বিবেক   -এম ইমন ইসলাম

বিবেক -এম ইমন ইসলাম

তোমাদের গল্প জানুয়ারি ২০১৮

‘বোন এই সিটে বসুন।’ হিন্দু মেয়েটি আমার এই কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর দিকে বিশেষ ভঙ্গিতে তাকালেন, বসবে কিনা অনুমতি চাচ্ছেন যেন। আমার বেশভূষা দেখে তিনি বুঝে ফেলেছেন আমি একজন মুসলিম। স্বামীর কাছে ১-২ মাস বয়সের তাদের নবজাতক। রাস্তার যে বেহাল দশা; তার ওপর গাড়ি ভর্তি মানুষের হইচই-চেঁচামেচিতে অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। জন্মদাত্রী মা যেমন দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট পাচ্ছেন, ঠিক তেমনই স্বামী বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করার নেই, কারণ গাড়ির মধ্যে কোনো সিট খালি ছিলো না। মেয়েটির স্বামী গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন, তারপর মাথা ঝুকিয়ে বসার অনুমতি দিলেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র মেয়েটি ধপ করে সিটে বসে পড়লেন। সাথে সাথে আদরের সোনামণিকে পরম মমতায় নিজের কাছে নিলেন। শ্রাবণের মেঘে ঢাকা মেয়েটির মুখটি মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। স্বামীও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। পরক্ষণেই কেন জানি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। আমাকে যে একবার ধন্যবাদ জানানো উচিত সেটিও ভুলে গেলেন মনে হয়!
পাশে বসা বন্ধু খোকনের দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম! সে এমন কান্ড দেখে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব বেশি রাগ করেছে, রাগ করার যথেষ্ট কারণও আছে। কেননা, রাজশাহী থেকে সেই সকালে ট্রেনে উঠে যশোর পর্যন্ত ২১৩ কিলোমিটার পথের প্রায় সম্পূর্ণটা দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে। ট্রেনের সিট ফাঁকা পাওয়া যায়নি। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে হয়েছে। হাজার হাজার পরীক্ষার্থী বাড়ি ফিরছেন। অনেকেই টিকেট পায়নি, তাই দাঁড়িয়ে আসা।
সারা পথ দাঁড়িয়ে কষ্ট করে এসে বাসের সিটে বসে একটু আরাম করে যশোর থেকে সাতক্ষীরা যাবো, এটিই কাম্য ছিলো। কিন্তু হিন্দু মেয়েটিকে এভাবে দাঁড়িয়ে কষ্ট পেতে দেখে আর আরাম করে বসে থাকতে পারলাম না। বিবেক বাধা দিলো। একটু পরে খোকন আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির স্বামীকে বসতে বললো! আমি কপাল কুচকে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। সে বলল- ‘দেখ, ছোট বাচ্চাকে একা একা সামলাতে পারছেন না, প্রথম মা হয়েছেন তো। পাশে স্বামী থাকলে সাহস পাবেন।’ আমি তার জবাবে মুচকি হেসে বললাম, ‘এই জন্যই তো তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!’
তাদের গন্তব্য স্থল ছিলো ঝাউডাঙ্গা। সেখানে নামার আগ মুহূর্তে মেয়েটির স্বামী মুখে এক চিলতে হাসি টেনে বললেন- ‘আপনাদের বেশভূষা দেখে বুঝাই যাচ্ছে আপনারা মুসলিম। অথচ আমরা অন্য ধর্মের হওয়ার পরও সিটে বসতে দিয়ে নিজেরা কষ্ট করে দাঁড়িয়ে এলেন। সত্যিই আজ আপনাদের ব্যবহারে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি। মুসলিমদের প্রতি আগে থেকে আমার বেশ খারাপ ধারণা ছিলো, যার কারণে ঘৃণা করতাম। আজ থেকে আমার সেই ধারণা বদলে গেলো। সব ধর্মের মানুষ যদি অন্য ধর্মের মানুষদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন; তবে কতই না সুন্দর হতো! কথা দিলাম, সুযোগ হলে আমরাও মুসলিমদের সাহায্য করবো।’
ঘটনাটি ২০০৯ সালের। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মহিলা ও বৃদ্ধদের দাঁড়িয়ে রেখে আমি গাড়ির সিটে বসি না। যখন দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে কোন মা, বোন বা বয়স্ক ব্যক্তি কষ্ট পাচ্ছেন, তখন প্রচণ্ড রকম খারাপ লাগে। সিট থেকে উঠে তাদের বসতে দিতে বিবেক তাড়া দেয়। বিবেক যে কাজে সম্মতি দেয় না, সে কাজ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমারও সম্ভব হয় না।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ