রহমতের মাস রমজান

রহমতের মাস রমজান

বিশেষ রচনা জুন ২০১৫

নাসির হেলাল # হিজরি সনের সর্বাধিক সম্মানিত, সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ, সর্বোত্তম ও বরকতময় মাস হলো রমজান মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সৃষ্টির জন্য আসমান থেকে অবিরল ধারায় রহমত-বরকত নামতে থাকে। রহমত, বরকত, মাগফিরাতের এ মাস। এ মাসটিতে রয়েছে মুমিনদের জন্য সিয়ামের মতো মহানিয়ামতপূর্ণ ইবাদত। এ মাসেই নাজিল হয়েছে মানবতার মুক্তিসনদ আল কুরআন। এ মাসে রয়েছে সেই মহিমান্বিত রজনীÑযে রজনী কিনা হাজার মাসের থেকেও উত্তম। তাছাড়া সিয়ামের মধ্যে রয়েছেÑইফতার, সেহরি, তারাবিহ ইত্যাদির মত বরকতপূর্ণ সব বিষয়। অন্য দিকে সিয়াম পালনের মাধ্যমে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ প্রভৃতি অনুশীলন বা সাধনায় আত্মনিয়োগ করার মহা সুযোগ।
রমজান মাস শুরুর আগ থেকেই অর্থাৎ মধ্য শাবান থেকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাজ সাজ রব পড়ে যায় রমজানকে স্বাগত জানানোর জন্য। মুসলিম দেশগুলোর কর্ণধারগণ আগ থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করেন বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে, যেন রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক না হয়ে যায়, খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ ঠিক থাকে ইত্যাদি বিষয়ে। আমরা দেখতে পাই সাধারণ মানুষজনের মধ্যে এক ধরনের নমনীয়তা-কমনীয়তা বিরাজ করে। সমাজে শান্তির একটা ফল্গুধারা বইতে থাকে।
‘রোজা’ শব্দটি আরবি ভাষার শব্দ নয়। এটি ফারসি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ উপবাস। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘সাওম’। যার আভিধানিক অর্থ বিরত রাখা, বারণ করা বা ফিরিয়ে রাখা। শরিয়তের পরিভাষায়, ‘সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে কোনো ধরনের পানাহার এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা।’
‘আরবি বছরের নবম মাস হলো পবিত্র রমজান মাস। ‘রমজান’ শব্দটি আরবি ‘রমজ’ ধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে। ‘রমজ’ শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে; ক. রমজ অর্থ জ্বলন বা দহন। একজন রোজাদারের রোজা রাখার কারণে ক্ষুধার তীব্রতায় পেট জ্বলতে থাকে, তাই বলা হয়Ñরোজাদার দগ্ধ হয়। খ. আরবি ‘আর-রামাজাউ’ শব্দের অর্থ উত্তাপের তীব্রতা। আরবি মাসের নাম নির্ধারণকালে যে মাসে সূর্যের তাপ প্রখর ও তীব্র হয়েছিল সে মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘রমজান’। গ. এই মাসের নেক আমলসমূহ বান্দার গুনাহ খাতা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, তাই এই মাসের নামকরণ করা হয়েছে রমজান। ঘ. যেমনিভাবে সূর্যের তাপে বালুকারাশি উত্তপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি এই মাসে সৎ উপদেশ বাণী শ্রবণে ও পারলৌকিক চিন্তা-ভাবনায় বান্দার হৃদয় উত্তাপ ও উচ্ছ্বাস গ্রহণ করে থাকে। তাই এই মাসকে রমজান মাস বলা হয়।’
রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ করা হয়েছে। অবশ্য পবিত্র কুরআন থেকে জানা যায় আমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের ওপরও রোজা ফরজ ছিল। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সাওম ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল। সম্ভবত এর ফলে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)
উক্ত আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে সাওম পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘তাকওয়া’।
পৃথিবীর সকল ধর্মমতেই কোন না রকমের উপবাস ব্রত পালনের নিয়ম রয়েছে। পুরাকালে কেল্ট রোমান অ্যাসিরীয় ও ব্যবিলনীয়দের মধ্যে ‘সাওম’ পালনের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ইয়াহুদ, খ্রিস্টান, জরথুস্ত্র ও কনফুসিয়াস অনুসারী, বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মে সাওম বা উপবাস পালিত হয়।
বছরের যে কোন দিন, যে কোন সময় ভালো কাজ করা যেতে পারে, যার ফজিলত বা সওয়াবও রয়েছে। কিন্তু রমজান মাসে এসব ভালো কাজের সওয়াব আল্লাহ এতো বেশি দান করেন যে, তার কোন প্রকৃত হিসাব নেই। এ মাসে একটি নফল ইবাদত একটি সুন্নতের সমান হয়ে যায়, একটি সুন্নত ইবাদত একটি ফরজের সমান হয়ে যায়। আর ফরজ ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ এতো বেশি বাড়িয়ে দেন যে তা সাতশত গুণের ওপরে বাড়তে থাকে।
‘তাকওয়া’ শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থ হলো সাবধানী বা সতর্ক হওয়া, ভয় করা, পরহেজ করা, বেঁচে চলা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ তা’আলার প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ বা পদ্ধতি অনুসারে কোনও নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার উদ্দেশ্যে ‘মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবল ইচ্ছা’। আর যার মধ্যে তাকওয়ার গুণ বর্তমান আছে তিনিই হলেন মুত্তাকি।
তাকওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেছেন, ‘তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা, তাঁর নাফরমানি না করা; আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁকে ভুলে না যাওয়া এবং আল্লাহর শুকরিয়াহ আদায় করা ও তাঁর কুফরি না করা।’ (সাপ্তাহিক আদ-দাওয়াহ, ১০-২-১৯৯৪, সৌদি আরব)
অন্য দিকে ওমর বিন আবদুল আজিজ রহ: এ বিষয়ে বলেছেন, ‘দিনে রোজা রাখা কিংবা রাতে জাগরণ করা অথবা দুটোর আংশিক আমলের নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হচ্ছে, আল্লাহ যা ফরজ করেছেন তা পালন করা এবং তিনি যা হারাম  করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। এরপর আল্লাহ যাকে কল্যাণ দান করেন সেটা এক কল্যাণের সাথে অন্য কল্যাণের সম্মিলন।’ (প্রাগুক্ত)
সাওমের ক্ষেত্রে নিয়ত করা জরুরি। এ নিয়ত হবে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। নিয়ত ছাড়া সাওম পালন হবে না। নিয়ত করার উত্তম সময় হলো সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত। যদি ভুলক্রমে নিয়ত না করা হয় তবে দুপুরের আগ পর্যন্ত সময়ে করলেও হবে। অবশ্য রাতে ঘুমবার পর সেহেরি খেতে উঠলে এবং সেহেরি খেলেও সাওমের নিয়ত আদায় হয়ে যাবে, কারণ সেহেরি তো সাওম রাখার উদ্দেশ্যেই খাওয়া হয়। তবে মৌখিক নিয়ত করাই ভালো। অনেকেই মনে করেন নিয়ত করার পর কিছু খাওয়া জায়েজ নয়, এমন ধারণা ভুল। নিয়ত করার পরও সুবহে সাদিক পর্যন্ত হালাল জিনিস অবশ্যই খাওয়া জায়েজ।romjan2
তাহলে এতক্ষণের আলোচনায় আমরা কী জানতে পারলাম? আমরা জানতে পারলাম পবিত্র রমজান মাসের পুরোটাই ইবাদত-বন্দেগির মাস। এ মাসের প্রতিটি ভালো কাজের সওয়াব অন্যান্য মাসের চেয়ে ৭০ গুণ এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ৭০০ গুণেরও বেশি। তা ছাড়া এ মাসেই সেই মহিমান্বিত রাত রয়েছে যে রাত কিনা হাজার মাসের থেকেও উত্তম। অর্থাৎ রমজান মাসের ইবাদতসহ শবে কদরের রাতের ইবাদতই বহুগুণে সওয়াব পাওয়া যাবে। বড়রা যেমন রোজা রেখে সওয়াবের অধিকারী হতে পারেÑতেমনি ছোটরাও সওয়াবের অংশীদার হতে পারে। মানে সওয়াব অর্জন করতে পারে। এ জন্য যারা ছোটÑতাদের এখন থেকেই রোজা রাখার অভ্যাস করা দরকার। পুরো মাসের না হলেও যতগুলো রোজা রাখা সম্ভব ততগুলো অন্তত রাখতে হবেÑতাহলে আগামী দিনে রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে উঠবে। তাই এ রহমতের মাসে নামাজ পড়ে, রোজা রেখে, অন্যান্য ভালো কাজ করে, দান সদকা করে যত বেশি সওয়াব অর্জন করা যায় ততই ভালো।
মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের আরজ, হে মাবুদ! তুমি এই রমজান মাসে আমাদের সকলের ওপর, আমাদের দেশের ওপর, সারা দুনিয়ার উম্মতে মুসলিমার ওপর রহমত, বরকত, মাগফিরাতের কল্যাণ দান কর।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ