মরুরাখাল মূল : জালালুদ্দিন রুমি অনুবাদ : নাসির মাহমুদ

মরুরাখাল মূল : জালালুদ্দিন রুমি অনুবাদ : নাসির মাহমুদ

অনুবাদ গল্প অক্টোবর ২০২০

একদিন হযরত মূসা (আ) একটি মরুপ্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় এক রাখালকে দেখলেন আল্লাহর দরবারে মোনাজাত দিতে। সে একেবারেই সাধারণ ভাষা এবং পরিভাষা ব্যবহার করে মোনাজাত করছিল। বলছিলো হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার বাসার ঠিকানাটা দাও। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। তোমার দুঃখ-কষ্টে আমি তোমার সমব্যথী হতে চাই। আমার সমগ্র জীবন আমার সকল সম্পদ তোমার জন্য উৎসর্গিত। তুমি তো সেই সত্তা! আমার মেষগুলোর জন্য যেসব গান গাই সেসব তো তোমারই জন্য। রাখাল এভাবে তার অন্তরের কথাগুলো আল্লাহর দরবারে নিবেদন করছিল। মূসা (আ) এ ঘটনা দেখে রাখালকে বললো তুমি কার সাথে এভাবে কথা বলছো, কার কাছে তুমি তোমার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছো?
রাখাল যুবক বললো, আমি এক আল্লাহর সাথে কথা বলছি। যিনি বিশ্বের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। হযরত মূসা (আ) একথা শুনে রাখালকে ধমক দিয়ে বললেন : তুমি আল্লাহর সাথে যেভাবে কথা বলছিলে তা তো কুফরির শামিল। এ ধরনের কুফরি কথাবার্তা বন্ধ করে চুপ থাকো। তুমি যেসব প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলে, সেগুলো তো মানুষের জন্য প্রয়োজন। ঘুমানো, দৈহিক কাঠামো, বাসা-বাড়ি এসব তো মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তো এসবের প্রয়োজন নেই, তিনি তো এগুলোর অনেক ঊর্ধ্বে। তুমি যদি তোমার এ ধরনের কুফরি কথাবার্তা বন্ধ না করো, তাহলে আল্লাহর গজব এসে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। সতর্ক হও। তুমি মানুষের পার্থিব গুণাবলীকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর গুণাবলীর সাথে মিলিয়ে ফেলছো। অথচ আল্লাহ এইসব গুণাবলীর অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন এবং তোমার সেবার প্রয়োজনীয়তা তাঁর নেই।
এটা কী রকম নিরর্থকতা, এটা কী ধরনের কুফরি তোমার নিজের মুখে তুলা ঢুকিয়ে দাও যদি এ ধরনের কথাবার্তা বলা থেকে তোমার কণ্ঠনালীকে রোধ না করো তাহলে আগুন এসে সৃষ্টিজগৎকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে।
হযরত মূসা (আ) ঐ রাখাল যুবকের সাথে এরকম আরো অনেক কথাবার্তা বললেন এবং তাকে সতর্ক করে দিলেন। রাখাল যুবকের মনটা ভেঙে গেল। সে খুবই কষ্ট পেল। মূসা (আ)-এর কাছে সে তার অনুতাপের কথা জানালো। গভীর মনোবেদনায় সে তার জামা ছিঁড়ে ফেললো। ভীষণরকম আফসোস করতে করতে সে মরুপ্রান্তরে হেঁটে বেড়াতে লাগলো। এমন সময় মূসার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নাযিল হলো :
হে মূসা! কেন তুমি আমার বান্দাকে রাগের সুরে কথা বলে ভয় পাইয়ে দিয়েছো। কেন তুমি তাকে আমাদের দয়া ও অনুগ্রহের ব্যাপারে হতাশ করেছো। আমরা তো কখনোই সৃষ্টিকুলের বাহ্যিক দিক দেখে বিচার করি না। বরং মানুষের ভেতরটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভেতরটাই হলো তাদের প্রেম-ভালোবাসা আর প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার চিত্ররূপ। হে মূসা! যে দলটি আমাদেরকে ভালোবাসে, আমরা যাদের প্রিয় এবং কাম্য, তাদের অন্তরটা তো পোড়া, তারা প্রিয় বিরহে কাতর। তারা তাদের মতো করে আমাদেরকে যেভাবে চিনেছে বা বুঝেছে, সেভাবেই তারা আমাদেরকে ভালোবাসে। কাবা শরীফের ভেতরে ঢুকলে যেমন আর ডান-বামের পার্থক্য থাকে না, যে-কোনো দিকে ফিরেই নামায পড়া হোক না কেন, আমাদের দিকেই ফেরা হয়, তেমনি খালেস এবং প্রেমিক বান্দাদের জন্যও এ ধরনের বিশেষ কিছু ব্যাপার। তারা যে ভাষায় বা যে শব্দসহযোগেই ইবাদত করুক না কেন কিংবা তাদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করুক না কেন, সে সবই পবিত্র এবং পছন্দনীয়।
অর্থাৎ আমরা দেখি না বাইরের দিক, দেখি না তো কথা, আমরা দেখি ভেতরটা আর দেখি তার অবস্থা।
এই ঘটনার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এমন এক রহস্য মূসার হৃদয়ে দিয়ে দিলেন যেই রহস্যের কথা না আমি বলতে পারছি, না শুনতে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এইসব কথা শোনার পর মূসা (আ) ঐ যুবক মেষপালকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। খুঁজতে খুঁজতে তাকে পেয়ে গেল। তারপর তাকে বললো:
কোনো রীতিনীতি বা আনুষ্ঠানিকতা খুঁজে কাজ নেই বলো! তোমার বিরহী অন্তর বলতে চায়, যা-কিছুই!
মূসা (আ) আরো বললেন, আল্লাহ তোমার ভালোবাসা, কান্নাকাটি আর রহস্যময় কথাবার্তাগুলো শুনেছেন। তোমার ভালোবাসা, তোমার ঈমান এবং তোমার একনিষ্ঠতায় তিনি খুশি। তুমি যেভাবেই আল্লাহর সাথে কথা বলতে চাও সেভাবেই কথা বলো। তুমি এখন আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী এবং তুমি সত্যে উপনীত হয়েছো। রাখাল জবাবে বললো, যা কিছু বলেছো সবই ঠিক আছে, কিন্তু কথাবার্তার জগৎ ছেড়ে এসেছি এবং আপাদমস্তক প্রেম-ভালোবাসার পথে প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েছি। আমি এই ছোট্ট এবং নশ্বর পৃথিবীর ঊর্ধ্বে উঠে কেবল তাঁরই ধ্যানে মগ্ন রয়েছি।
এ গল্পটিতে যে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হলো, সত্যের অন্বেষণে কেউ যদি আন্তরিকতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে মনোনিবেশ করে তাহলে বাহ্যিক কোনো নিয়ম-নীতির কাঠামো তার জন্য প্রতিবন্ধকতার আড়াল তৈরি করতে পারে না। একনিষ্ঠ অন্তর নিয়ে আল্লাহর সাথে সাদামাটা বা নিজের ভাষায় নিজের আশা-আকাক্সক্ষা বা চাওয়া-পাওয়ার কথা বলা যায়। সর্বোপরি কথা হলো পবিত্র ও খালেস অন্তরের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য বা সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ