বাবা ফিরে আসেনি

বাবা ফিরে আসেনি

তোমাদের গল্প এপ্রিল ২০১৪

আবদুস সবুর খান

Baba-Fere-aseniআমাদের ক্লাসে নতুন একটা ছাত্র এসে ভর্তি হয়েছে। নাম দিপু। খুব নম্র ও ভদ্র। সবসময় কম কথা বলে। কম হাসে। তার চেহারার মধ্যে কেমন যেন বিষণœতার ছাপ পরিলক্ষিত হয় সবসময়। কী যেন একটা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমার একটা স্বভাব আছে। স্কুলে নতুন কোনো ছাত্র ভর্তি হলে তাকে আমি বন্ধু বানিয়ে ফেলি। তাই দিপুকেও অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু বানিয়ে ফেলেছি আমি। আমিই তার সাথে এখন সবচেয়ে বেশি চলাফেরা করি। তার সাথে চলাফেরা করতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। তাকে কেউ তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দেয় না। বরং মন খারাপ করে। তার বাড়িতে একদিন সে আমাকে নিয়ে যায়। সেখানে তার বড় ভাই ও মাকে দেখেছি। কিন্তু তার বাবাকে দেখিনি। সে মন খারাপ করবে বলে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তারা আমাকে কমল বাবু বলে ডাকেন। আমার নাম কমল হোসেন। একদিন ক্লাসে গণিত শিক্ষক আমজাদ স্যার দিপুকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে বসেন। বলেন, তোমার বাবা কী করে? দিপু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। স্যার কী যেন একটা আন্দাজ করে তাকে বসিয়ে দেন। সেদিন স্কুলে সে সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসেছিল। আমি তাকে হাসাবার চেষ্টা করেছি। সে হাসেনি। ক্লাসের সহপাঠীরা তাকে তার বাবার ব্যাপারে কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে সে অনেক মন খারাপ করে। মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে পানি বের হওয়ার উপক্রম হয়। আমি একদিন বিকেলে দিপুর বাসায় যাই। গিয়ে দেখি দিপু ঘরে নেই। তার মা আমাকে বললেন, কমল বাবু দিপু বাইরে ঘুরতে গেছে। মনটা নাকি ভীষণ খারাপ। আমি দিপুদের বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসি। দিপুকে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ দেখি দিপু একটা আমগাছের নিচে বসে কাঁদছে। আমি তার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসি। তাকে জিজ্ঞেস করি, কাঁদছ কেন দিপু? দিপু আমার দিকে তাকায়। তারপর বলে, ক্লাসের সবাই আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি কিভাবে তার উত্তর দেবো? আমার বাবা যে এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। তার কথা মনে করলে আমার কান্না পায়। আমি বলি, তোমার বাবা মারা গেছেন? বিস্ময়ে প্রশ্ন করি। সে বলে, হ্যাঁ। সে অনেক কাহিনী। দিপু কাঁদতে কাঁদতে তার আব্বার কথা আমাকে বলতে লাগল। ১৯৭১ সাল। গণ-আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। পাক সেনারা এ দেশের মানুষের ওপর পৈশাচিক আচরণ শুরু করেছে। চারদিকে শুধু পাক সেনাদের নির্মমতার হাহাকার। তারা গ্রাম পুড়িয়ে শহর গুঁড়িয়ে লাখ লাখ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে ফেলছে। পাক সেনারা আমাদের গাঁয়ে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরেছে। এ জন্য গ্রামের সবাই এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যে করেই হোক এর প্রতিশোধ নিতে হবে। আমাদের গ্রামের সবাই প্রস্তুত হয় যুদ্ধ করার জন্য। আমার বাবাও তৈরি হন আমাদের মায়া ছেড়ে। আমার বাবা যুদ্ধে চলে যাবার দিন আমাকে কোলে তুলে চুমু খান। আমি তখন ছোট। বাবা আমাকে বলেন, আমি চলে যাচ্ছি সোনা। তোমার জন্য অনেক বেলুন নিয়ে ফিরে আসব। আমি বুঝতে পারিনি কিছু। বেলুন আমার খুবই প্রিয় ছিল। তাই বাবার মুখে বেলুনের কথা শুনে সেদিন ফ্যাল ফ্যাল করে হেসেছিলাম। বাবা মাকে বলে যান, ছেলে দুটোকে মানুষের মতো মানুষ করবে। বাবার একটা ছোট্ট গোপনীয় ঘর ছিল। বাবা সেটাতে তালা দিয়ে মায়ের হাতে চাবিটা তুলে দেন। তিনি বলেন, আমি ফিরে এসে ঘরের তালাটা খুলব। এরপর বাবা চলে যান। দিন যায়, মাস যায়। বাবা ফিরে আসেন না। আস্তে আস্তে দীর্ঘ ৯ মাস কেটে যায়। বাবা তবু ফেরেন না। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের গাঁয়ের একজন এসে বলে, আমার বাবা পাক হানাদারদের বুলেটের আঘাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এইটুকু বলে দিপু জোরে চিৎকার করে বলে, বাবা ফিরে আসেননি। বাবা আমার জন্য বেলুন নিয়ে ফিরে আসেননি। আমিও দিপুর কান্না দেখে কেঁদে ফেললাম। দিপু আবার বলে, মা অনেক কষ্টে বড় ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন আমাকেও স্কুলে পড়াচ্ছেন। সে একটু থেমে থাকে। পরে আবার বলে, বাবার ঘরটাতে এখনও তালা ঝুলছে। বাবা ফিরে এসে আর এ তালা খুলতে পারবেন না। হয়তো চিরকালই এ ঘরটা তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকবে। আমি দিপুকে বললাম, দিপু কেঁদো না। তোমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের গর্ব। দিপু বলে, হ্যাঁ। আমি চাই বাবার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশের জন্য মরতে। দেশের সেবা করে আমি আমার জীবনকে ধন্য করতে চাই। মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। এতেই আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে। আল্লাহ আমাকে সেই তাওফিক দান করুক। দিপু আকাশের দিকে দু’হাত উঁচু করে ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ