মেঘ ভাঙা রোদ   -আবুল হোসেন আজাদ

মেঘ ভাঙা রোদ -আবুল হোসেন আজাদ

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ছেলেটি ভ্যান চালায়। গায়ের রঙ তামাটে। কোঁকড়ানো ছোট ছোট চুল। দেখলে মনে হবে যেন আফ্রিকান নিগ্রো। নাক চ্যাপ্টা। বয়স এগারো পেরোয়নি। প্রায় প্রতিদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়। অফিসে যাতায়াতের পথে। বাস থেকে নামলেই ছুটে আসে আমাকে নেয়ার জন্য। ও জানে আমি ঠিক কোন সময় বাস থেকে নামি। তবে প্রতিদিন যে ওর সাথে দেখা হয় তা নয়। ও থাকলে আমি আর অন্য কারো ভ্যানে উঠি না। ওর প্রতি যেন একটু আলাদা মায়া পড়ে গেছে। ছেলেটির নাম করিম।
আমাদের মফস্বল শহর সাতক্ষীরা। আগে এখানে প্রচুর রিক্সা চলত শহরের রাস্তায়। এখন আর রিক্সা নেই বললেই চলে। হঠাৎ দু-একটা চোখে পড়ে। রিক্সার ভাড়া বেশি। তাই তেমন যাত্রী মেলে না। সবাই ভ্যানে চড়তে চায়। তাই রিক্সা চালকরা এখন রিক্সা ছেড়ে দিয়ে ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।
একদিন করিমের ভ্যানে বসে ওর কথা শুনলাম। বাড়ি শ্যামনগরের বংশীপুরে। বাবাকে সুন্দরবনের বাঘে খেয়েছে দেড় দুই বছর হলো। বাবা ছিলেন মৌয়াল। প্রতি বছর সুন্দরবনে ফরেস্টার অফিসের পাশ নিয়ে মৌয়ালদের দলে মধুর চাক ভাঙতে যেতো। বড় নৌকায় জঙ্গলের ভেতরের নদীতে নৌকায় থাকত মৌয়ালদের দল। এক মাস কিংবা তারও বেশি। তার পর মধুর চাক ভাঙা শেষ হলে ওরা বাড়ি ফিরে আসত। মধু বিক্রি করে যা আয় হতো তাতে ওদের মা-বাবা আর ছোটবোনের অভাবের সংসারটা চলে যেতো কোনো রকম।
করিমের বয়স তখন নয়। তখন ক্লাস থ্রিতে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। অন্য বছরের ন্যায় সেবারও মৌয়ালের দলে গেল সুন্দর বনে মধু আহরণে করিমের বাবা। একজন মৌয়াল, থাকে নৌকায় রান্নাবান্নার কাজে। আর বাকিরা চাকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সবাই সন্তর্পণে চারিদিকে চোখ রেখে এগোতে থাকে বনের ভেতর। মৌমাছিদের উড়ে যাওয়া দেখে চাকের সন্ধান মিললেই তবে না মধুর চাক ভাঙা। করিমের বাবা শুকুর আলী কয়টা মৌচাকের গতিপথে উড়ে যাওয়ার দিকে চোখ রেখে এগোতে থাকে। আর তখনই এলো একটি বাঘ। হঠাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগারটি পড়লো শুকুর আলীর ওপরে। ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে ওকে নিয়ে গেলো জঙ্গলের গহিনে। ওর সঙ্গীরা লাঠিসোটা ও বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করেও তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। তারপর তিন-চারদিন খোঁজাখুঁজির পর পেল ছিন্ন ভিন্ন লাশ। করিমের মার চোখে তখন অমাবস্যার অন্ধকার। ওদের দুই ভাই বোনের চোখে শ্রাবণের ধারা। মা সংসারের হাল ধরতে নদীতে নামলেন। নদীতে কোমর পানিতে নেমে জাল ঠেলে গলদা চিংড়ির রেণু ধরে বিক্রি করে দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে লাগলেন। তাতে দিন চলে না। করিমকে তাই স্কুল ছাড়তে হলো। করিমের এক দূর সম্পর্কের চাচার বাসায় থেকে এসে ভ্যান চালাতে লাগলো সাতক্ষীরায়, ছোট বোনটি তখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
দিন যায় মাস যায়। এই ভাবে দিন গড়িয়ে বছর গড়িয়ে গেলো করিমের ভ্যান চালানোয়। আর যা আয় হয় ভ্যান মালিকের রোজকার ভাড়া শোধ করে বাকি টাকা চাচার কাছে জমা রাখে। মাস পুরো গেলে মার কাছে টাকা পাঠায় করিম। চাচার সংসারে আছে। থাকা খাওয়ার খরচ নেই। এই ভাবে চলছে করিমের।
সেবার ঈদে লম্বা ছুটি পড়ে গেল অফিসের। সেই সঙ্গে আমারও কিছু কাজের জন্য আরো কত দিন ছুটি বাড়িয়ে নিলাম। সব মিলে প্রায় দিন পনেরো হবে। করিমের সঙ্গে ক’দিন আর দেখা নেই। এবার ছুটি ফুরালো। এবার অফিসে আসার পালা। বাস থেকে নেমে আর আগের মতো করিমের দেখা পেলাম না। অবাক হয়ে এ দিক চোখ বুলালেও কোনো লাভ হলো না। ভাবলাম আমার ছুটির কারণে এই সময়টা আমার জন্য অপেক্ষা না করে অন্য কোন যাত্রী নিয়ে চলে গেছে।
একদিন দু’দিন করে প্রায় মাস পেরুল, কিন্তু করিমের আর দেখা পাই না। শেষে কয়েকজন ভ্যান চালককেও করিমের কথা জানতে চেয়েও লাভ হলো না। কিন্তু তারাও কোন কিছু বলতে পারলো না। মনে মনে ভাবলাম, করিম হয়তো ফিরে গেছে তার গ্রামে। মনটা খচখচ করতে লাগলো বেচারি ছেলেটার জন্য। ওর গ্রামে গেলে হয়তো খোঁজ পাওয়া যাবে। ভাবলাম একদিন ছুটির দিনে ওর গ্রামে যেয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসবো। ওকে পেলে আমার ভালো লাগবে। যাবো যাবো করেও আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আস্তে আস্তে করিমের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। কর্মব্যস্ততার মাঝে সময় কখন পাড়ি দিয়েছে ঠিক পাইনি। প্রতিদিন মুয়াজ্জিনের ফজরের আজানে ঘুম ভাঙে। আর তখন থেকে শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা সারা দিনের কর্মক্লান্ত অবসন্ন শরীরে রাতে বাড়ি এলেই চোখের পাতায় নেমে আসে ঘুম। কখন নিশাচর পাখিরা ডেকে যায়। কখন শিয়ালের প্রহর পেরুনোর হুক্কা হুয়া শেষ হয়। কখন আরো সন্ধের জোনাকির মিটি মিটি আলো শেষ হয় কিছুই বলতে পারি না।
একদিন বিকেল। বাসায় যাওয়ার জন্য একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছি। তখন আমার বাসে ওঠার রাস্তার পাশে পলাশপোল স্কুলের ছুটি হয়েছে। ছাত্রদের ভিড় রাস্তায়। কেউ ভ্যানে উঠছে, কেউ হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ সামনের একটি ছেলেকে দেখলাম আমার ভ্যানের দিকে এগিয়ে আসতে। ঠিক যেন সেই করিমের মতো। আমি মনে করলাম হয়তো অন্য কেউ হবে। ও আমাকে দেখেই মুচকি হেসে বলল; স্যার ভালো আছেন। আমি অবাক। করিম নিজেই বলল; চাচা আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। আমি ভ্যান থেকে নেমে করিমকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। মনে হলো নিদারুণ বৃষ্টির পর মেঘের কোলে এক পসলা রোদ্দুরের দেখা পেলাম।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ