রুপ

রুপ

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১৩

সানজীদ নিশান চৌধুরী মানুষ যেমন পাখিকে ভালোবাসে, পাখিও তেমনি মানুষকে ভালোবাসে, মায়া করে। তোমরা তো জানো অনেক পাখি মানুষের পোষ মানে। যেমন কবুতর, ময়না, শালিক, টিয়া, ঘুঘু ইত্যাদি। এবার টিয়া পাখির পোষ মানা গল্প শোনো। পিয়াস নামের একটি ছেলে। সে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবা একজন কাঠুরে। বনজঙ্গল থেকে, পাহাড়ের ঢালু থেকে পিয়াসের বাবা কাঠ এনে বাজারে বিক্রি করেন। বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। পিয়াসের লেখাপড়ার খরচও চলে। তাদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়িতে একটা টিনের দোচালা ঘর। সামনেই উঠোন। উঠোনের একপাশে কামরাঙা গাছ, বরই গাছ, জামবুরা গাছ, আমগাছও আছে কয়েকটি। জ্যৈষ্ঠ মাসের একদিন। দুপুরে হঠাৎ ঝড়ো বৃষ্টি হয়ে গেছে। বিকেল বেলা পিয়াসের বাবা গেলেন কাঠ কাটতে। পাহাড়ের ঢালুতে। ঢালু বেয়ে তিনি উপরে উঠতে যাবেন। দেখেন পায়ের কাছে একটা টিয়া পাখির বাচ্ছা। বাচ্চাটি আহত, রক্তাক্ত। তার ছোট ছোট দু’টি ডানা ঝাপটিয়ে উড়বার চেষ্টা করছে কিন্তু উড়তে পারছে না। এমনিতেই ঝড়ের আঘাতে পাখির আহত বাচ্চাটি। তার ওপর কয়েকটা বড় পিঁপড়া তাকে কামড়াচ্ছে। পিয়াসের বাবা তাড়াতাড়ি করে বাচ্চাটাকে দুই হাতে তুলে নিলেন। বড় পিঁপড়াগুলোকে তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু এ আহত রক্তাক্ত ছানাটিকে তিনি এখন কী করবেন? ভাবতে লাগলেন। অন্যান্য পাখিরা যেমন গাছের ডালে বাসা বাঁধে, টিয়া পাখিরা সাধারণত তেমনি বাসা বাঁধে না। ওরা উঁচু পাহাড়ের গুহায় বাসা বাঁধে, বাচ্চা ফোটায়। কখনও কখনও রেল সেতুর দেয়ালের খোড়লেও টিয়া পাখি বাসা বাঁধে। পিয়াসের বাবা ভাবলেন, ছানাটাকে তিনি ওর মায়ের কাছে রেখে আসবেন। কিন্তু তিনি ওর মায়ের বাসা খুঁজে বের করতে পারলেন না। পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য গুহা। তাতে অনেক টিয়া পাখির বাসা। এ বাচ্চার মায়ের বাসা কোনটি বুঝতে পারলেন না তিনি। তাই অনেক ভেবে চিন্তে বাড়িতে নিয়ে এলেন। টিয়া পাখির বাচ্চা পেয়ে পিয়াস তো মহাখুশি। বাবাকে বলল, বাবা এটাকে আমি পোষ মানাবো। ওর মা বাটা মরিচ আর হলুদ মিলিয়ে মলমের মত বানালেন। তারপর সেগুলো পাখিটার আহত স্থানগুলোতে লাগিয়ে দিলেন। নিজের পুরনো শাড়ি ছিঁড়ে লাগানো মলমের স্থানগুলো ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে টিয়া পাখির বাচ্চাটা ভালো হয়ে উঠল। টিয়া পাখিটার জন্য পিয়াসের বাবা একটা লোহার খাঁচা জোগাড় করে এনেছিলেন। ওটার ভেতরেই থাকতো টিয়া পাখিটা। খাবার দেয়ার সময় হলে পিয়াস পাখিটাকে বের করে আনতো। আর কাউন, ধান, কামরাঙা এবং পাকা তেলেকুঁচ খেতে দিতো। কয়েক দিনেই চিনে ফেললো পাখিটা। ওর পোষ মেনে নিল। কয়েক মাস যেতে না যেতে পাখিটা বেশ ডাগর ডোগর হয়ে উঠল। ওর সারা গায়ে সুন্দর বাদামি রঙের ফইর গজিয়ে উঠল। পিয়াস ওকে কথা শেখালো। পাখিটা ‘তুমি ক্যামন আছো, মেহমান এসেছে, পিঁড়ি দাও’ শিখল। আর ওকে ‘পিয়াস পিয়াস’ বলে ডাকতো। পিয়াস ওকে প্রশ্ন করতো, ক্যামন আছো? পাখিটা বলতো, ভালো আছি। এসব পিয়াস ওকে পরম যতেœ শিখিয়েছিল। একদিন এমনি করে খেলায় মগ্ন ছিল পিয়াস আর তার রুপু। একবার পাখিটা যেই উড়ে এসে মাটিতে বসেছে, হঠাৎ পাশের বাড়ির একটা বিড়াল দূর থেকে বাঘের মতো লাফ দিয়ে এসে পড়ল রুপুর ওপর। চোখের নিমিষে ঘটে গেল ঘটনাটা। পিয়াসও ঝাপটে ধরল বিড়ালটাকে। বিড়ালের মুখ থেকে কেড়ে নিল রুপুকে। নিলে কী হবে, পাখিটাকে যে কামড়ে দিয়েছে বিড়ালটা। ওর বুকের কাছে অনেকখানি ক্ষত হয়ে গেছে, রক্ত ঝরছে। পিয়াস মাকে ডাকলো চিৎকার করে। মা এসে আবার আগের মতো বাটা মরিচ আর হলুদ লাগিয় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পিয়াসের সেবা শুশ্রƒষায় কয়েক দিনে আবারও বেঁচে উঠলো টিয়া পাখিটা। সুন্দর নাদুস নুদুস হয়ে উঠল। পিয়াসের বাবা বললেন, দু’দুবার পাখিটা আহত হয়েও বেঁচে উঠেছে। কিন্তু বিড়াল যদি আবার ওকে ধরতে পারে তাহলে আর রক্ষে নেই। তুই পাখিটাকে ছেড়ে দে বাবা। ও বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে, পর্বতে গিয়ে নিজের মতো বাঁচুক। শুনে তো পিয়াসের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। এতদিন এত যতœ করে ও পাখিটাকে পোষ মানাল, কথা শিখালো, আর এখন ওকে ছেড়ে দিতে হবে? পিয়াসের মা বললেন, তোর যেমন মা-বাবা রয়েছে, ওরও তো মা-বাবা আছে। ওকে ওর মায়ের কাছে ফিরে যেতে দে বাবা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল পিয়াস। যদি সত্যি সত্যি বিড়ালটা ওর রুপুকে মেরে ফেলে! ও পাখিটাকে ছেড়ে দিল সত্যি কিন্তু পাখিটার জন্য ওর কান্না পেয়ে গেল। ওর বুকের ভেতর অস্বস্তি ভাব দম বন্ধ হয়ে থাকতো। ওর শুধু ভাবনা হতো পাখিটাকে কে ধান খেতে দেবে, কাউন, কামরাঙা খেতে দেবে? ওর সঙ্গে কথাই বা বলবে কে? এরকম দুর্ভাবনায় পিয়াসের জ্বর হলো। রাতের বেলাতেই পিয়াস প্রলাপ বকতে লাগলÑ রুপু ফিরে আয়, রুপু ফিরে আয় বলে চিৎকার করে উঠল। ওর মা-বাবা তো ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। শেষে ছেলের জীবন নিয়ে টানাটানি! পাখিটাকে ছেড়ে দিয়ে কি তারা ভুল করেছেন? পাখিটাকে এখন তারা পাবেন কোথায়? বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ওদের ঠিকানা। সেখানে গেলেই কি আর রুপু পাখিটাকে পাওয়া যাবে। এ রকম ভাবতে ভাবতে সকাল হলো। সকাল হতেই পিয়াস চোখ মেলে তাকাল। ভালো মানুষটির মতো বললো, মা পাখিটা ফিরে এসেছে। তুমি দরোজা খোলো। ও আমাকে ডাকছে। মা দরজা খুললেন। পিয়াস বাইরে বেরিয়ে এলো। পিছু পিছু তার মা। উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো পিয়াস, মা ঐ যে ঐ যে রুপু বসে আছে। আমাদের টিনের চালে। মা দেখলেন সত্যি তো! টিয়া পাখিটা। পিয়াসকে দেখে পাখিটা উড়তে যাচ্ছিল। পিয়াস বলল, ওখানেই থাক রুপু। নিচে আসিস নে। বিড়ালটা এসে যেতে পারে। পাখি ওখান থেকে বলল, ক্যামন আছো। পিয়াস উচ্ছ্বাসে বলল, তুই চলে গেছিস বলে আমার জ্বর হয়েছে। এখন আমি ভালো আছি। তুই ক্যামন আছিস? পাখি বলল, ভালো আছি। তবে এখন আসছি, বলে পাখিটা চলে গেল । ঠিক দুপুরের দিকে অনেক টিয়া পাখি সঙ্গে নিয়ে রুপু টিনের চালে এসে বসল। তাদের কিচির মিচির শব্দ শুনে পিয়াস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তো অবাক! এতগুলো সঙ্গী নিয়ে রুপু এসেছে ওর অসুস্থ সঙ্গীকে দেখতে। পিয়াসের চোখে পানি এসে গেল। সে তাড়াতাড়ি কতগুলো ধান আর কাউন এনে টিনের চালে ছড়িয়ে দিল। পাখিরা দলবেঁধে খুঁটে খেতে লাগল। তারপর থেকে এমনি করে রোজ একবার রুপু পাখিটা তার সঙ্গীদের নিয়ে পিয়াসকে দেখতে আসে। তার মনিবকে দেখতে আসে। সুস্থ হয়ে ওঠে পিয়াসও।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ