বসন্তের রূপসী বাংলা

বসন্তের রূপসী বাংলা

ফিচার মঈনুল হক চৌধুরী ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এই ছয়টি ঋতুু প্রকৃতিতে আসে পালাক্রমে। এই ছয় ঋতুর রূপের ছটায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে অপরূপ। ষড়ঋতুর পরিক্রমায় প্রকৃতিতে এখন ঋতুরাজ বসন্ত। বাংলা ঋতুচক্রে বসন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। শীতকাল পেরিয়ে আসে বসন্ত। এ সময় ফুল ফোটে, গাছে ধরে বিচিত্র ফল আর বনে বনে পাখি গায় গান। আবহাওয়ার পরিবর্তনে বাংলা আর বাঙালির অন্তরে বয়ে যায় আনন্দ বাতাস, হৃদয় নেচে ওঠে। ফলে বাংলা সাহিত্যে, গানে-সুরে ঋতুরাজ বসন্ত আসন পেতেছে নিজের মতো করে। বাংলা ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস বসন্তকাল। বসন্ত ঋতুর রঙের ছটায় খানিক হলেও সেজে ওঠে আমাদের চিরায়ত এই গ্রাম বাংলা। তার আভায় এই রূপসী বাংলাদেশ আরো সুন্দর রূপ ধারণ করে। বছরের শেষ ঋতু বসন্ত। এই সময়ে প্রকৃতিতে যে আবহাওয়া বিরাজ করে তার সঙ্গে বাঙালির সখ্য চিরন্তন। এই আবহাওয়ায় মন প্রফুল্ল­ হয়ে ওঠে। মাঠে কাজ করার সময় কৃষকেরা গান ধরেন। দখিনা বাতাসে সেই সুরের ঢেউ ওঠে, ছড়িয়ে যায় বহুদূর। মন প্রফুল্ল­ থাকায় কৃষকের কাজে থাকে ছন্দ। আর এর মধ্য দিয়ে ক্ষেতের ফসল পায় বাড়তি পরিচর্যা, ফলন আসে ভালো। এরকম নানা উপায়েই বসন্ত বাংলাদেশের জনজীবনে বড়ো ধরনের প্রভাব ফেলে যায়, তা কল্যাণকর। আমরা জানি, সারা বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। এর প্রভাবে বেশ বড়ো ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে আমাদের দেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপ হারাচ্ছে। ঋতু বৈচিত্রেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। তারপরও ঋতুর পরিক্রমায় বসন্ত তার আপন জৌলুস নিয়েই বিরাজ করে আমাদের মাঝে। পরিবেশবিদদের মতে, ষড়ঋতুর মধ্যে বসন্ত হচ্ছে সেরা ঋতু। এ সময়ে প্রকৃতিতে যে আবহাওয়া বিরাজ করে তা মানুষকে সৃজনশীল হতে সাহায্য করে। বসন্তের আগমনে উদ্ভিদ জগতে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগে। নিষ্পত্র বৃক্ষরাজি হেসে ওঠে নতুন সাজে। উদম গায়ে, নতুন পোশাক পরে ছড়িয়ে দেয় শীতল বাতাস, ঋতুর আবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র রূপসুষমায় আখ্যায়িত হয় আমাদের প্রিয় রূপসী বাংলা। বসন্ত মানেই ফুলের সমারোহ। ফুল মানেই রঙের মিলনমেলা।

ঋতুর পরিক্রমায় প্রকৃতি পায় বসন্তের ছোঁয়া। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সবাই সাদরে বরণ করে ঋতুরাজ বসন্তকে। সেই খুশিতে গাছের শাখে শাখে ফোটে হরেক রকম ফুল। বাঙালি এক কথায় বেশ ভাগ্যবানই বলতে গেলে। কারণ ছয় ঋতুর এ দেশে প্রতিটি ঋতুতেই ফোটে স্বতন্ত্র কিছু ফুল। এরা ঋতুর আগমনি বার্তা নিয়ে আসে। ফুলগুলো গোটা ঋতুজুড়ে আবেশ ছড়িয়ে ঋতু বদলের মধ্য দিয়ে ছুটি নেয়। শুরু হয় নতুন কোনো ফুলের দিন। শীতের শেষ ও বসন্ত শুরুর মাঝামাঝি সময়ই প্রকৃতি নিজেকে পালটে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় থেকেই গাছে ফুলের মুকুল দেখা দেয়। ধূসর কুয়াশা সরে গিয়ে বাগানজুড়ে খেলা করে সোনারোদ। আর ঋতুরাজের রাজসভায় আগমন ঘটে রঙিন সব ফুলের। ফলে বসন্ত এলে ফুলে ফুলে ভরে যায় বাগান। 

সকাল হলে ফুলের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে প্রকৃতি। সারা বছরই বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ফুল দেখা গেলেও বসন্ত কালেই এর সংখ্যা সব থেকে বেশি। বসন্তের অপূর্ব ফুলসম্ভার বাংলাদেশের চিরশ্যামল প্রকৃতিকে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে ঝলমল করে তোলে। বসন্তের আগমনে পল্ল­বিত হয় তরুলতা। গাছে গাছে ফোটে বিচিত্র ফুল। গোলাপ, শিমুল, অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, নাগলিঙ্গম, কাঠ গোলাপ, কনকচাঁপা, চাঁপা, নয়নতারা ইত্যাদি দৃষ্টিনন্দন রঙিন ফুলগুলো প্রাণে আনন্দের রং ছড়ায়। গাছে গাছে ফোটে আমের মুকুল। পাখিরা আনন্দে গান গায়। এ-ডাল থেকে ও-ডালে উড়ে বেড়ায়। সে কী যে মধুময়, তা একবার উপভোগ না করলে বোঝাই যাবে না। তোমরা একবার গাঁয়ে গিয়েই দেখো-না বসন্তের সকাল কত সুন্দর, মধুময়। শীতে সকল গাছের পাতা ঝরে যায়। এক পায়ের ওপর হাত-পা মেলে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষরাজি। বসন্ত এলেই আসে তাদের পরিবর্তন। নতুন পাতা গজাতে থাকে। তখন বাগানে বাগানে হাসি ফোটে বয়সি গাছ-গাছালির। যেমন- গগন শিরীষ, দেবদারু, রেইন ট্রি, রক্তকাঞ্চন, হিজল, কদম আরো কত কী। তখন ঝুমকো লতা, মধুমঞ্জুরি শোভা পায় বাগানে। তাই বসন্তের সকাল ¯িœগ্ধ অপূর্ব। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বের হয় ফুল লতাগুল্মের দর্শনে। তখন সোনালু গাছের হলুদ ঝালরের দুলুনি দেখে মন উদাস হয়ে যায় তাদের। এ সময় বাগানে গেলে শোনা যায় মৌমাছির গুনগুন শব্দ। এ-ফুল থেকে ও-ফুলে ওরা নাচানাচি করছে। করছে ফুলের সাথে মিতালি। তখন প্রজাপতিরাও বসে থাকে না। তারাও ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। বাগানে হাসি ছড়ায় রক্তকরবী। ছোট্ট টুনটুনিটি ফুলের গন্ধ নিচ্ছে। রক্তকরবী ফোটে উঁচু ঝোপালো গাছে। সুগন্ধি সুন্দর দর্শন। গাছে গাছে ফোটে গোলাপ, জবা, কাঁঠালচাপা। অদ্ভুত কড়াগন্ধ ভরে যায় সারা বাগান। কাঁঠালচাপার গন্ধ কেমন জানো? অনেকটা পাকা আতা আর পাকা কাঁঠালের মাঝামাঝি একটা মাদকতাময় গন্ধ। আসলে বসন্ত না এলে এসব মোটেও বোঝা যাবে না। সবুজের ছায়াঘেরা আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। গাছপালা, পশুপাখি আর নানারকম প্রজাপতি আমাদের দেশকে দান করেছে অপূর্ব মায়াময় রূপ। ফুলে ফলে কেমন সাজানো বাগান। তাই বসন্ত এলে সবার চোখ আটকে থাকে ফুলের গায়ে। তখন পুকুরের পদ্ম ফুলেরা কী মমতায় আকাশ দেখে। শান্ত পুকুরে মাছরাঙারা টুপ করে খাবার ধরে লুকিয়ে যায় গাছের কোঠরে। আকাশে আকাশে উড়ে বেড়ায় গাঙচিল। গান গায় টুনটুনি। এখনো দূরের কোনো এক গাঁয়ের মাঠ থেকে বসন্তের দুপুরের সেই বাঁশির সুর, আর কুটুম পাখির ডাক কেবলই ডাকে। বসন্তের পড়ন্ত বিকেল, সূর্য তার রশ্মিকে সোনালি চাদরে মুড়িয়ে দেয় রূপসী এই বাংলাকে। বিকেলে রোদের আলতো উষ্ণতা বড়োই আরামদায়ক। তখন প্রকৃতি যেন সূর্যের আলোতে মিশে একাকার হয়ে যায়। আলতো রোদের রেশমি চাদর-সারা গায়ে আরামের পরশ বুলিয়ে দেয়। তখন নিজেকে স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা বলে মনে হয়। উদার আকাশ তখন নীল টুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নেয় সূর্য। বসন্তের জ্যোৎস্না রাত কত মধুর। চারপাশে শব্দহীনতা জুড়ে আছে। তখন একটা অস্পষ্ট মায়ালোক ডুবে যায় প্রকৃতি। এক অনাবিল সৌন্দর্য সর্বত্র বুলিয়ে যায় কোমল স্পর্শ। নদীতে উত্তাল তরঙ্গ নেই। নেই উদ্যম স্রোত। তখন হালকা বাতাস কাশের বনে ঢেউ খেলে যায়। মাঝরাতে মাথার ওপর চাঁদের আলো খাড়াভাবে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। যেন বিশাল আসমানের গায়ে গোলাকার একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব ঝুলে আছে। পুকুরের পানিতে হালকা ঢেউয়ের কুচি, তারওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে অবাধ চন্দ্রালোক। তখন ফুরফুরে বাতাস প্রকৃতির ওপর জ্যোৎস্নার আলো বুলিয়ে দেওয়া যেন অতিরিক্ত পাওনা। বসন্তের রাত জ্যোৎস্নার আলোয় হালকা শিশিরে মিশে তৈরি হওয়া রহস্যের এক সূক্ষ্ম আবরণ। উল্লেখ্য, বসন্ত ঋতুর স্থায়িত্বকাল খুবই কম। ফাল্গুন-চৈত্র মাসকে তার স্থায়িত্বকাল ধরা হলেও ফাল্গুনের মাঝামাঝি গ্রীষ্মকাল এসে পড়ে। আমাদের দেশে বনভূমি কমে যাওয়ায় শুধু বন্যপ্রাণী নয়, আবহাওয়ায়ও অস্থিরতা শুরু হয় এই সময়। 

শীত ও বর্ষা কমে গিয়ে গ্রীষ্মের দাপট বেড়ে যায়। শুধু দাপট নয়, গ্রীষ্ম ঋতু বসন্তকে প্রায় গ্রাস করে ফেলে। তাই তখন আমরা ঘাম মুছতে মুছতে ও পাখার বাতাস নিতে নিতে দিশেহারা হই। জীবজগতে বসন্তকাল বড়ো বড়ো কল্পনা ও স্বপ্নের জন্ম দেয়। জীবনকে রঙিন ও মধুর করে ভাবতে শেখায়। দখিনা বাতাসের মৃদুদোলা শরীর ও মনের ক্লান্তি জুড়ায়। বসন্তের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আমাদের প্রাণকে চঞ্চল করে তোলে। নবজাগরণের দোলা লেগে এ সময় বাংলার প্রকৃতি যেমন শিহরিত হয়, তেমনি অজানা এক সুরের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাঙালির হৃদয়। এ সময় দখিনা হাওয়া পথিকের হৃদয়ে উদাসীনতার সুর তোলে। তাই হৃদয় পাগল করা বাংলার এ রূপ শুধুই বাংলার।

বসন্ত বাঙালির অতি প্রিয় একটি ঋতু। এ ঋতুতে প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনেও নতুন আবহের সৃষ্টি হয়। এ ঋতু নিয়ে বাঙালির আগ্রহ চিরকালের। বঙ্গাব্দের শেষ দুই মাস ফাল্গুন ও চৈত্র মিলিয়ে বসন্ত ঋতু। বাংলার প্রকৃতি, আমাদের ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বড়ো স্থান দখল করে আছে বসন্ত। বসন্ত মিলনের ঋতু, আবার বিরহেরও ঋতু। শীতের জবুথবু প্রকৃতির অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ সমীরণের প্রবাহ শুরু হয় বসন্তে, এর সাথে দোলায়িত হয় মানুষের মনও। এ প্রিয় ঋতুর আগমন উপলক্ষ্যে নানা স্থানে বিশেষ উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলার পল্ল­ীতে গ্রামে-গঞ্জে সবচেয়ে বেশি মেলা বসে এ ঋতুতে। নানা উৎসব আয়োজন হয়। ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। বাঙালির নিজস্ব সর্বজনীন প্রাণের উৎসব বসন্ত উৎসব। এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলায় বসন্ত উৎসব এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হলেও এর শুরুর একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে, যা অনেকের অজানা।

মোগল স¤্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ বঙ্গাব্দে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। ‘বসন্ত হলো রঙিন স্বপ্ন নতুন দিনের চিঠি, বসন্ত ঋতু আমাদের সবার মাঝে সৃজনশীলতার বীজ বুনে দিক। সবার মন উচ্ছল ও চঞ্চল হয়ে উঠুক। সেই উচ্ছলতা আর চঞ্চলতায় বাংলাদেশ নতুনের সমারোহে ভরে উঠুক। বসন্ত তাই প্রতিটি হৃদয়ে উপলব্ধি হোক। আমাদের প্রকৃতির যে ঐতিহ্য তা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। বসন্ত বাতাসে ফুলের সুবাস নিয়ে দেশের সকল মানুষ এগিয়ে চলুক সমৃদ্ধির দিকে- এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ