ভাষাদিবস প্রসঙ্গে

ভাষাদিবস প্রসঙ্গে

বিশেষ রচনা ফেব্রুয়ারি ২০১৪

হেলাল আনওয়ার

Anawerপাখি গান করে। মুগ্ধ চিত্তে থমকে যায় পথিক। গান শুনে পুলকিত হয়। আন্দোলিত করে তাকে। আসলে এটাই তো পাখির ভাষা। তার আপন সত্তার নির্ভেজাল বহিঃপ্রকাশ। আমরা আমাদের ভাষাকে লালন করি। সর্বাঙ্গে-সর্বাগ্রে আমাদের ভাষাকে উচ্চকিত করে থাকি। সবার সামনে আপন ভাষার গুণগান করতেও বিন্দুমাত্র কসুর করি না। ধর্মভেদ, জাতিভেদ, গোত্রভেদ সব যেন একাকার হয়ে যায় মাতৃভাষার মাঝে। আসলে মাতৃভাষা বলে কথা। মাতৃভাষা না হয়ে অন্য কোনো ভাষা হলে আমাদের মনমগজ ঠিক এভাবে কার্যকর হতো না। তাই আপন ভাষাকে ভালবাসি যেমন ভালবাসি আমার মাকে। এই ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। যা আরাকান রাজসভা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রসনা বিলিয়ে যাচ্ছে। অনেক শার্দুল, জানোয়ারের হিংস্র থাবা কিংবা বিষদাঁত ভেঙে আজ বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা ভাষা আজ স্বয়ংসম্পন্ন। নিজস্ব ভাব এবং শব্দে আপন সত্তায় জাগ্রত এক শক্তিশালী ভাষার নাম বাংলা ভাষা। এই ভাষাকে স্বপ্নের ভাষা হিসেবে পেতে ব্যয়িত হয়েছে অনেক রক্ত। কুচক্রীর করাল গ্রাস থেকে রাহু মুক্ত করতে এই তো সেদিন (১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি) রাজপথের কালো পিচ রক্তবর্ণে পরিণত হয়েছিল। তাদের রক্তের সোঁদা গন্ধে বাতাসে ভেসেছিল মাতৃভাষার সুগন্ধি। শ্লোগানে শ্লোগানে সেদিন সাইক্লোন উঠেছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কী উত্তাপ আর আবেগময়ী জননী জন্মভূমির স্পন্দিত আপনভাষা, আমার মাতৃভাষা বাংলা। তখন ছিল ফাল্গুন মাস। অর্থাৎ আটই ফাল্গুন। মুকুলে মুকুলে বৃক্ষশাখা সেজে আছে। নব পল্লবে পল্লবিত সবুজ শ্যামল এই গর্বের দেশ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশ। সূরের মূর্ছনায় মুখরিত হয় বসন্ত বাতাস। দখিনা সমীরণ আপ্লুত করে বাংলার আটষট্টি হাজার গ্রাম। সহজ সরল গাঁয়ের মানুষ হঠাৎ শুনতে পেল কারা যেন মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিতে চায়। তারই প্রতিবাদে বজ্রনিনাদে উত্তাল ঢাকা। গগনবিদারী চিৎকারে জানিয়ে দিলোÑ এ ভাষা আমার ভাষা, মাতৃভাষা। এ ভাষাকে কেড়ে নেবার সাধ্য কারোর নেই। স্পন্দিত প্রতিটি মানুষ সে দিন প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম শাসকগোষ্ঠীর অগ্রহণযোগ্য বক্তব্যের প্রতিবাদে আপামর ছাত্র-জনতা সেদিন ফুঁসে উঠেছিল। তারপর ইতিহাস কলঙ্কিত করে গুলি চালায় মিছিলে। শহীদ হন রফিক, শফিক, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে। তবুও থামেনি বাঙালি। আন্দোলনকে আরো বেগবান করে ওদেরকে পরাস্ত করে। নির্মম শাসকের শোষণ থেকে মুক্তি পায় আমার বাংলা ভাষা। সেই থেকে বাংলা ভাষা নতুন ব্যঞ্জনায় বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত। রক্ত দিয়ে কেনা আমার স্বপ্নের বাংলা ভাষা। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাংলা আজ পোশাকি বাঙালিদের বিলাসী ভাষা। অনাদরে, অবচেতনে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে আজো বাংলা ভাষা মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে পারেনি। “আজ পর্যন্ত রক্তস্নাত বাংলা ভাষা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে আটই ফাল্গুনে রূপান্তরিত হতে পারেনি।” এই বাংলার অফিস আদালতে স্থান করতে পারেনি। সার্বজনীন সমাদৃত হতে পারেনি এই গর্বের ভাষা। এ যেন নিজ গৃহে পরবাস। যদিও বাংলা ভাষা আজ দেশজ গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, যদিও দিবস পালনে বাংলা ভাষা স্মরণীয় ও বরণীয় তবুও বাংলা ভাষাকে সার্বজনীন করার তাগিদ অনুভব করে না কেউ। বরং বাংলা ভাষার কঙ্কালসার জাপটে ধরে ভাষার প্রতি সাহেবি শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন কর্ণধারগণ। আজ বড় প্রয়োজন এ ভাষাকে অদৃশ্য শেকল থেকে মুক্ত করা। শৃঙ্খল মুক্ত করে এ জাতির প্রত্যাশার মূল্য দিতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ ভাষার ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও প্রচলনের মাধ্যমে বাঙালির প্রত্যাশার মূল্যায়ন করতে হবে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ