বোবা অশ্রু

বোবা অশ্রু

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১২

তাসমিয়াহ্ খানম..
সুমন আজ বন্ধুদের সাথে রোজার চাঁদ দেখবে। এজন্য সে মালিকের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে এসেছে।
সে একটি দোকানের কর্মচারী।
সুমন এসে দেখে মায়ের মুখ মলিন। সে ধরতে পারছে মা দুপুরে বোধহয় কিছুই খায়নি। মা মানুষের বাসায় ঠিকে কাজ করে। বেশি বেতনও পায় না। সুমন দুপুরে মালিকের বাসায় খায়। সে লজ্জায় মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারল না মা খেয়েছে কি না। বলল, মা, সীমান্ত কই?
মা বলল, সীমান্ত ঐ খেলার মাঠে চাঁদ দেখতে গেছে।
সুমন আর দেরি করল না। মাঠে চলে গেল। যেয়ে দেখে সবাই হই হই করছে। চিল্লিয়ে বলছেÑ চাঁদ দেখা গেছে চাঁদ দেখা গেছে।
তার বন্ধুরা কাছে এগিয়ে আসে। সুমন বন্ধুদের তেমন খেয়াল না করে সীমান্তের কাছে চলে যায়। জিজ্ঞেস করে, এই, দুপুরে খেয়েছিস?
সীমান্ত মাথা কাঁত করে জবাব দেয়, হ্যাঁ ভাইয়া, পাশের বাসার চাচীরা আমাকে ভাত খেতে দিয়েছিল।
মা খেয়েছে?
আমি জানি না। বলে সীমান্ত আবার হই-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে।
সীমান্ত ছোট মানুষ। মাত্র পাঁচ বছর বয়স।
সুমন কিছু না বলে বাসায় ফিরে আসে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত ছিল। তাই চুপ করে শুয়ে থাকে।
সাহরীর সময় হয়ে গেছে। কিন্তু সাহরীতে খাওয়ার কিছু নেই। সীমান্তও রোজা রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ওকে ডাকা হয়নি। শুধুমাত্র পানি খেয়ে সুমন ও তার মা রোজা রাখার নিয়ত করল।
মালিক আগেই বলে রেখেছিলেন সুমন প্রতিদিন তার ওখানে ইফতার করবে। কিন্তু সুমন জানে না মা কী দিয়ে ইফতার করে। আদৌ করে কি না তাও তো ও জানে না।
আজ ভাতের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। পরের রোজাটাও ঠিক একইভাবে পানি খেয়ে রাখার নিয়ত করল তারা।
সীমান্ত কাঁদতে কাঁদতে মায়ের আঁচল ধরে বলে, মা, পাশের বাসায় টুকু রোজা রেখেছে। টুটুলও রোজা রেখেছে। কিন্তু তুমি আমাকে কেন ডাকোনি? কান্না জুড়ে দেয় সে।
মা কিছুই বলতে পারে না। কিভাবে বলবে যে শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখলে খুব কষ্ট হয়!
মাকে কয়েকদিনই পাশের বাড়ির এক খালা ডেকে নিয়ে গিয়ে ইফতার করান। মা যেতে চায় না। তারপরও পীড়াপীড়িতে যেতে বাধ্য হয়।
আজ সুমনের বেতন দিয়েছে। সেটা দিয়ে চাল-ডাল আরো জিনিসি কিনেছে। মায়ের দুঃখ তো সে বোঝে। তাই মায়ের কাছে কোনো আবদার করে না। বরং সেই সংসারের টুকটাক কেনাকাটা করে। মাঝে মাঝে ছোট বাইয়ের আবদার মেটায়।
এভাবেই সুমনদের রোজার মাস চলছিল। আর মাত্র দশদিন বাদে খুশির ঈদ। পাশের বাড়ির টুকু সুন্দর লাল ফ্রক কিনেছে ঈদের জন্য। সীমান্ত বায়না ধরেছে, মা আমাকে জামা কিনে দিতে হবে। গতবার দাওনি। বলেছিলে এবার দেবে। না দিলে কিন্তু হবে না!
মা চিন্তায় পড়ে যায়। কী করবে? চোখজোড়া অশ্রুতে টলমল করে ওঠে। কিছু না বলে মা সেখান থেকে উঠে যায়।
মাও বেতন পেয়েছে। সীমান্ত বলে, মা, আমার নতুন জামা!
মা বলে, আচ্ছা বাবা আজ বিকেলেই তোকে নিয়ে বাজারে যাব নতুন জামা কিনতে।
সীমান্তের তো আনন্দের সীমা নেই। বলে, ভাইয়া জানো, আজ বিকেলেই না আমার জামা কিনতে যাব। টুকুর মতো আমিও লাল জামা কিনব। কী মজা! কী মজা! ভাইয়া এবার আমার বন্ধু টুটুল, আমি, তুমি একসাথে ঈদগাহে যাব কিন্তু! তুমি আর টুটুল আমার পাশে বসবে।
সুমন এ কথা শুনে মলিন একটা হাসি দেয়।
বিকেলে সীমান্ত লাল জামা কিনে আসছিল মায়ের সাথে। সে এমনিতেই বেশ চঞ্চল। রাস্তা পার হওয়ার সময় মার হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। মা ওকে ধরতে পারেনি। মা রাস্তা পার হয়ে দেখে সীমান্ত তার সাথে নেই। আশপাশে তাকাতেই দেখে ছেলেটা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাস্তা পার হতে পারছে না।
মা বলল, দাঁড়া বাবা, আমি তোকে নিয়ে আসছি।
কিন্তু সীমান্ত শুনল না। দূর থেকে একটা ট্রাক আসছিল। সীমান্ত না দেখেই দৌড় দিয়ে আসতে গিয়ে ট্রাকের সাথে ঢাক্কা খেল। মার হাত থেকে ব্যাগ পড়ে যায়। ছুটে যায় মা সীমান্ত যেখানে ছিটকে পড়েছে। আরো অনেকেই ছুটে যায়।
রাস্তায় রক্তের যেন বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সবাই ধরাধরি করে সীমান্তকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তার ঘোষণা করলেন সে আগেই মারা গেছে।
মায়ের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়।
খবর শুনে সুমন হাসপাতালে এসে দেখে সবকিছু। তার চোখে তখন শুধু ভাসতে থাকে ভাইয়ের জামা কেনার আগে আনন্দের মুহূর্তটা। রোজার চাঁদ দেখে খুশির হুল্লোড়, রোজা রাখার প্রবল ইচ্ছা, কী মজা! কী মজা! বলার ভঙ্গিটা, একসাথে ঈদগাহে যাওয়ার বাসনার কথা। সুমন এসব ভাবতে থাকে। কিভাবে সে এখন ছোট ভাইটিকে ছাড়া ঈদগাহে যাবে? আর কিভাবেই বা আদরের ছোট ভাইটিকে ঈদের জামার বদলে সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে রেখে আসবে মাটির ঘরে?
সুমনের চোখ দিয়ে শুধুই বোবা অশ্রুরা ঝরতে থাকে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ