ভূমিকম্প

ভূমিকম্প

বিশেষ রচনা জুন ২০১৫

কিশোরকণ্ঠ ডেস্ক # গত ২৫ এপ্রিল নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেলো। বাংলাদেশও কেঁপে উঠেছিলো সেই ভূকম্পনে। আতঙ্কিত মানুষ মুহূর্তেই বেরিয়ে এসেছিলো ঘর থেকে। নেপালে প্রায় সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে এখনও বিজ্ঞানীরা সক্ষম নন। আগামী বছর সেনটিনেল-১এ এর সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে সেনটিনেল-১বি। তখন প্রতি ছয় দিনে একবার জানা যাবে সারা পৃথিবীর সব ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ৬টি প্রস্তাবিত স্যাটেলাইটের মধ্যে সেনটিনেল-১ ভূমি ও সমুদ্রের ওপর সর্বদা রাডার পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরার সময় এটি পুরনো ও নতুন ছবি তুলনা করে বলে দিতে পারে ভূমিতে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
v2
কেন হয় ভূমিকম্প
১৯১২ সালে জার্মানবিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার পৃথিবীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এক সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলো একত্রে ছিল যা ধীরে ধীরে একে অপরের থেকে দূরে সরে  গেছে। ওয়েগনারের এই তত্ত্বকে বলা হয় কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট। এ তত্ত্ব বলে পৃথিবীর উপরিতল কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। একেকটি টেকটনিক প্লেট মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গলিত পদার্থের বাইরের আবরণ যা একটি পাথরের স্তর। ভূস্তরে যা কিছু রয়েছে তা এই প্লেটগুলোর ওপরে অবস্থিত। টেকটনিক প্লেটগুলো একে অপরের সাথে পাশাপাশি লেগে রয়েছে। আবার প্রতিটি স্তর একাধিক প্লেটে বিভক্ত। এগুলো প্রায়ই নিজেদের মাঝে ধাক্কায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও মৃদু, কখনও বা সজোরে। যেহেতু প্লেটগুলো শিলা দ্বারা গঠিত, তাই ধাক্কার ফলে তাদের মাঝে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের মাত্রা অধিক হলে এক ধরনের শক্তি নির্গত হয় যা ভূস্তরকে প্রকম্পিত করে। এসব বিশাল আকারের টেকটনিক প্লেটগুলো যখন একের সঙ্গে অপরে ধাক্কা খায় তখন কেঁপে ওঠে মাটির নিচের তলদেশ। আর আমরা ভূপৃষ্ঠের ওপর ভূকম্পন অনুভব করি। যেখানেই দুটো প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে সেখানেই ঘর্ষণ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এই সংযোগস্থলের নাম প্লেট বর্ডার। আবার আগ্নেয়গিরির কারণেও ভূ-অভ্যন্তরের ভেতর থেকে ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার কোন কোন এলাকায় ভূপৃষ্ঠের গভীর থেকে অতিরিক্ত পানি কিংবা তেল উঠানোর ফলে ভূপৃষ্ঠের অবস্থানের তারতম্য ঘটে।
রিখটার স্কেল কী
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিনই ভূপৃষ্ঠের ভেতরে কোথাও না কোথাও ভূ-কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সবগুলো এত জোরালো নয়। ভূ-কম্পনের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে জমে থাকা শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তিকে মাপা হয় রিখটার স্কেলের মাধ্যমে। সাধারণত এই কম্পনের মাত্রা ১ থেকে ১২ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ৩ থেকে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না। তবে ৫ কিংবা ৬ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেই সেটাকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। রিখটার স্কেলের এক মাত্রা পার্থক্যের অর্থ হচ্ছে আগেরটির চেয়ে পরেরটি ভূত্বকের ভেতর ৩২ গুণ বেশি শক্তিশালী। তবে ভূপৃষ্ঠে এই তীব্রতার পরিমাণ হয় ১০ গুণ বেশি?
v3
ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
আমাদের বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে আবদ্ধ। ফলে এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার ফলে আমাদের দেশে মাঝেমাঝেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তা ছাড়া ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটো হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে রয়েছে এবং ১৯৩৪ সালের পর তেমন কোনো বড় ধরনের নাড়াচাড়া প্রদর্শন করেনি। এ কারণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এই প্লেট দুটো হয়তো নিকট ভবিষ্যতে নড়ে উঠবে যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হবে। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে আমাদের উত্তর ও পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিক্যাল ভাষায় ‘ভূচ্যুতি’ রয়েছে যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ। এ জন্য বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সিলেট, ময়মনসিংহ এবং তৎসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ। এর বাইরে ঢাকা ও রাজশাহী অঞ্চলও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ ভারতবর্ষকে আঘাত হানে যা আজও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর তবে এর প্রভাব বর্তমান বাংলাদেশসহ বহু দূর পর্যন্ত অনুভূতি হয়েছিল। সে সময়ের ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন মিশনারির বিল্ডিং ভেঙে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এ ছাড়াও ঢাকায় ৪৫০ জনের মত নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল যা সেই সময়ের তুলনায় রীতিমত অনেক বড় সংখ্যা।
ভূমিকম্পগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য এ অঞ্চলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মোটামুটি প্রতি v5একশ বছর পরপর এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ১৯১৮ সাল ছিল সর্বশেষ বড় ভূমিকম্পের বছর। এরপর প্রায় এক শ’ বছর কেটে গেছে কিন্তু আর কোন বড় ভূমিকম্প আঘাত করেনি বাংলাদেশকে যা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক আবহাওয়াবিদ এটাও মনে করেন যে ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। আর যদি সেটা ঘটে, তাহলে সেটার ভয়াবহতা হবে মারাত্মক।
তবে স্মরণকালের ইতিহাসে গত ২৫ এপ্রিল শনিবার বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। উৎপত্তিস্থল নেপালের লামজং এ এর মাত্রা ছিলো ৭.৯। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এই কম্পনে কেঁপে উঠেছিলো প্রবলভাবে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও ভুটানেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
v4
ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত
ভূমিকম্পের সময় শক্তিশালী টেবিল বা এ ধনের আসবাবের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। কোন অবস্থাতেই কাচের জানালার পাশে অথবা এমন দেয়াল যা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার পাশে অবস্থান নেয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ভূমিকম্পের সময় আপনি বিছানায় থাকেন, তাহলে সেখানেই থাকুন এবং বালিশ দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখুন। তবে ঝাড়বাতি বা ফ্যান জাতীয় কিছু ঘরে থাকলে সেটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। আশপাশে শক্ত পিলার থাকলে সেটার নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা  গেছে ভূমিকম্পের সময় অধিকাংশ মানুষ আহত অথবা নিহত হন ভূমিকম্প চলাকালীন তাড়াহুড়ো করে অবস্থান পরিবর্তনের সময়। তাই কোন অবস্থাতেই ভূমিকম্প হওয়ার সময় দৌড় দেয়া অথবা দ্রুত বিল্ডিং থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। উঁচু দালানের টপ ফ্লোরে থাকলে ছাদে চলে যাওয়া নিরাপদ কিন্তু যদি দরজা বা রাস্তা পরিষ্কার জানা না থাকে তাহলে ঘরেই অবস্থান নেয়া উচিত। আপনি যদি বাইরে থাকেন এবং ভূমিকম্প হয়, তাহলে বিল্ডিং থেকে দূরে থাকুন। এ ছাড়া আপনি যদি ড্রাইভ করতে থাকেন এবং ভূমিকম্প অনুভব করেন, তাহলে গাছ, বিল্ডিং, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে গাড়ি পার্ক করে থেমে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ