যেমন দেখেছি কাতার

যেমন দেখেছি কাতার

ভ্রমণ জাফর তালুকদার এপ্রিল ২০২৩

সেই প্রথম কাতারে এসেছিলাম ২০০৮ সালে। ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নয়। লন্ডন যাত্রার ট্রানজিট হিসেবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিরতি ছিল দোহা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। তখন বিমানবন্দরটি ছিল ছোট আর অগোছালো। বড়সড় সংস্কারের কাজ চলছিল। গিজগিজে ভিড় আর সীমাবদ্ধ সংকীর্ণতা মনের প্রসন্নতা নিভিয়ে দেয়। যদিও ২০১৪ সালে বিমানবন্দরটি হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নামকরণের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন অবয়বে। 

ছেলে রাজন সামি বিলাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে বছর চারেক আগে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে কাতার আসে। সে সময় একটু বিরূপ মন্তব্য করেছিলাম পুরনো স্মৃতি মাথায় রেখে। পরে রাজনের কথাবার্তা আর অভিজ্ঞতা থেকে যে-বার্তা পেয়েছি সেটা আমাকে নিয়ে যায় স্বপ্নের কাছাকাছি। সামাজিক গণমাধ্যম আর নানা-সূত্র থেকে উড়ে আসে বিস্ময়কর সব সংবাদ। এ-কাহিনী রূপকথাকেও হার মানায়। স্রেফ জেলেপল্লী থেকে কোমর মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়ানো আর যাহোক চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! বড় কথা, কাতার সেটা পেরেছে। সুযোগ্য নেতৃত্ব আর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের কারণে তারা ফিরে পায় গভীর আত্মবিশ্বাস। নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনায় প্রাকৃতিক সম্পদকে রূপান্তরের মাধ্যমে আয় করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে তাদের রাজকোষ। ধনসম্পদের প্রাচুর্য তাদের যেমন আত্মবিশ্বাসী করে, তেমনি উৎসাহ জোগায় নিজেদের খোলনলচে পাল্টে পিঠটান করে দাঁড়াতে। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে খুব দ্রুত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রথম সারিতে উঠে আসে কাতার। যে কারণে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো আন্তর্জাতিক ব্যয়বহুল টুর্নামেন্ট আয়োজনে তাদের বুক কাঁপে না একটুও। বরং রাজকীয় বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে নাক-উঁচু পাশ্চাত্যকে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয় সদর্পে- ‘এই দ্যাখো, আমরাও পারি...।’ 


২.

প্রায় এক যুগের ব্যবধানে আবার পা রাখলাম কাতারে। মধ্যরাতে দোহার হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড়। কিছুই মেলাতে পারছি না পুরোনোর সঙ্গে! বিশাল বিপুল সুন্দর সহসা চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লে যেমন থিতু হতে সময় লাগে, আমার অবস্থা তদ্রƒপ।

চারদিকের চাকচিক্য, মনোরম সাজসজ্জা, অভিনব আধুনিক রীতিনীতি, আমাদের সীমাবদ্ধ মলিন দৃষ্টিকোণকে আছড়ে-পিছড়ে ধুয়ে দেয় আরব সাগরের জলে। একটু আগে বিমান থেকে কাতারের আলো ঝলমল যে রূপ দেখেছি, তার চমকের ছটায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি তখনও। এরপর আকাশ থেকে নেমে পা রাখলাম আর এক বিশাল নিঝুম এলাহি প্রাসাদে। 

যন্ত্রচালিতের মতো চলছে এখানের সবকিছু। চাওয়ার আগেই নাগালে পৌঁছে যাচ্ছে সবরকম সুযোগ-সুবিধা। আমাদের কিছুই করতে হলো না তেমন। ওদের কাঁধে ভর করে সম্পন্ন হলো যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার নিয়মবিধি। ঝাড়খণ্ডের ছেলেটি সব ঘাট পার করে আমাদের পৌঁছে দিলো কার পার্কিং জোনে। একটু লজ্জিত হলাম। ২০০৮ সালে এই বিমানবন্দরের সামান্য খুঁত মাথায় নিয়ে কিরকম বিরূপ একটা ধারণা এতদিন পুষে রেখেছিলাম মনের কোণে! আমরা হাভাতে দেশের মানুষ। অনিয়মের দূষিত ডোবায় বাস করে সাগর-জলের বিশুদ্ধতা খোঁজা আর যাহোক এই নাদান বাঙালের মানায় না! এটা আজ নতুন করে টের পেলাম হাড়ে হাড়ে। 

রাজন মাঝরাতে বউমা মুন আর দুই ছেলে নিয়ে হাজির হলো বাবা-মাকে রিসিভ করতে। আমাদের অতি আদরের প্রিয় দুটি মুখ আহনাফ আর আয়মান। পথের সব ক্লান্তি ঘুচে গেল তাদের শ্রীমুখ দেখে। প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে শরীরটা একরকম টেনে এনেছি এতদূর। আমাদের দুজনকে সামলে নিয়ে এসেছে ডাক্তার মেয়ে সুকন্যা। গাড়িতে উঠে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আলোর ফোয়ারায় সাঁতার কাটার মতো মধ্যরাতে বাসার দিকে উড়ে চলল রাজনের প্রকাণ্ড গাড়ি।


৩.

লুসাইল সিটি গড়ে উঠেছে আরবসাগর ঘেঁষে। এলাকাটি বনেদি। পাঁচতারা আলোঝলমলে হোটেল আর সার সার বহু কেতার গগন-উঁচু ভবন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এগুলো বেশির ভাগই কাতারের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত। চাঁদের আকৃতির হোটেলটির অভিনবত্ব, নকশার কারুকাজ, শৈল্পিক সৌন্দর্য, বিস্ময় আর মুগ্ধতায় আপ্লুত করে। সাগরের মনোরম পটভূমিতে পুরো এলাকাটি সাজিয়ে তোলা হয়েছে অপরূপ বিন্যাসে। পানির ফোয়ারা, তোরণ, বর্ণিল আলোর ছন্দে পানির নাচন, কৃত্রিম ঝর্ণা, পার্ক, বৃক্ষলতা, বাহারি গাছগাছালি, থোকা থোকা ফুল, আলোর রোশনাই- সবমিলিয়ে রচিত হয়েছে এক অপূর্ব মহাকাব্যিক পরিবেশ। সাগর পাড়ের একটি অংশজুড়ে বিশাল কাঠের গ্যালারি। সেখানে শুয়ে বসে পান করা যায় সাগরের অপূর্ব রূপসুধা। চিত্তবিনোদনের এই স্নিগ্ধ আরামটুকু বিপুল উন্মাদনায় আপ্লুত করে সবাইকে। 

বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে এসেছি অথচ ফ্যান ফেস্টিভ্যালে যাব না তা কি হয়! সেখানে একটি সড়ক বন্ধ থাকার কারণে গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটুকু পাড়ি দিলাম মেট্রোরেলে চড়ে। আল বিদা পার্কটির বিশালত্ব ভাবনাকেও হার মানায়। ঢাকার একটি অংশ সহজে ঢুকে যাবে এর পেটে। পুরো পার্কটি সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। মনে হয় কোনো নিসর্গ-শিল্পী ছেঁটেকেটে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছে এই ফুলফলের স্বর্গীয় বাগানটি। কোথাও একটু মালিন্য নেই। পুরোটাই ঝকঝকে তকতকে। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দকে আরও একটু রাঙিয়ে দিতে কার্নিশের সাগরপাড়ে মেতে ওঠে মনোমুগ্ধকর আতশ বাজির উৎসব। ওদিকে ফ্যান ফেস্টিভ্যালে ফুটবল দর্শকদের উন্মাদনা বাড়াতে বড় স্ক্রিনে দেখানো হয় ফুটবল লাইভ। আমরা ব্রাজিল-ক্যামেরুনের খেলাটি এখানে উপভোগ করলাম।


৪.

শুধু অর্থ নয়, অর্থের সঙ্গে যদি যুক্ত হয় শিল্প-সংস্কৃতির রুচি-স্নিগ্ধ চর্চা, তখন স্বভাবতই তা পাইয়ে দেয় নতুন এক মাত্রা। কাতার এখন আর কেবল খরখরে মরুদেশ নয়। সবুজে-শ্যামলে নিজেকে সে আদিগন্ত মুড়ে নিয়েছে অপূর্ব নৈসর্গিক মহিমায়। ধরিত্রীর সেরা অনুষ্ঠানটি সফলভাবে আয়োজন করে তারা বাহবা পেয়েছে গোটা বিশ্বের। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে দেশটি মেতে ওঠেনি কেবল, বিনোদনের আকর্ষণ রাঙিয়ে দিতে লক্ষ পর্যটকদের জন্য ঢেলে সাজিয়েছে বহুরূপ আনন্দ-পসরা। 

কাতারের ক্ষুদ্র ভেনিস বলা হয় দোহার পার্ল আইল্যান্ডকে। এটা হলো সমুদ্র-সংলগ্ন একটি চাকচিক্যময় অভিজাত এলাকা। ভেনিসের আদলে জলাধারের সঙ্গে মিতালি করে গড়ে উঠেছে এর অনুপম ভবন কাঠামো। নির্মাণ সৌকর্য, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি, নান্দনিক উপস্থাপনার গুণে এলাকাটি ভিন্নরকম মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পর্যটকদের কাছে। পার্ল আইল্যান্ডের নির্মাতা ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি আত্মশ্লাঘায় ডুবে না- থেকে বিশ্বকাপ দর্শকদের বিনোদনমূলক একটি চমৎকার উপহার দেবার মানসে কাজে লাগিয়েছে পার্ল আইল্যান্ডের এই খুদে ভেনিসকে। জনপ্রিয় ভেনিস কার্নিভালের ফেস্টি গ্রুপের সহযোগিতায় তারা এক নান্দনিক শৈল্পিক কাব্য উপস্থাপন করে নানা রকম পরিবেশনার মাধ্যমে। আলোছায়ার বর্ণাঢ্য উৎসবে ভবনের পাশে বয়ে চলা জলাধারে একে একে এগিয়ে চলে স্বপ্নভুবনের এক একটি তরী। সেখানে অপূর্ব দেহবল্লরীতে নৃত্যের ভঙ্গিতে নিজেকে মেলে ধরে কল্পরাজ্যের সুন্দরীরা। তাদের ছন্দময় আকর্ষণীয় দেহমুদ্রা শুধু মর্ত্যে নয়, বাতাসেও ভেসে বেড়ায় চমকিত হৃদয়কাড়া নৈপুণ্যে। মিউজিকের তালে তালে একজন ক্রীড়াবিদের পায়ে ফুটবলের ‘নাচন জাদু’ তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে। 

মরু দেশে এত বড় ফুটবল উৎসব, সেখানে ‘মরু জাহাজের’ ঐতিহ্যের কোনো প্রদর্শনী থাকবে না তা কি হয়? দোহা থেকে ২৫ মাইল দূরে ক্যামেল মাজায়েন ক্লাব আয়োজন করে উটের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা। সেখানে শত শত উটের মধ্যে থেকে নাজা নামের একটি উট জিতে নেয় সেরা সুন্দরীর খেতাব।


৫.

কাতার যখন বিশ্বকাপ উত্তাপে ফুটছে, সে মুহূর্তে ফুটবলকে ঘিরে শুরু হয়েছে আনন্দ-ফুর্তির আরেক বিশাল মচ্ছব।

লুসাইল স্টেডিয়ামটি বিশ্বকাপের সেরা স্টেডিয়াম। কাতারের মধ্য-দোহা থেকে এর দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। আরবের লণ্ঠন আর তৈজসপত্রের সমন্বিত মটিফে ডিজাইন করা হয়েছে ৮০ হাজার দর্শকের ব্যবহারযোগ্য ঝকমকে এই বিশাল স্টেডিয়াম। এখানেই বসবে ফাইনাল খেলার আসর। 

স্টেডিয়াম সংলগ্ন লুসাইল বুলেবার্ডে বিশ্বকাপ নিয়ে শুরু হয়েছে আশ্চর্য এক রঙিন উৎসব। মূলত এটা অত্যাধুনিক বাণিজ্যিক এলাকা। সুউচ্চ দৃষ্টিনন্দন ভবন, রকমারি অভিজাত দোকানপাটের সারি, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ফোয়ারা, ফুলের বাগান, ট্রাম- সবমিলিয়ে একধরনের চমকিত মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে এর সর্বত্র ।

বৃহস্পতিবার রাতে আলকাসারা থেকে মেট্রোতে চেপে রওয়ানা দিলাম লুসাইলে। লুসাইল স্টেশনে নেমে তাক লেগে গেল। এটি আমাদের দেশের যেকোনো ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টের চেয়ে শতগুণ উন্নত। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর নির্মাণ সৌকর্যের মাহাত্ম্যে এই ঝকঝকে স্টেশনটি বিশেষভাবে সমাদৃত। অন্য স্টেশনগুলোর জন্যও একই কথা খাটে। 

আলো ঝলমলে লুসাইল স্টেডিয়াম বামে রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম বুলেবার্ডের উৎসবে। আলোর বন্যায় ভাসছে গোটা এলাকাটি। দুপাশের ভবনগুলো থেকে উপচে পড়ছে বর্ণাঢ্য আলোর রোশনাই। বড় বড় রঙিন বিলবোর্ডে ভেসে উঠছে জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের মুখ। বিশ্বকাপ দলের পতাকা দিয়ে টাঙানো হয়েছে রাস্তাজোড়া শামিয়ানা। উচ্চগ্রামে বাজছে জনপ্রিয় গানের মিউজিক। নানা দেশের পতাকা দিয়ে সাজানো সুদৃশ্য প্ল্যাকার্ড। উদ্দাম গান-বাজনার সঙ্গে চলছে মনোহর নৃত্যের মহড়া। লেজার লাইটের বাহারি প্রদর্শনীতে নানা বর্ণ ধারণ করছে ঝুলন্ত বিশাল এক হাঙ্গর। সারি সারি ফোয়ারায় উপচে পড়ছে রঙিন পানির নৃত্য। বহুদেশের ঝলমলে  বৈচিত্র্যময় সাজসজ্জার নর-নারী আর শিশুদের হৈ-হল্লার উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে লুসাইল বুলেবার্ড। চোখকাড়া সুউচ্চ ভবনগুলো থেকে চোখ ফেরানো যায় না। সমুদ্র পারে অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়। পানিতে ভেসে আছে অসংখ্য আলোর নৌকা। পাড়গুলো মনে হয় আলো দিয়ে বাঁধানো। 

লুসাইল বুলেবার্ড মাতাল নেশায় পাগল হয়ে আছে। বিশ্বকাপের এই নেশা নাচিয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।


৬.

স্বার্থের মিল না হলে পশ্চিমারা সবকিছুতে খুঁত খুঁজে বের করে। দাপুটে মিডিয়ার কল্যাণে তারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাতে পারে। কাতার যখন বিশ্বকাপ আয়োজনের টিকিট পেল অমনি শুরু হলো তাদের ‘চুতরা-ঘষা’ গাত্রদাহ। অজস্র নেতিবাচক মন্তব্যের তীর সমানে ছুড়েও দমাতে পারলো না কাতারের অগ্রযাত্রাকে। কাতার কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। বিশ্বসেরা ৮টি স্টেডিয়াম বানিয়ে রীতিমতো চমকে দিলো নাক-উঁচু পাশ্চাত্যকে। তারা এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি। যা করার তা করে গেছে নিভৃতে। শেষ তুরুপের তাসটি মেরে দেখালো ২০ নভেম্বর। সফলভাবে উদ্বোধন হলো ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ কাতার ২০২২। 

প্রচলিত শাকিরা-জাতীয় উদ্বোধনী-মন্ত্র না জপে তারা প্রতিবন্ধী কিশোর গানিম আল মুফতাহকে দিয়ে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু করে আসরের জয়যাত্রা। তারপর তো পুরোটাই ইতিহাস। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে তারা একে একে বের করে আনে বিস্ময়কর চমক। কাতারের শিল্প-সাহিত্য-

সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-

ধর্ম কতটা সমৃদ্ধ তা খোলা পৃষ্ঠার মতো তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সামনে। যা দেখে লক্ষ-লক্ষ দর্শক বিস্ময়ে অভিভূত। প্রশংসায় সরব তাদের কণ্ঠ। কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যেন আগামী দিনের দুবাই, লন্ডন, প্যারিস, রোম, নিউ ইয়র্ককে দর্শক খুঁজে নিতে পারে। সেই দিন বেশি দূরে নয়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। 

কাতারের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও কৃষ্টি মেলে ধরার জন্য জাতীয় ভিশন ২০৩০ সামনে রেখে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেয় কাতারা কালচারাল ভিলেজ। এর আওতায় বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের কর্মকাণ্ডকে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পারস্পারিক সমঝোতা, মতবিনিময়, সেমিনার, সভা, ওয়ার্কশপ, কর্মশালা,

অ্যাম্পিথিয়েটার, গ্যালারি, প্রদর্শনী, উৎসব প্রভৃতি মাধ্যমে একাধিক কর্মসূচি যুক্ত হয় তাদের পরিকল্পনায়।

বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে কাতারের সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য দর্শকদের সামনে তুলে ধরার জন্য কালচারাল ভিলেজে বিশেষ একটি মেলার আয়োজন করা হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রাক্কালে এই আয়োজন ছিল নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অতীত দিনের কাতারের জনজীবন, মৎস্য আর মুক্তা আহরণ, হস্ত ও কুটির শিল্প, খাদ্য, বাদ্যযন্ত্র, বিনোদন, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ঘরগেরস্তি, পোশাক, জাল, নৌযান, গৃহনির্মাণ, জেলেজীবনের খুঁটিনাটি প্রভৃতি উপস্থাপন করা হয় এই ঐতিহ্যবাহী মেলার মাধ্যমে। সাগরে নোঙর করে রাখা হয় জেলেদের ব্যবহৃত নৌকা। এক সময় কাতার ছিল স্রেফ একটি জেলেপল্লী। এর প্রধান জীবিকা ছিল সাগর থেকে মৎস্য আর মুক্তা আহরণ। কাতার তেলসম্পদের প্রাচুর্যে ধীরে ধীরে বদলে দাঁড়ায় বর্তমান অবস্থায়। এ উত্থান গল্পকেও হার মানায়। 

কাতারা কালচারাল ভিলেজ নিয়ে কাতারবাসীর গর্বের শেষ নেই। সাগর তীরে এ যেন এক স্বর্গীয় চমৎকার ভূখণ্ড। এটি নির্মাণ করেন সাবেক আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি। সবুজ ঘাসেভরা উঁচু-নিচু মাঠ, ফুল-ফল, গাছপালা, ঝর্ণা, অটোমান শৈলীর দামি নীল ও বেগুনি পাথরে নির্মিত নীল মসজিদ, গিফট বক্স আদলে তৈরি মজাদার ভবন, আলো ঝলমলে দোকানপাট, শিশু-কিশোরদের বিনোদন, বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার সুযোগের সঙ্গে রয়েছে থিয়েটার, কনসার্ট আর নানা রকম প্রদর্শনীর সুযোগ। কাতারের আত্মাকে চিনতে হলে আসতে হবে এখানে।


৭.

আশঙ্কা ছিল। গুজবও রটানো হয়েছিল ষোলআনা। আরব মানে দমবদ্ধ কুয়ো। পশ্চাৎপদ অন্ধ জনপদ। ধর্মের নামে সেখানে চালু রয়েছে বর্বর সব নিয়ম-কানুন। নারী স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তারা অবগুণ্ঠনের বেদিতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে মাথা কুটে মরে। শিক্ষা-দীক্ষাহীন এমন একটি অনগ্রসর জনপদে বিশ্বকাপের মতো ধরিত্রীর সেরা অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া নেহাতই বালখিল্য সিদ্ধান্ত। একবিংশ শতাব্দীর এটা বোধহয় সেরা কৌতুক।

পাশ্চাত্যের এমনতরো অপবাদ কাতার কখনও গায়ে মাখেনি তেমন। পূর্ব-পশ্চিমের সবাইকে চেনা আছে বলেই কোমরটা সে বরাবরই শক্ত করে বেঁধেছে। কিন্তু চক্রান্ত থেমে থাকেনি। পাশ্চাত্য-দোসরদের প্ররোচনায় আরব প্রতিবেশীরা অবরোধের দেয়াল তোলে তার বিরুদ্ধে। বিধাতাকে ধন্যবাদ। পাশ্চাত্যের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়েছে। প্রতিবেশীদেরও বোধোদয় হয়েছে যথাসময়ে। সব প্রতিবন্ধকতা তুলে নিয়ে তারা এখন বন্ধুত্বের গীত গাইছে। 

বিশ্বকাপের সুযোগটা কাতার কাজে লাগাতে চেয়েছে নানা উপায়ে। অবকাঠামোগুলো গুছিয়ে-গাছিয়ে পর্যটনবান্ধব একটি উদার দেশ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে আরবের গৌরবজনক ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি প্রচারের পাশাপাশি ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছে দিতে চেয়েছে অগণিত বিশ্বকাপ দর্শকের কাছে। ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য আর উদারতার এই মহান বাণী তারা জানান দেবার চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অমুসলিম নর-নারীর কাছে। বেশির ভাগ পাশ্চাত্যবাসীর ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। নেতিবাচক একপেশে ভাবনায় পুষ্ট তাদের চিন্তাচেতনা। বিশ্বকাপ দেখতে আসার আগে এই মরুদেশ আর আরব লোকজন সম্পর্কে এক ধরনের কুসংস্কার মাথায় নিয়ে তারা পা রেখেছেন কাতারে। কিন্তু তাদের মনগড়া ধারণা ফিকে হতে দেরি হয়নি। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে পথঘাট, বিপণি, রিসোর্ট, সৈকত--- কোথাও বেলেল্লাপনা বা উগ্রতার মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের। খেলার সময় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে অ্যালকোহল নিয়ে ঢোকার সুযোগ না থাকায় মাতলামির সুযোগ হয়নি দর্শকদের। এমনকি সমকামিতার পক্ষে দর্শকদের রেইনবো ফ্লাগ প্রচারণার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কাতার সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল, মাত্র ২৮ দিনের খেলার জন্য এমন একটা অনৈতিক কর্মকে অনুমোদন দিয়ে ধর্মীয় কানুনকে খণ্ডন করা যাবে না। 

মস্কোর বিশ্বকাপের মতো নারীদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা একটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি কাতারে। লুসাইল, বুলেবার্ড, পার্ল, কাতারা, শপিং মল, হোটেল- মোটেল আর রাস্তাঘাটে রাত-বিরেতে পাশ্চাত্যের নর-নারীরা তাদের পছন্দসই পোশাকে টুই টুই করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নির্বিবাদে। এ সময় কারো দিকে চোখ তুলে তাকানো বা কোনো বাজে ইঙ্গিত ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি একটিও। এমন নিরাপদ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রীতিমতো বিস্মিত করেছে পাশ্চাত্যের পর্যটকদের। এ ধরনের নিরাপত্তা তারা স্বদেশেও চিন্তা করতে পারেন না। তাদের এই সন্তুষ্টির কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন মুক্তকণ্ঠে। 

বিশ্বকাপের সুযোগে ইসলামের উদার মাহাত্ম্য সম্পর্কে জোরেশোরে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা চাচ্ছেন ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ভুল ধারণার অবসান হোক। পরিবর্তন হোক পুরনো একপেশে মন-মানসিকতার। মূলত প্রচারের অভাবে এমনটা ঘটেছে। ভুল বুঝাবুঝির এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার জন্য নানা রকম তথ্য দিয়ে খোলাসা করা হচ্ছে তাদের অজানা কৌতূহলের। 

ইসলামী সংস্কৃতি ও ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে যে ভুল ধারণা পাশ্চাত্যের আছে তা নিরসনের এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে নারী দর্শনার্থীরা পর্দা, বহুবিবাহ আর নারী নির্যাতনের ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন তোলেন তা ব্যাখ্যা করা হয় কোরআনের যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে। নীল মসজিদের গেস্ট সেন্টার থেকে বিশ্বের খ্যাতনামা কয়েকজন ইসলামী ধর্ম প্রচারককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই গ্রুপের অন্যতম হলেন ডা: জাকির নায়েক। তাঁরা দর্শকদের বিভিন্ন কৌতূহলী প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন। ইসলামের সত্যিকার সৌন্দর্য ও মাধুর্যের দিকগুলো আলোকপাতের মাধ্যমে নৈতিকতা, মানবীয় গুণাবলি অর্জনের পাশাপাশি প্রতিবেশী ও অমুসলিমদের শ্রদ্ধার চোখে দেখার পরামর্শ দেন। নীল মসজিদে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণার জন্য বিতরণ করা হয় পুস্তিকা। কফি ও খেজুর দিয়ে আপ্যায়িত করা হয় দর্শনার্থীদের। অনেকেই ইসলামের নীতি- নৈতিকতায় মুগ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। 

ইসলামিক সেন্টার, মসজিদ ও গুরুত্বপূর্ণ রেস্তোরাঁগুলো এই প্রচার কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। অনেকক্ষেত্রে বিদেশি নারীদের হাতেনাতে শেখানো হয় হিজাব পরার কৌশল। সবকিছু দেখেশুনে একজন বিদেশী অমুসলিম বলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানার এটাই ভালো সুযোগ। 

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে অনুকূল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ইসলাম সম্পর্কে কত মানুষের মতামত পরিবর্তন করা গেল সেটাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য।

দোহার শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ ইসলামিক সেন্টার ধর্ম প্রচারে ১২ ঘণ্টা খোলা থাকছে। সুক ওয়াকিফ বাজারের একটি অংশে ফুটবল অনুরাগীদের বিতরণ করা হচ্ছে বই ও পুস্তিকা। সেখানে বড় করে লেখা আছে : আপনি যদি সুখের সন্ধান করেন.... তা ইসলামেই পাবেন।


৮.

রাজনের ইচ্ছা ছিল দোহার লুসাইল সমুদ্র পাড়ের অন্য দিকটায় আমাদের নিয়ে একটু ঘুরবে। আজ আর হাঁটাহাঁটি নয়। স্রেফ বসে থেকে রাতের সমুদ্র উপভোগ করা। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। বিশ্বকাপের উত্তাপ আর ফুডকোর্টের উৎপাতে দখল হয়ে গেছে পার্কিংয়ের জায়গা। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসতে হলো অন্যপ্রান্তে। এই জায়গাটায় আগেও এসেছি একবার। দারুণ সুন্দর সমুদ্রের পাড়টা। পাশেই চাঁদের মতো বাঁকা গগনছোঁয়া ঝলমলে হোটেল। সামনে বর্ণাঢ্য পানির ফোয়ারা। গানের তালে তালে মুগ্ধ দৃশ্যের পানি-নৃত্য। পার্ল আইল্যান্ডের বাড়িগুলো জ্বলছে বাহারি আলোর বন্যায়। সমুদ্র পাড়ের পুরোটাই মনোরম কেতায় বাঁধানো। পানি ছুঁইছুঁই রেলিং ঘেরা বিশাল কাঠের গ্যালারি। অদূরে কফি হাউজ। বসার বেঞ্চ। পার্ক। যেখানে মন চায় হাত-পা খুলে নেয়া যায় গভীর বিশ্রাম। 

আমরা কাঠের গ্যালারির একটা তাকে আরাম করে বসলাম। সামনে সমুদ্রের নিথর কালো জল। দূরে আলোর মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি জাহাজ। আগেরবার চাঁদ দেখেছিলাম আকাশে। আজকে কেবলই কয়েকটি মিটিমিটি তারা। একটু পর পর সব নিস্তব্ধতা ভেঙে উড়ে যাচ্ছে একটা দুটো কর্কশ উড়োজাহাজ। একটু চোখ ঘুরিয়ে তাকালে আলোর আগুনে মন ভেসে যায়। 

সমুদ্র পাড়ে একজন সৌদি প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে গল্প হলো আহনাফের। সে আল বাইকের গাড়ি নিয়ে এসেছে সৌদি আরব থেকে। খোলা জায়গা পেয়ে দুই নাতি ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। যথারীতি অফুরন্ত উত্তেজনা এবং ক্রন্দন। আমরা হরষে বিষাদে নির্বাক বসে থাকি কয়েক মুহূর্ত। রাজন মুনের সঙ্গে পরিকল্পনা আঁটে। উইকএন্ডে কোন সমুদ্র পাড়ে গেলে বারবিকিউ ভালো জমবে। শলা-পরামর্শের ভেতর চায়ের ভাগাভাগি নিয়ে ফের একটু মধুর উত্তেজনা তৈরি হয় খুদে নাতিদের। 

অবশেষে গাত্রোত্থান। এবার ফেরার পালা। রাতে সেমিফাইনালের খেলা আছে মরক্কো আর ফ্রান্সের। মুসলিম দেশ হিসেবে মরক্কোকে সমর্থন দিয়েছে কাতার। এ নিয়ে সমর্থকদের উত্তেজনার কমতি নেই। দু’ দেশের জোড়-পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মহড়া চলছে। সুউচ্চ ভবনগুলোয় নিয়নবাতির ছলকে ভেসে উঠছে মরক্কোর পতাকা। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলো দ্রুত ফিরছে মাতাল উত্তেজনায়। কী হবে আজকের ফুটবল যুদ্ধে? মরক্কো মুখ রাখতে পারবে তো? আরব যে তাকিয়ে আছে তার দিকে!

ফেরার পথে আল বাইকের কাছে গাড়ি রাখল রাজন। আল বাইক সৌদি আরবের বিখ্যাত ফুড চেইনশপ। ভ্রাম্যমাণ গাড়ি নিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজনে শামিল হতে এসেছে কাতারে। ওদের নাগেটস খেতে লাইন পড়ে যায়। বিশ্বকাপ শেষে ওরা ফের গাড়ি নিয়ে চলে যাবে সৌদিতে।

খেলা দেখার উত্তেজনা সবার ভেতর। সময় হয়ে যাচ্ছে। এর ভেতর হঠাৎ এক দুর্ঘটনা। বাসায় ফিরে আহনাফ লাফাতে লাফাতে ওয়াশরুমে ছুটতেই ভুরু আর চোয়ালে ভয়ানক আঘাত পেল দেয়ালে। রীতিমত রক্তারক্তি কাণ্ড। ওদিকে রাজনের ওয়ালেট পাওয়া যাচ্ছে না। নেই তো নেই। রক্ত আর অর্থ দুটোই যে মূল্যবান!

ওদিকে ফ্রান্সের কাছে দুই গোল খেয়ে মরক্কো পানি ঢেলে দিলো সব আনন্দে।


৯.

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল আসর বসবে ১৮ ডিসেম্বর। দিনটি নানাদিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। ফাইনাল খেলার জন্য শুধু নয়, কাতারের মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় দিবস হিসেবেও এদিনের গুরুত্ব অপরিসীম। 

কাতারের জাতীয় দিবসের এই গৌরবজনক দিনটি চিহ্নিত করার পেছনে একজন বাঙালির ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ৬৪ বছর বয়সী ড. হাবিবুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার শাহ পরীদ্বীপে। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার পর তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন ইংল্যান্ড ও কানাডা থেকে। কাতারের আমিরের সচিবালয়ে দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে তিনি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এদেশের বহু বছরের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা করে তিনি একটি নতুন ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে পান। আগে কাতারের জাতীয় দিবস পালন করা হতো ৩ সেপ্টেম্বর। ড. হাবিবুর রহমানের ব্যাপক অনুসন্ধানী গবেষণায় উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। তিনি দেখতে পান ৩ সেপ্টেম্বর নয়, সত্যিকার জাতীয় দিবস হবে ১৮ ডিসেম্বর। ড. হাবিবুর রহমান ২০০৬ সালে তথ্যপ্রমাণসহ তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনার পর সাবেক আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি ২০০৭ সাল থেকে ১৮ ডিসেম্বর কাতারের জাতীয় দিবস পালনের ঘোষণা দেন।

ড. হাবিবুর রহমানকে তাঁর ভূমিকার জন্য কাতারে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। প্রবাসী বাঙালিরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও অমায়িক। প্রবাসীদের কল্যাণ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত ভূমিকা রাখছেন।


কাতারের দোহায় অবশেষে শেষ হলো বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২। খেলা নিয়ে নগরীর আলবিদা পার্ক সংলগ্ন সাগর-তীর ছিল হাজারো সমর্থকদের ভিড়ে উল্লাসমুখর। এর ভেতর বেশিরভাগই ছিল আর্জেন্টিনার বাংলাদেশী সমর্থক। বড়স্ক্রিনে খেলা দেখার সময় তারা দেশটিকে সমর্থন জুগিয়েছে বিপুল উৎসাহে। আর্জেন্টিনার জয়ের পর সমর্থকরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে নেচে-গেয়ে উদযাপন করে বিজয়ের আনন্দ। এই আনন্দকে আরো একটু উসকে দেয় আতসবাজির মনোরম প্রদর্শনী।


১০.

আজ শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে গেলাম কাতারের দোহার সর্ববৃহৎ জাতীয় মসজিদে। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় সংস্কারক শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের নামে মসজিদটি সমধিক পরিচিত। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো মসজিদটি ২০০৬ সালে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালে।

সুপরিসর কমপ্লেক্সের ১ লাখ ৭৫ হাজার বর্গমিটারের মধ্যে ১২ হাজার বর্গমিটার জায়গায় নির্মিত হয় মূল ভবন। মসজিদটি ৩০ হাজার মুসল্লি ধারণে সক্ষম। এর রয়েছে ৯৩টি গম্বুজ। এর ভেতর ৬৫টি গম্বুজে তৈরি হয়েছে আয়তাকার বিশাল বারান্দা। বাকি ২৮টি বড় গম্বুজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে মসজিদের কেন্দ্রীয় পরিধি। প্রধান ৩টি দরজাসহ মোট প্রবেশ পথ ২০টি। মসজিদের পূর্বদিকে বেলেপাথর মোড়ানো উঠোন। প্রায় ৪ হাজার বর্গমিটার আন্ডারগ্রাউন্ডসহ তিন তলার এই মসজিদে রয়েছে অজুখানা, লাইব্রেরি, হিফজখানা, বিশ্রামাগার ইত্যাদি। 

১৫ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। মসজিদের ভেতর রয়েছে অসাধারণ নকশা, ঝাড়বাতি ও নির্জন পরিবেশ। অমুসলিম পর্যটকদের জন্য মসজিদ পরিদর্শনের সুযোগ রয়েছে। 

অভিভূত হলাম এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণ-সৌকর্য আর বিশালত্বে। মসজিদের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। এখানে নারীরা আলাদাভাবে নামাজে অংশ নিতে পারেন।

আজকের জুমার নামাজ এই মসজিদে আদায় করেছেন ভারতের বিখ্যাত ধর্মীয় চিন্তাবিদ ডা: জাকের নায়েক। নামাজ- শেষে তাঁর সঙ্গে মুসল্লিদের সেলফি তোলা নিয়ে যে হুটোপুটি দেখলাম তা রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ।


১১.

শেষ হয়েছে কাতার বিশ্বকাপের ঘটা। কিন্তু গা থেকে সে এখনো খুলে ফেলেনি আলো ঝলমলে পোশাকটি। রাস্তাঘাট আলোর বন্যায় ভাসছে পূর্বের মতোই। গত রাতে ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে বেরিয়েছিলাম মল অব কাতার দেখতে। এডুকেশন সিটি পার হয়ে গাড়ি ছুটছিল আলোর তুফান চিরে। রাস্তার দু’পাশে বহুবর্ণ আলোর ঝলকানি। এই আলোর আয়োজনে এখনো ডুবে রয়েছে পুরো শহরের গা-গতর। 

বাণিজ্যের সঙ্গে বিনোদন---দুটো যে একই তারে বেঁধে নেয়া যায়, মল অব কাতার না-দেখলে সেটা বিশ্বাস হবে না। প্রথমেই খটকা লাগবে এটা কি কোনো বিনোদন কেন্দ্র, নাকি বিপণিবিতান! এর সাজ-সজ্জা, আলোর বিন্যাস, ঝর্ণার ছলাকলা, উড়ন্ত বলাকা, মস্ত-স্তম্ভের গা-বেয়ে জড়ানো দৃষ্টিনন্দন সবুজের সমারোহ, পানির ফোয়ারা-বেষ্টিত জলাধারের চারদিকে নর-নারীর মগ্ন আড্ডা, শিশুদের ছোটাছুটি, বড় স্ক্রিনে লাগাতার ভেসে-ওঠা ছবির আকর্ষণ, খোলামেলা পরিসরে অসংখ্য কাফে-রেঁস্তোরা, রুচি-স্নিগ্ধ সবুজ-বান্ধব প্রশস্ত দোকানপাট---সব মিলিয়ে এক ভিন্ন অনুভূতি ছুঁয়ে যায় দর্শকের মনে। শুধু সদাই-পাতির চিন্তা মাথায় নিয়ে এখানে আসে না কেউ। বরং আয়েশে-জড়িয়ে এক মহা আনন্দ-ভুবনে ভাসতে ভাসতে মন-ভালোর সওদা বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে সবাই।


১২.

কাতারে আসার আগে একটু আশংকা ছিল। কেমন হবে দোহার আবহাওয়া? 

রাজন অভয় দিয়েছিল। শীত-গরম পুরোটাই স্বাভাবিক। কোনো বাড়াবাড়ি নেই। তবে ভগ্ন শরীর বলে কথা। 

আশির দশকে যখন মরুর দেশে ছিলাম সে সময়টা ছিল অন্য রকম। গায়ে তেজ ছিল। ফুরফুরে বয়স। সময়ের ফেরে এখন অনেক হিসেব করে চলতে হয়। তাই সাতপাঁচ ভেবে ছিটেফোঁটা গরম কাপড় ভরে নিয়েছিলাম সুটকেসে।

দোহায় পা দিয়ে চমৎকৃত হলাম। 

এতো আরব নয়। দিব্যি পদ্মাপাড়ের হাওয়া বইছে। খুশিতে বাক বাক করে উঠলাম। 

রোজ ঘুরতে বেরোই হালকা পোশাকে। মন চাইলে একটা জ্যাকেট ফেলে রাখি কাঁধে।

না-হলেও ক্ষতি নেই। রাজনতো দেখি টি-শার্টেই চালিয়ে নিচ্ছে দিব্যি।

গতকাল সকালে সব নিয়ম ভঙ্গ করে হঠাৎ শুরু হলো রুমুঝুুমু বৃষ্টি। টেরই পেতাম না কিছু। সময়ের হেরফেরে ঘুম ভাঙে সামান্য দেরিতে। জেগে দেখি বউমা মুন বারান্দা থেকে কাপড়-চোপড় তুলে সব নিয়ে এসেছে ঘরে। ওদের একটা চমৎকার খোলা-বারান্দা আছে। ওখানে বসে আকাশ দেখতে দেখতে চা-কফি খাওয়া চলে। আড্ডাও জমে দারুণ। বল-ছোড়ার একটা নেটহোল বসানো আছে দেয়ালে। তবে বারবিকিউর জন্য জায়গাটুকু একশোতে একশো। 

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে মন নেচে উঠল। তিন বছর পর বৃষ্টি নেমেছে কাতারে। আহা, কী আনন্দ, কী আনন্দ! ওরে তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

বৃষ্টি পেয়ে বাংলার সরু নালায় ছড়বড় করে ওঠা ছোটমাছের মতো তিড়িংবিড়িং মেতে উঠল কাতারি তরুণরা। তারা রাস্তায় নেমে নেচে-কুঁদে স্বাগত জানাল পরম-আরাধ্য বৃষ্টি উৎসবকে। নাতি আহনাফ বৃষ্টিটাকে ছবি করে রাখল তার খুদে ক্যামেরায়।

দিনমানের এই বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল বহু এলাকার গাড়ির চাকা।

আমরা সন্ধ্যায় লুসিয়ানার পথে বেরোলাম ভেনডম দেখতে। 

বৃষ্টিস্নাত চমৎকার রাস্তা। দুপাশের গাছগুলো মাতাল বৃষ্টির চুমুতে হেসে কুলুকুলু। ফুলেরা নাচছে পেখম খুলে---আমাকে দ্যাখো, আমাকে দ্যাখো..।

আমি দেখেও দেখি না কিছুই। হঠাৎ শীতের মধুর ওমে শুধুই ঘুম ডেকে নিই চোখে....।


১৩.

বিশ্বকাপের দামামা শেষ। আমাদেরও সময় হলো বাড়ি ফেরার। এই মাসকাবারি ভ্রমণটি ছিল অনেকটা ঘোরের মতো। প্রবাসী ছেলের পরিবারে নাতিদের সঙ্গে গালগল্পে কী করে যে সময়টুকু ফুরিয়ে গেল টেরই পেলাম না! 

এসেছিলাম বিশ্বকাপের টিকিট হাতে নিয়ে। তবে খেলাটা যত না উপভোগ করলাম, তার চেয়ে বেশি চোখ-জুড়ালো বিশ্বসেরা এই ছোট্ট ধনী দেশটি দেখে। এই আলগা চোখের দেখায় হয়তো মন ভরেনি। তবে ওপর ওপর দেখার যে অভিনয়টুকু হলো তার মূল্যও নেহায়েত কম নয়। একটি দেশকে

লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে দেখা যায় না। এর ওপরতল বুঝতে হলে আরো গভীরে যেতে হয় একজন ডুবুরির মুক্তা তোলার মতো। 

আমি গবেষক নই। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে দেখার ধৈর্য ও শারীরিক জোর আয়ত্তে ছিল না যথেষ্ট। তবে ভাঙা শরীর নিয়ে ছোটাছুটির ফাঁকে সামান্য হয়তো নিতে পেরেছি সেঁকে। এই দেখার নির্যাসটুকু  জেলেপল্লীর মুক্তার নানান কিস্তিতে বয়ান করেছি যৎসামান্য।

তবে বাক্স-গোছানোর আগে কেবলই মনে হচ্ছে, কতটুকু দেখা হলো দেশটির? যে-দেশটি স্রেফ একটি জেলেপল্লীকে রূপকথার জাদুতে মাত্র কয়েক দশকে হর্ম্য-প্রাসাদ বানাতে পারে তাকে এত চট করে বোঝা সহজ নয়। 

কাতার দেশটি মাটির। তেল তার সম্বল। ধূধূ মরুভূমি খুঁড়ে আহরণ করেছে তেল-গ্যাসের ভাণ্ডার। যা রূপান্তরের মাধ্যমে সাজিয়েছে ভাগ্যের ঘুঁটি। এই অর্জন তাকে পৌঁছে দিয়েছে সেরা ধনীর শীর্ষে। কিন্তু রোম যেমন একদিনে গড়ে ওঠেনি, কাতারও নয়। জন্মাবধি তাকে হতে হয়েছে নানা দলাদলির শিকার। প্রতিবেশীদের আক্রোশ। হাঙ্গামা। তবে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একসময় সে দাঁড়িয়েছে মেরুদণ্ড টানটান করে। এজন্য দরকার ছিল সত্যিকারের সৎসাহস, দেশপ্রেম আর লক্ষ্যস্থির পরিকল্পনা। 

১৯৯৫ সালে সাবেক আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি এই অসাধ্য কাজটি সূচনা করেছিলেন বাবা শেখ খলিফাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে। এর মাশুলও তাকে গুনতে হয়েছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে। কিন্তু শেখ হামাদের মরুরক্ত বোধহয় অন্য ধাঁচে তৈরি। তিনি শক্ত হাতে হাল ধরলেন আরব উপসাগরের ১১ হাজার ৫২১ বর্গমিটারের ছোট্ট দেশটির। যার জনসংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার। বাকিরা বিদেশী, অভিবাসী। এই ছোট্ট দেশটির খোলনলচে পাল্টে স্বনির্ভর আধুনিক কাতার গড়ার মানসে হাতে নেন সুদূরপ্রসারী বহুমুখী পরিকল্পনা। দেশটির নীতিকৌশলে আনেন আমূল পরিবর্তন। এই লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে স্ত্রী শেখ মোজাহ বিনতে নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কাতার ফাউন্ডেশন। শায়খা মোজাহ আর দশজন শেখের স্ত্রীর মতো নন। ফ্যাশন আইকন হিসেবে খ্যাত এই মহিলা কাতারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে সাজান পশ্চিমা ধাঁচে। কাতার ফাউন্ডেশন ও এডুকেশন সিটি প্রতিষ্ঠায় মোজাহ নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। 

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাতারের ভাবমূর্তি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে কাতার ফাউন্ডেশন। রূপকল্প ২০৩০-এর অংশ হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার মাধ্যমে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় দেশটি। এক্ষেত্রে কাতার ফাউন্ডেশন দায়িত্ব পালন করছে বাতিঘরের মতো। ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য হলো কাতারের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও গবেষণায় দক্ষ করে গড়ে তোলা। চার দেয়ালের বন্দী নারীরা নারী-শিক্ষার সুফল প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করছে। কাতারের ৪২ শতাংশ নারীই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। শিক্ষায় পশ্চিমা মান অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে কাতারের। দেশীয় মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে দেশটিতে। 

কাতার ফাউন্ডেশন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, খেলাধুলা, বিনোদন পর্যটন সবক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। কাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি, চমৎকার ক্যালিগ্রাফি অঙ্কিত বিশ্বনন্দিত কাতার ফাউন্ডেশন মসজিদ, রিসার্চ সেন্টার, অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের সিদ্রা হাসপাতাল, সন্তান জন্মগ্রহণের ক্রমধারার আশ্চর্য সড়ক-ম্যুরাল, প্রশাসনিক অফিস, এডুকেশনাল সিটি স্টেডিয়াম, নয়নাভিরাম অক্সিজেন পার্ক, বৃক্ষশোভিত চমৎকার রাস্তাঘাট, দেশি-বিদেশি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাস, ট্রাম লাইন, বহুতল পার্কিং---পুরোটাই একই ফ্রেমে বাঁধা হয়েছে এডুকেশনাল সিটির নান্দনিক প্রেক্ষাপটে।

তেল সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনার জন্য বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নানা লাভজনক খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে কাতার। যে-কারণে বিশ্বকাপের মতো গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ আয়োজনে তারা নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরতে পিছপা হয়নি। হয়তো প্রশ্ন জাগে, বিশ্বকাপে ২২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কী পেলো কাতার? মোটাদাগে লাভের অঙ্কে কিছুই হয়ত নগদ যুক্ত হয়নি দোহার রাজকোষে। কিন্তু বিশ্বকাপ সামনে রেখে তারা শিল্পীর ছোঁয়ায় গোটা দেশকে সাজিয়ে নিয়েছে নতুন এক রূপকথার ভুবনে। যার সুফল ধীরে ধীরে ঘরে তুলবে নানা সূত্র ধরে। বিশ্বকাপের মাধ্যমে অচেনা কাতারকে তারা ব্র্যান্ডিং করতে চেয়েছিল বিশ্বদরবারে। এ ব্যাপারে তারা ষোলআনা সার্থক। অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণি, বিনোদন ও পর্যটন খাতে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও, তাদের আটটি স্টেডিয়াম প্রস্তুত আগামী বিশ্বঅলিম্পিক আর টেবিল টেনিস আয়োজনে। ক্রিকেট দুনিয়াকেও হয়তো ভবিষ্যতে স্টেডিয়ামের জন্য দুবাইয়ের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না আর। হলিউডের শুটিংয়ের জন্য অচিরে হয়তো প্রথম পছন্দের তালিকায় উঠে আসবে কাতারের নাম। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সব বাণিজ্যতরী এসে ভিড়বে দোহা বন্দরে। 

বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একজন উচ্চশিক্ষিত চৌকস শাসক। এই তরুণ আমির তাঁর মেধা আর দক্ষতা দিয়ে বাবা-মার লালিত স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। ইসলামী পরিমণ্ডলের নানা বিরোধের দূতিয়ালির পাশাপাশি কাতার একদিন বিশ্বনেতৃত্বে ভূমিকা রাখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ