ভুল স্বীকার   -শাহাদাৎ সরকার

ভুল স্বীকার -শাহাদাৎ সরকার

গল্প জানুয়ারি ২০১৮

আমাদের দেশের বাড়ি আসা আজ তিন দিন হলো। বাবার অফিস, মায়ের ফ্যাশন হাউজ, আমার ও সায়মার স্কুলের কারণে গ্রামে আসার সুযোগ হয়ে ওঠে না। প্রায় পাঁচ বছর পর গ্রামে আসার সুযোগ ঘটলো এবার। আর এসেই পেয়ে গেছি পাড়ার দুষ্টুর সরদার গালিবকে। তাকে নিয়ে সারাদিন মজা করে ঘুরে বেড়ানো বনে বাদাড়ে। বিলের মধ্যে দৌড়দৌড়ি। পুকুর মাছের ছুটে চলা দেখা। মাঠিয়াল থেকে নিজ হাতে কাদা ঘেঁটে মাছ ধরা। পাড়ার বড় আমগাছটার ডালে গালিবের বাঁদরের মত ছুটোছুটি। এভাবেই কাটছে আমার সময়। আর সায়মা তো মহা খুশি দাদিকে পেয়ে। দাদির সাথে তার সেকি মজার গল্প। আমাদের নতুন ফ্রিজের রঙটা কেমন। তার পুতুলের মধ্যে কোনটা তার বেশি পছন্দ, কোনটা লম্বা, কোনটা ম্যামদের মত, কোনটার চুল দেখতে দাদির পাকা সাদা চুলের মত। তার এই গল্পের গুণমুগ্ধ আরেকজন শ্রোতা হলো আমার মেজ চাচার মেয়ে বৃষ্টি। কেন যে তার নাম রেখেছিলো বৃষ্টি। যখনি দাদির সাথে বা দাদার সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিতাম আর ও কান্না শুরু করে দিতো। যেন অঝোর ধারায় তার চোখ থেকে বর্ষার বৃষ্টি ঝরে পড়তো। চাচিতো বৃষ্টির কান্নার ভয়ে আমার সাথে কথা বলতেই চাইতো না। তবে এবার বৃষ্টির চোখ অশ্রুশূন্য। অনেকটা বড়ও হয়েছে সে। এবার ক্লাস ফাইভে উঠবে। পড়া নিয়ে মহা ব্যস্ত। সকাল-বিকাল তাকে পড়তে যেতে হয় স্কুলের মাস্টারের কাছে। কারণ এখনো গ্রামে শহরের মতো বাড়ি গিয়ে টিচার পড়াতে শুরু করেননি। ফলে দু’বেলা হেঁটে যেতে হয়। তবে আমাদের আগমন উপলক্ষে তিন দিন যাবৎ তার পড়ার বারোটা বেজে গেছে। তাতে অবশ্য কেউ তাকে কিছু বলেনি। কারণ আমাদের আবার কবে আসার সুযোগ ঘটবে? আবার কবে একসাথে হতে পারবো, কে বলতে পারে? তাই শুধু ঘুরে বেড়ানো আর আনন্দ করা। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যে আজকে এমন একটা ঘটনা ঘটবে কেউ চিন্তাই করিনি। সকালে বাবা মেজ চাচাকে টাকা দেয়ার জন্য আলমারি খুলে দেখে সেখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেই। বাবার তাতে মাথায় হাত। এমন কাজ কে করতে পারে? চিন্তায় বাবার মুখ লাল হয়ে যায়। চাচাতো ভেঙে পড়েছে। তার বাড়িতে চুরি এটা মেনে নিতে পারছেন না। দাদা-দাদি কান্না করছে ছোট ছেলেমেয়ের মতো। আমি অবশ্য একটু আলাদা ধরনের। গোয়েন্দা গল্পের পাঠক হওয়ায় আমার এই বিষয়ে সান্ত¡না দেয়ার চেয়ে টাকাটা কে নিয়েছেÑ তা বের করার প্রতিই আগ্রহ বেশি। আর গোয়েন্দা গল্পের নিয়ম অনুযায়ী কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না। এমনকি নিজেকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা ভালো। তবে আমার সূত্র অনুযায়ী এই টাকা গালিব বা চাচা চাচির কেউ নেবে না। আবার তারা ছাড়া বাড়ির আর কোনো সদস্যও নেই। নেই বললে একেবারে ভুল হবে। আছে কাজের লোক মমিন চাচা। বাবার সমবয়সী তিনি। আমাদের বাড়ির কাজকর্ম করে থাকেন। তবে তার বিষয়ে সে রকম কোনো কথা সাত কালেও কেউ শুনেনি। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। মিষ্টভাষী। যে কোন সময় যে কোন কাজে তাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। বেশ কয়েকবার আমাদের শহরের বাসায় গিয়েছেন। কখনো তিনি কোন কিছু না বলে নেন না। তবে তাকে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে কারণ তিনি কাল বাবার কাছে কিছু টাকার জন্য এসেছিলেন। শুনেছি মমিন চাচার মা ফুলনানি খুব অসুস্থ। ফুলনানির কয়েকদিন থেকে পেটে ব্যথা। কিন্তু চাচার কাছে টাকা না থাকায় তিনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। ফুলনানির চিকিৎসার জন্য সেই টাকা চেয়েছিল। কিন্তু বাবা দিতে রাজি হননি। বলেছিলেন, দেখ মমিন আমার পক্ষে এখন টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তুমি তো জানো এবার মিলাদ করবো বলে বেতনের সব টাকা নিয়ে এসেছি। এখন তোমাকে দিলে মিলাদ সম্পন্ন করা কঠিন হবে। এ কথা শুনে চাচা মন ভারি করে চলে যায়। মমিন চাচা ছাড়া বাবা আর কারও কাছে টাকার বিষয়ে কোনো গল্প করেননি।
বেলা অনেক হয়ে গেলেও টাকার কোনো হদিস মেলেনি। মা দুইবার অজ্ঞান। দাদা-দাদির কান্না আর থামে না। এদিকে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। এর মধ্যে মমিন চাচা মাথা নিচু করে বাবার কাছে এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল আমাদের বসার ঘরে। আমিও পিছু পিছু গেলাম। গিয়ে যা শুনলাম তাতে করে আমারই লজ্জা লাগছিলো। চাচা বাবাকে বললেন, ভাইজান টাকাটা আমিই নিয়েছি। আপনাকে কাল বললাম কিন্তু আপনি রাজি হননি। এদিকে আমার মা পেটের ব্যথায় মারা যায় যায় অবস্থা। ফলে আমি যদিও জানি চুরি করা অন্যায়। কিন্তু একজনকে মরতে সাহায্য করে দশজন লোককে খাওয়ানোই বা কোন ধর্ম সমর্থন করে? যে মরে যাচ্ছে তাকে বাঁচানো কি দরকার ছিলো না? তাই আমি বাধ্য হয়ে কাল রাতে টাকা নিয়ে ছিলাম এটাকে চুরি বললে বলতে পারেন। আবার যদি মনে করেন যে না আমি ঠিক করেছি, আপনার টাকা আমাকে দেয়া উচিত ছিলো তাহলে তো হয়েই গেল। আর তা ছাড়া শাস্তি দিতে পারেন আমাকে। বাবার এই কথাগুলো শোনার পর রাগে চোখ লাল হয়ে যায়। তিনি মমিন চাচাকে হাত ধরে সড়সড় করে টেনে নিয়ে আমাদের থাকার ঘরে চলে যায়। এবং বাকি টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, মমিন আমারই ভুল হয়েছে। আজ যদি আমার মা অসুস্থ হতো তাহলে আমি কি এই টাকা খরচ না করে মিলাদের জন্য রাখতাম। তুমিই ঠিক। বাকি টাকা তুমিই রাখো। চাচির চিকিৎসা করাও। সামনের বার এসে হয় তো মিলাদটা করা যাবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ