মৃদুলের পাখিরা

মৃদুলের পাখিরা

তোমাদের গল্প সানজিদা আকতার আইরিন মার্চ ২০২৪

গত চার পুরুষ ধরে লিচু গাছটি বাড়ির সামনে উঠানের শোভা বর্ধন করছে। ঝাঁকড়া মাথায় উঠানের কোণে ডালপালা বিছিয়ে নিজ অস্তিত্বে দাঁড়িয়ে আছে দিব্বি, ঠিক যেন এ বাড়ির অভিভাবক এক। মৃদুলের বয়স সাত। জ্ঞান হবার পর থেকে সে দেখেছে এ গাছটিতে বহু পাখির আনাগোনা ঘটে। তারা নানা কায়দায় বাসা বাঁধে। ছানা ফোটায় বড়ো হয়, আবার সে অন্য কোথাও নতুন করে ঘর বাঁধে হয়তো। এর মধ্যে ময়না পাখির বাসাটা থাকেই সবসময়। মৃদুলের জীবনে অনেক সাবক জন্মাতে দেখেছে এই বাসায়। ছোট্ট ছানা মায়ের সাথে যখন বের হয় ঠিক মতো উড়তে পারে না তাও লাফিয়ে লাফিয়ে চেষ্টা করে। এক সময় ঠিক ফুড়–ত করে উড়ে যায়। ছোটো বেলায় এসব দেখিয়ে দেখিয়ে মা মৃদুলের মুখে ভাত গুঁজে দিতেন, সে টেরও পেত না। বিভোর হয়ে মৃদুল পাখির কাণ্ডকারখানা দেখতো। ফাঁকে তার ছোট্ট পেটের জায়গাটুকু ভরে যেত অনায়াসে। সকালে পাখির কিচির মিচির যেন অমৃত লাগে মৃদুলের। অন্য পাখির মতো বুলবুলিদের লাফালাফিও কম নয় গাছে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে মেতে উঠে কাকের দল। তাদের তুমুল আড্ডায় কান পাতা দায়। গরমের দুপুরেই যেন তারা বেশি মিটিং মিছিল করতে ভালোবাসে। হাত থেকে খাবার নিয়ে পালাতে কাকেদের জো নেই। ডাকাতের দল এক একটা। কিছু শালিক প্রায়ই লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা খুঁজে। আর চড়ুই তো কথাই নেই। লাফানোই যেন তার কাজ। দোয়েল, শ্যামাও ঘোরাঘুরি করে রোজ হয়তো বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে আসে। রাতের বেলা যখন গাছের ডালে পেঁচা আশ্রয় খোঁজে মা ডেকে দেখায় মৃদুলকে। ওরা যে রাত জাগা নিশাচর সেটাও মৃদুল জানে। পেঁচার চোখগুলো মার্বেলের মতো জ্বলজ্বল করে। কিযে দারুণ লাগে মৃদুলের। টুনটুনির বাসাগুলো মাঝে মাঝে খসে পড়ে মাটিতে। তখন খুব চিন্তা হয় মৃদুলের। কী করে ওরা থাকবে? কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দুটি পাতা দিয়ে সুন্দর বাসা বানিয়ে ফেলে। ওরা বেশি বাসা বাঁধে লিচুর তলায় ডুমুর গাছে। পাশের বাদাম গাছে চ্যাঙদোলা হয়ে ঝুলতে থাকা বাদুড়গুলো সারাদিন অলসভাবে কাটিয়ে রাতের বেলায় আহারের খোঁজে ছোটে। মাছরাঙা, টিয়ার দলও এসে ভিড় করে এসব গাছে। তাদের পেয়ারা গাছের কত পাকা পেয়ারা পাখি খেয়ে নেয় তার শেষ নেই। বাবা মা কখনো আধ খাওয়া ফল দেখে মন খারাপ করে না। মৃদুলের খুব রাগ হয়। মা তখন বোঝান পাখিরা আল্লাহর নেয়ামত। তারা ফল খেলে আল্লাহ খুশি হয়ে গাছের মালিকের জন্য বরকত দান করেন। তখন সব রাগ জল হয়ে যায়। আম গাছটি তত বড়ো না হলেও পাখির বিচরণ সেখানেও নিয়মিত। বাড়ির আঙিনায় নতুন দালান উঠবে। জায়গা ও অর্থ সঙ্কট মেটাতে গাছ কাটা ও বিক্রি করাই একমাত্র উপায়। তাই কাটা পড়বে চার পুরুষের সাক্ষী লিচুগাছসহ উঠানের সকল অক্সিজেনের কারখানা সবুজের দল। বর্তমানে গাছগুলোর মূল্যও নাকি পাওয়া যাবে বেশ। তাতে মৃদুলের বাবার অনেকটা প্রয়োজন মিটবে আপাতত। কিন্তু মৃদুলের মনের প্রয়োজনের খোঁজ তারা কেউ রাখেন না। জন্ম থেকে সে পাখিদের সাথে মিতালি করেছে বাবা মা কেউই তার মর্ম বোঝেন না। এমন পুরানো বৃক্ষ এই তল্লাটে নেই বলে অনেকেই দুঃখ করেছে গাছ কাটার শোকে। কিন্তু বাড়ি বানাতে গাছ তো কাটতেই হবে। মৃদুল কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এত পাখির আনাগোনা আর থাকবে না। হবে না বন্ধুদের সাথে পাখির ছানা দেখা। কত পাখি তার বাসা হারাবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না মৃদুলের। অবশেষে এলো গাছ কাটার দিন। একটা একটা ডালের কর্তনে হৃদয়ের ভালোবাসার বাঁধন কাটে মৃদুলের। দুপুর নাগাদ সব গাছের দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। কোন ডালের বাসা থেকে ছিটকে পড়া ময়না পাখির ছানা পিউ পিউ করে কাঁদতে থাকা ছানার শোকে অঝোরে কাদে মৃদুলও। সে কান্নায় জ্বর বাঁধালো সে। ছোট্ট বুকে এত বড়ো ব্যথা সইতে পারেনি মৃদুল। টানা সাত দিন পর সুস্থ হয় বাবার দেয়া আশ্বাসে। আবার একটা লিচুর গাছসহ বেশ কটি গাছ রোপণ করার প্রতিশ্রুতিতে শান্ত হয় মৃদুলের অশান্ত মন। একটু সুস্থ হয়েই বাবা ছেলে মিলে কিনে আনে বেশ কিছু গাছের চারা। নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধে মৃদুল। আবার দেখা পাবে হরেক পাখির সেই অপেক্ষায় কাটে তার বেলা। গাছের গোড়ায় পানি দিতে দিতে রচনা করে ভবিষ্যৎ পাখির আবাস।

কোথায় হারিয়ে গেল তার গাছের পাখিরা মন শুধু খুঁজে ফেরে তাদের। মৃদুলের বাবাও বুঝেছে তার পূর্বপুরুষের লাগানো গাছে তার প্রয়োজন মিটেছে। তাই সন্তানেরও সে সুযোগ পাওয়া প্রয়োজন। নিজে গাছ না লাগালে সন্তানেরও ভবিষ্যতে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই একটি গাছ কাটলে দশটি লাগাতে হবে। না হয় একদিন গোটা পৃথিবী হবে অক্সিজেন শূন্য। আর সত্যিই এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে এসব সোনার পাখিদের আশ্রয়। মিলিয়ে যাবে তাদের অভয়ারণ্য। মৃদুলের মতো পাখি দর্শনের সুখটুকুও পাবে না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বঞ্চিত হবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থেকে। মৃদুলের মনে খুব কষ্ট জমে ওঠে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ