মেহমান

মেহমান

গল্প শাহীন সুলতানা এপ্রিল ২০২৪

পুরো রমজান মাসজুড়ে স্কুল বন্ধ। রমজানের ছুটি পাওয়ায় লাবিব ও আমিরা দু’জনেই মহাখুশি। কেননা, রমজান মাস মানেই একটা আলাদা রকম ভালোলাগা একটা অনন্য অনুভূতি। বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসটি একবারেই ভিন্ন। সারাদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার থেকে বিরত থেকে সন্ধ্যায় ইফতার আনন্দ, শেষরাত্রে সাহরি গ্রহণ এক অন্যরকম অনুভূতি আনে মনে। রমজান এলেই দুই ভাইবোন পাল্লা দিয়ে রোজা রাখে এ মাসে। যদিও আমিরার বয়স সাত বছর তবুও লাবিবকে দেখে সেও রাজা রাখার জন্য বায়না করে। সাহরিতে সবার আগে আমিরাই উঠে পড়ে। আমিরার কাণ্ড দেখে মা-বাবা হেসে কুটিকুটি হন।

প্রতিদিন ইফতারিতে নানাপদের আয়োজন করা হয়।

মিষ্টি, পেঁয়াজু, ছোলাভুনা, মুড়ি, মুচমুচে বেগুনি, কুড়মুড়ে মাংসের চপ, ডালের বড়া, হরেক রকম শরবত মা নিজে হাতে তৈরি করেন। বাবাও সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে মায়ের কাজে সাহায্য করেন। ফল কেটে প্লেটে সাজিয়ে দেন। দাদি অসুস্থ। বাবা তাই নিজের হাতে খাবার মাখিয়ে দাদিকে খাইয়ে দেন। রাফেজা খালাও নিজ পরিবারের মানুষের মতো মা-বাবাকে হাতে হাতে সমস্ত কাজে সহযোগিতা করেন।

মা-বাবা অফিস গেলে সারাদিন রাফেজা খালাই এ বাড়িকে আগলে রাখেন, দাদিকে দেখাশোনা করেন। 

লাবিবের খুব ছোটোবেলা থেকেই রাফেজা খালা এ বাড়িতে আছেন। ভোর না হতেই আঙিনা পরিষ্কার, ধোয়ামোছা, মায়ের রান্নার কাজে সাহায্য, দাদির দেখভাল সব রাফেজা খালাই করে। সারাদিনের কাজ গুছিয়ে মা স্কুল থেকে ফিরলেই রান্নাবান্না শেষে রাতের খাবার নিয়ে তিনি নিজের বাড়িতে চলে যান। 

মায়ের মুখে লাবিব শুনেছিল, রাফেজা খালারও লাবিবের বয়সি একটি প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। কথা বলতে পারে না। রাফেজা খালা কাজে এলে বড়ো মেয়েটি অসুস্থ ভাইটিকে দেখাশোনা করে। 

সংসার চালানোর জন্য কিছু টাকা আর তিনবেলা  খাবারের জন্য রাফেজা খালা এ বাড়িতে কাজ করেন। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সেদিন লাবিবের খুব কষ্ট হয়েছিল।

ঈদের আর মাত্র একদিন বাকি। চারিদিকে হইহই রইরই  উৎসব। দাদির জন্য হালকা সবুজ রঙের নতুন শাড়ি  মায়ের জন্য জামদানি, বাবার জন্য ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি, লাবিব আর আমিরার জন্যও কেনা হয়েছে বাহারি পোশাক, দামি আতর আর নানারকম খেলনা। রাফেজা খালার জন্যও আনা হয়েছে শাড়ি, স্যান্ডেল আর প্রয়োজনীয় জিনিস। 

কিন্তু কী আশ্চর্য! রাফেজা খালা ঈদের আগের দিন  কাজে আসেননি। সকাল গড়িয়ে দুপুর রাফেজা খালার খোঁজ নেই। দুপুরে সংবাদ পাঠিয়েছেন- তার প্রতিবন্ধী ছেলেটি বড়ো অসুস্থ! দু’দিন ধরে কিছুই খাচ্ছে না। কথা বলছে না। মায়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে আর চোখ বেয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। 

সন্তানের এমন অসহায় অবস্থা দেখে রাফেজা খালা ভেঙে পড়েছেন। কান্নাকাটি করছেন। 

সংবাদ পেয়ে রাতুলের খুব মন খারাপ হলো। খুব ইচ্ছে হলো- একবার রাফেজা খালার বাড়িতে গিয়ে খোকনকে দেখে আসতে। খোকন তারই বয়সি। কথা বলতে পারে না, হাঁটতে পারে না। স্কুলে যেতে পারে না। খেলাধুলাও করে না। সারাদিন বারান্দায় বসে থাকে। রাফেজা খালা বাড়ি গেলে তারপর খোকন সারাদিনের খাবার খায়। খোকনের জন্মের পর তার বাবাও নিরুদ্দেশ। কখনো বাবার আদর পায়নি সে। বাবা পাশে থাকলেও ডাক্তারের কাছে নিতে পারতো খোকনকে। চিকিৎসা পেলে খোকন হয়তো অসুস্থ থাকতো না। এমনি হাজারো প্রশ্ন লাবিবকে তাড়া করে ফেরে। ছোট্ট আমিরাকে ডেকে খোকনের গল্প বলে সে। 

বলে- চলো আমিরা, আমরা বাবা-মায়ের সাথে রাফেজা খালার বাড়িতে গিয়ে খোকনকে দেখে আসি। বাবাকে বলে খোকনকে ডাক্তার দেখাই। খোকন সুস্থ হলে নিশ্চয়ই সেও স্কুলে পড়তে পারবে। খেলতে পারবে। আমরাও আরেকজন খেলার সাথি পাবো। তখন রাফেজা খালাও অনেক খুশি হবে। আর তাঁর কষ্টও দূর হবে। আমিরা সে কথা শুনে মাথা নাড়ে।

যেই কথা সেই কাজ। বাবাকে বলার সাথেই লাবিব আর আমিরাকে নিয়ে মা-বাবা রাফেজা খালার বাড়িতে গেলেন। সবাইকে দেখে রাফেজা খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। খোকন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে লাবিব আর আমিরার দিকে। কী যেন বলতে চায় বলতে পারে না। খোকনকে দেখে সবার চোখে পানি চলে এলো। 

ইকরামুল হক অ্যাম্বুলেন্স কল করলেন। ঈদের রাতে খোকনকে হসপিটালে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার জানালেন- ‘উন্নত চিকিৎসা আর মায়ের পরিচর্যা পেলে একদিন খোকনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে কথা বলতে পারবে। প্রয়োজন চিকিৎসা, ধৈর্য আর আল্লাহর ওপর ভরসা।’

একথা শুনে সবাই যেন আশ্বস্ত হলেন। 

লাবিব বললো- বাবা, আজ থেকে তাহলে খোকন, রাফেজা খালা আর মিনি আপু আমাদের বাড়িতে থাকুক। ওদের আপাতত আর বাড়ি ফিরে যাবার দরকার নেই যতদিন না খোকন সুস্থ হচ্ছে। খোকনকে আমরা না দেখলে কে দেখবে বাবা? রাফেজা খালার এত টাকা নেই খোকনকে চিকিৎসা করানোর।

একবার চিন্তা করে দেখো- রাফেজা খালা তার নিজের সন্তান খোকনকে বাড়ি রেখে এসে আমাকে মায়ের স্নেহে বড়ো করেছেন। মামণি অফিসে থাকলে আমাকে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছেন।

সারাদিন খোকনকে আদর করতে পারেননি। সন্তানের মতো আমাকে আদর করেছেন।

মিনি আপু আর খোকন আমাদের বাড়িতে থাকলে রাফেজা খালা আমাদের সাথে ওদেরও দেখাশোনা করতে পারবে। তাহলে খোকনও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। 

তুমিই তো বলেছো, ‘মানুষের ওপর দয়া করলে মহান আল্লাহ পাক খুশি হন, আল্লাহও তাঁর ওপর দয়া করেন।’ 

লাবিবের কথা শুনে ইকরামুল হকের চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। লাবিবকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা! তোমার কথাই থাকবে। কাল সকালে খোকন, মিনি আর রাফেজা খালা বাড়ি না ফিরে আমাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে উঠবেন। আমরা সবাই একসাথে ঈদ উদযাপন করবো।’

লাবিব আর আমিরা খুশিতে কী মজা! কী মজা! বলে চিৎকার করে উঠলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ