রক্তেভেজা পালক   -তমসুর হোসেন

রক্তেভেজা পালক -তমসুর হোসেন

গল্প জুলাই ২০১৭

বৃষ্টিতে ভিজে বেড়াল ছানা খুব কাহিল হয়ে পড়লো।
তুমুল বৃষ্টি। তার ওপর দমকা বাতাসের ঝাপটা। কতোই বা বয়স হয়েছে তার। শীতের শেষে সে জন্মেছে। আর এখন চৈত্রের মাঝামাঝি। মাকে খোঁজার জন্য মিয়াও মিয়াও ডেকে ডেকে সে যাচ্ছিলো চিকলির মাঠে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা তাকে সাবধান করে বলেছিলো,
‘আমি খাবার আনতে যাচ্ছি।’
‘কোথায় যাচ্ছো মা?’
‘চিকলির মাঠ।’
‘আমিও যাবো। বাসায় বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না।’
‘শিকারের পেছনে ছুটবো, না তোমাকে সামলাবো?’
‘আমি ঝোপের আড়ালে বসে থাকবো। তুমি শিকার ধরবে।’
‘আল্লাদ দেখো। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবো তার হুঁশ আছে। ওসব বায়না ছাড়ো বলছি।’
‘শুধু একদিন যাই মা। আর কোনদিন যেতে চাইবো না।’
‘কথা শোন। বাসা থেকে একদম বের হবে না। ভালো করে বলে গেলাম কিন্তু।’
মা চলে গেলে বেড়াল ছানা বিছানার ওপর একা একা লাফালাফি করলো। তারপর একটা ভাঙা ডুগডুগি গাছের ডাল দিয়ে এলোমেলো তালে বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তার যদি একটা ছোট ভাই থাকতো তাহলে তার সাথে সারাদিন খেলতে পারতো সে। এভাবে অনেকটা সময় কাটিয়ে খুব বিরক্ত হলো বেড়াল ছানা। মায়ের কড়া নিষেধ সত্ত্বেও সে একপা দু’পা করে নরম ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাঠের দিকে যেতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ করে এলো দমকা বাতাস আর বৃষ্টি। একটানা বৃষ্টির আঘাতে তার ছোট্ট দেহখানা চুপসে গেলো। দমকা বাতাসে তার এতাটা ঠান্ডা লেগে গেলো যে সে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলো। এদিকে তার ক্ষুধাও লেগে গেলো প্রচুর। কিন্তু কোথায় পাবে সে খাবার। এই দুর্যোগে যদি মায়ের দেখা মিলতো! মা তাকে এই করুণ অবস্থায় দেখলে বাসায় নিয়ে যেয়ে আগুনের কাছে বসিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতো। দুধ খাওয়া হলে ইঁদুর ছানার নরম হাড় চিবিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়তো। তার অবস্থা এতোটা খারাপ হলো যে তার হাঁটার ক্ষমতা নেই। দাঁড়াতে গেলেই সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়।
এমন সময় একটা উড়ন্ত বাজ তাকে ছোঁ মেরে অনেক দূরে চলে যায়। বেড়াল ছানার দেহে তখন কী আর জান আছে! ভয় এবং আতঙ্কে সে হুঁশ হারিয়ে ফেললো। বাজপাখি তাকে নিয়ে উড়তে উড়তে নিজের বাসায় নিয়ে গেলো। বাজের তিনটে অবোধ বাচ্চা বৃষ্টির ঝাপটা আর ঠান্ডা বাতাসের দাপানিতে কাহিল হয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে ছিলো বাসার মাঝখানে। বেড়াল ছানাকে বাচ্চাদের পাশে ফেলে রেখে অন্য কাজে চলে গেলো বাজপাখি। সে ভাবলো বাচ্চারা যখন ঘুম থেকে জাগবে তখন বেড়াল ছানাকে খেয়ে ক্ষুধা মেটাবে। সে বেড়াল ছানাকে মৃত ভেবেছিলো। তার দেহে যে প্রাণ ছিলো এ কথা বাজপাখি একটুও বুঝতে পারেনি। তার পেটেও ক্ষুধা কামড় দিচ্ছিলো। কিন্তু কাজের তাড়া থাকার কারণে বেড়াল ছানাকে খাওয়ার কথা মনে তুললো না। পথে যেতে দু’চারটা মেঠো ইঁদুর ছোঁ মেরে নিলেই চলবে। তিনটে বাচ্চার পেট ওটাকে খেলে যে খুব একটা ভরবে না তা সে আন্দাজ করতে পেরেছে। পুরুষ বাজটা ক’দিন হলো বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তার খোঁজ করার জন্য সে বাতাসে পাখা মেলে দিলো।
একটু পরে বর্ষণ কেটে গিয়ে রোদ উঠলো আকাশে। সে রোদ লেগে বেড়াল ছানা সতেজ হয়ে উঠলো। আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরলো তার। রোদের দিকে পিঠ দিয়ে সে ভেজা দেহখানা ইচ্ছেমতো শুকিয়ে নিলো। এখন তার একটুও খারাপ লাগছে না। তবে পেটের ক্ষুধাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বেড়াল ছানা চোখ মেলে দেখতে পেলো বাজের দুটো বাচ্চা জড়সড় হয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার কোন লক্ষণ নেই ওদের। বেশ খাওয়া চলবে এবার টাটকা মাংস। সে একটা বাচ্চাকে খুব সন্তর্পণে টেনে নিয়ে ঘাড় মটকে মজা করে খেতে লাগলো। একটাকে খাওয়া শেষ করে সে আর একটার ঘাড় ভেঙে আপন মনে খেতে লাগলো। এটা যে শক্ত ডানার বাজের বাসা এ বিষয়ে তার একটুও ধারণা নেই। সে খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। এমন সময় পাখায় বাতাসের আওয়াজ তুলে স্বামীকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলো বাজপাখি। বেড়াল ছানার কান্ড দেখে তারা অবাক হয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। পুরুষ বাজটা তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করলো,
‘কী হচ্ছে এখানে? বাসায় বসে কী খাচ্ছে বেড়াল?’
‘ওটা তো মরা ছিলো। একটু আগে ধরে এনে ওদের কাছে রেখে গেলাম। এখন দেখছি মরেনি।’
‘কী বলছো তুমি, ঘাড় মটকে রেখে যাওনি কেন?’
‘আমি ভাবলাম মরে গেছে। তাই তোমাকে খুঁজতে চলে গেছি।’
‘আমাকে খুঁজতে মানে? আমি কি দুধের বাচ্চা? আমি বুঝি একা আসতে পারতাম না?’
‘তিন দিন আসোনি। তাই ভাবলাম একটু এগিয়ে যাই। এতোবড় সর্বনাশ হবে কী করে জানবো?’
‘তোমাকে আচ্ছা করে পেটানো দরকার। কী করবো এখন। নিজের পালক ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।’
বাচ্চাদের জন্য বাজপাখি যে আহার সংগ্রহ করে এনেছে সেই তাদের খেয়ে ফেলেছে। কত আদর আর ভালোবাসায় সে তাদের বড় করে তুলছিলো। নিজের বোকামির জন্য আজ তার এতবড় ক্ষতি হয়ে গেলো। কপালে হাত দিয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বাজেরা তাদের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বেড়াল ছানাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু বাজের দুটো বাচ্চাকে ভক্ষণ করে তার দেহে এতোটা বল এসেছে যে সে বাঘের মূর্তি ধারণ করে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওর ক্ষিপ্রতা দেখে ওরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। একটা পুরনো গাছের মরা ডালে বসে বাজেরা করুণ সুরে কাঁদতে লাগলো। তাদের কান্না শুনে শালিক, বক, পেঁচা, কাক, ফিঙে এবং আরও অনেক পাখি এসে চারপাশে ভিড় করতে লাগলো। শালিক বললো,
‘কী হয়েছে আপনাদের। কাঁদছেন কেন?’
‘আমাদের ছানা খেয়ে ফেলেছে।’
‘কে খেয়ে ফেলেছে?’ গলা বাড়িয়ে বললো কানি বক।
‘আপনারা তখন কোথায় ছিলেন? বাসায় কেউ ছিলো না?’ কিছুটা ভারিক্কি গলায় বললো পেঁচা।
‘আমি বাইরে ছিলাম। এসে দেখি একটা বেড়ালের বাচ্চা এই কান্ড করেছে।’ মিনমিনে গলায় বললো মা বাজপাখি।
ঘটনা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো। বাজের বাচ্চাকে ঘাড় মটকে খেয়েছে যে ঘাগু বেড়ালের বাচ্চা তাকে দেখার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সবাই চললো বাজের বাসার উদ্দেশে। দেখ কতো লাটবাহাদুর হয়েছে সে বিচ্চু বেড়ালছানা। দুটো বাড়ন্ত ছানাকে সাবাড় করে বাসা জবর দখল করে বসে আছে। এমন অনাচার তো হতে দেয়া যায় না। সবাই শোরগোল করে সেখানে যেয়ে দেখলো বেড়ালের বাচ্চা সেখানে নেই। এতসব হট্টগোলের মাঝে সে যেন কোথায় চম্পট দিয়েছে।
বাজপাখির বাসার মাঝখানে পড়ে আছে তাদের মৃত ছানার রক্তাক্ত পালক।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ