বাংলা কবিতায় ভাষা আন্দোলন

বাংলা কবিতায় ভাষা আন্দোলন

প্রবন্ধ নিবন্ধ শাহাদাৎ সরকার ফেব্রুয়ারি ২০২৪

১৯৫২ সালে বাংলাভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের কবি-সাহিত্যিকরা। এসব প্রতিবাদ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে সাহিত্য।

ভাষা আন্দোলন শুরুর আগে অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আব্দুল হাকিম রচিত ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ কবিতাটি মাতৃভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রচিত সার্থক কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বসে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচনা করেন ১২০ লাইনের- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামের কবিতা।

এরপর আন্দোলনকালীন সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো!’ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ শিরোনামের এই কবিতাটিকে দ্বিতীয় এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ভাঙার দিনে লুৎফুর রহমান জুলফিকার রচিত ৬৩ পঙক্তির দীর্ঘ কবিতাকে একুশের ওপর লিখিত তৃতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।

দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কবিরাও লিখতে থাকেন তাঁদের অমর পঙক্তিমালা- 

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?

বরকতের রক্ত।


হাজার যুগের সূর্যতাপে

জ্বলবে এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে

কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

(আল মাহমুদ)

১৯৫২ সালের সেই উত্তাল সময়ের চিত্র এভাবেই তুলে ধরেন কবি আল মাহমুদ। ভাষা আন্দোলন যে আমাদের চেতনায় আশার বীজ বপন করেছিল তার রূপ পাওয়া যায় কবি আসাদ চৌধুরী সৃজিত নি¤েœাক্ত পঙক্তিমালায়-

ফাগুন এলেই পাখি ডাকে

থেকে থেকেই ডাকে

তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।

আমি যে তার নাম রেখেছি আশা

নাম দিয়েছি ভাষা, কত নামেই ‘তাকে’ ডাকি

মেটে না পিপাসা।

দেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে ভাষিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে রচিত হতে থাকে গান। গান একটি শ্রুতি মাধ্যম। গান দিয়ে অতি সহজে মানুষের মননের কোষে ঝংকার তোলা যায়- চেতনা জাগানো সম্ভব হয়। যে কারণে বাঙালির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নিয়েও রচিত হয়েছে অনেক গান। গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা। কবিদের মধ্যে থেকে সর্বপ্রথম বাংলাভাষার পক্ষে গান রচনা করেন ফররুখ আহমদ। গানে গানে বলেছেন-

ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা

খোদার সেরা দান

বিশ্বভাষার সবই তোমার

রূপ যে অনির্বাণ।

যশোরের কবি শামসুদ্দীন আহমদ রচিত ‘ভুলব না ভুলব না, ভুলব না আর একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গানটি ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের ওপর প্রথম রচিত গান। তবে আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কালের বিবর্তনে। যেমন-

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।

এই কবিতার বজ্র শাব্দিক দাবি সেদিন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। কবিতার মাধ্যমেই আছড়ে পড়ল ক্ষোভ, দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইল সকল অন্যায় অবিচার। তখনকার বিরূপ সময়ে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণসম এমন কবিতা লেখার সাহস কম প্রশংসাযোগ্য হতে পারে না। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে কবিতাটি গান হয়ে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই গানটির সুর বারবার আমাদের জানান দেয় একুশের মাহাত্ম্য আর বাংলাভাষাপ্রীতির কথা।

মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। যে কারণে বাংলাভাষা আজ সর্বজনীন ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ বাঙালির জন্মের অহংকার। আর বাংলাভাষা বেঁচে থাকার অলঙ্কার। জাতির ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলাভাষায় রচিত সাহিত্যে আত্মমুক্তির যে ঋদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল, বুদ্ধিবৃত্তিক যে চেতনা সম্প্রসারিত হয়েছিল কাব্যচেতনায়, তা এখনো প্রবহমান। 

একুশ নিয়ে পরাবাস্তবতার কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটি সমৃদ্ধ। কবিতাটি একটু ব্যতিক্রমও বটে। 

পাড়ায় পাড়ায় নাটক-ব্রতচারী নাচ-

মুকুলের মাহফিল-কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুল

আর সবুজের স্বরগ্রাম :

কলাপাতা-সবুজ, ফিরোজা, গাঢ় সবুজ, নীল,

তারই মধ্যে বছরের একটি দিনে

রাস্তায় রাস্তায় উঠে আসে মুষ্টিবদ্ধ হাত

‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই!’

আবার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় কবি এক দুঃখিনী মায়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন। শামসুর রাহমানের ‘বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে’ কবিতায় প্রগাঢ় মানবজীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন- 

‘...বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে/ কত চেনা ছবি; মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন ঘুম পাড়ানিয়া ছড়া.../ নানি বিষাদ সিন্ধু স্পন্দে দুলে দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া/ আর একুশের প্রথম প্রভাত ফেরি, অলৌকিক ভোর।’

এ ছাড়া একুশের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতার মধ্যে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘একুশের গান’, সুফিয়া কামালের ‘এমন আশ্চর্য দিন’, মাজহারুল ইসলামের ‘স্বাগত ভাষা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’, কায়সুল হকের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘স্মৃতির মিনার’, আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’ ওমর আলীর ‘বেদখল হয়ে যাচ্ছে’, শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘বর্ণমালা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’ উল্লেখযোগ্য।

৫২ পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় জীবনে, সামগ্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কেবল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই পড়েনি, একুশের মহিমা বাংলা সাহিত্যেও বারবার উচ্চকিত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের মতোই সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় প্রেক্ষাপট হিসেবে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতার কাব্যিক চোখে, গল্পের শাব্দিক ভাঁজে, গবেষণার আগ্রহী বিষয় হিসেবে, নাটকের উদ্দীপক সংলাপ বর্ষণে বায়ান্নের একুশ তারিখ এখনো প্রাণময়, চেতনাদীপ্ত; এতটুকুও পুরোনো হয়ে ওঠেনি। ফলে এমন পদ্য অথবা গদ্যশিল্পী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি এ প্রেক্ষাপটে অনুরণিত হয়ে গল্প-কবিতা রচনা করেননি। তবে সবসময়ের মতোই, সব প্রেক্ষাপটের পুনঃসঞ্চায়নে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই অজস্র লেখা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা চলমান আছে। আর তাই তো কবি আবদুল হাই শিকদার শিশুদের মাঝে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘একুশ’ শিরোনামে লেখেন :

ধান এলো গো গান এলো গো 

একুশ একুশ দেশে,

বুকের ভিতর রক্ত উঠে

ভালোবাসায় হেসে।

একুশ আমার মাথার ওপর

পরশ মমতার,

সোনার পালক সকাল বেলা

পদ্মা যমুনার।

একুশ জেনো গর্জে ওঠে

দেখলে অবিচার,

বাংলাদেশ ও জগৎজনের

একুশ অহঙ্কার।

একুশের অর্জন আমাদের যেমন অহংকার ও গৌরবের বিষয়; তেমনি তার চেতনাকে রক্ষা করতেও সচেতন থাকা জরুরি। আজ একুশ শতকে এসেও স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলাভাষার চর্চা যেমন সম্ভব হয়নি; পাশাপাশি হিন্দির আগ্রাসনের মুখেও পড়তে হচ্ছে বাংলাভাষাকে। আমাদের সচেতন করতে কবি মতিউর রহমান মল্লিক লেখেন :

আসলো একুশ, আসবে একুশ

হায়! তবু কি আসবে না হুঁশ!

কবি হুঁশ ফিরাতে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘একুশ মানে তীব্র আগুন।’ যে আগুন আগ্রাসন বিরোধী।

বাংলাদেশ, বাংলাভাষা, বাঙালি যতদিন থাকবে ততদিন ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে রচিত হবে অসামান্য সব কাব্য। আর তাইতো দেখি কবি মোশাররফ হোসেন খান তাঁর কবিতায় বলেন-

বর্ণমালার শরীর দিয়ে

ঝরঝরিয়ে রক্ত ঝরে

সূর্যটা তাই দারুণ ক্ষোভে

ক্ষিপ্রভাবে ছিটকে পড়ে।

... ... ... ... ....

কিসের লোহু কিসের বান!

কোন সে নদী নিচ্ছে বাঁক

লাল একুশে সাঁতার কেটে

বর্ণমালা দিচ্ছে ডাক।

বাংলা কবিতায় এভাবেই বাংলাভাষা আন্দোলন বারবার উচ্চকিত হয়। আন্দোলিত হয়। এ এক অফুরন্ত গতিপ্রবাহ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ