছি। এখন এক চাচা এখানে আছে। আর ফুফুরা জমি বিক্রি করে স্বামীর সাথে বিদেশে চলে গেছে। চাচার অবস্থাও বেশি একটা ভালো না। আগে তো পায়ের ওপর পা তুলে খেয়েছে। আর এখন অন্যের জমিতে হাল চাষ করে খাচ্ছে। দিন আনে দিন খায় এরকম। আর দালান বাড়িটা দেখাশোনা করে চাচা। এটাও আমাদের নেই। যে কিনেছে সে বিদেশে থাকে। বছরে একবার আসে এখানে। সিয়াম কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমিও যা ভাবার ভেবে নিলাম। সিয়ামকে বললাম আসলে জমিজমা যাই থাক নিজের কর্ম হচ্ছে বড় জিনিস। নিজেকে গড়ে তুলার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। তাহলেই সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। আর যদি তা না করা হয় তাহলে তোদের পরিবারের মত ধ্বংস হয়ে যাবে। ঐ যে কথায় আছে না লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। কথাটা আসলেই সত্যি!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ