ফররুখ আহমদের কিশোর ভাবনা

ফররুখ আহমদের কিশোর ভাবনা

স্মরণ ড. মোজাফফর হোসেন অক্টোবর ২০২৩

শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে

দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে

আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি

দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াসে তাদের সেতারা, শশী; 

(পাঞ্জেরি)

অবহেলায় নিজের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়েছে মুসলমানরা। অথচ মুসলমানদের ছিল গর্ব করার কৃষ্টি-সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকে আবার ফিরে আনবার আহ্বান করেছেন ফররুখ আহমদ। এ কারণে ফররুখ আহমদকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি বলা হয়। রেনেসাঁ অর্থ পুনর্জাগরণ।

মুসলিম জাতির শেকড়সন্ধানী  কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ শীর্ষ। তার পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ। জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুন। জন্মস্থান মাগুরা জেলায়। বাবা ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মায়ের নাম রওশন আকতার। ফররুখ আহমদ তার খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন লিলিকে বিয়ে করেন। তাদের ছিল ছেলেমেয়েসহ এগারো সন্তান। ফররুখ আহমদ পড়শুনা শুরু করেন খুলনা জেলা স্কুলে। এরপর কলকাতার রিপন কলেজে। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা শেষ করেন। কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতার পুলিশ অফিসে। তারপরে তিনি জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বেতারে চাকরি নেন। ছাত্রজীবনে ফররুখ আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। কর্মজীবনে এসে ইসলামী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

একটি জাতির আগামী তাদের শিশু-কিশোর। সেই শিশু-কিশোর যদি ভুল চিন্তায় বেড়ে ওঠে তবে জাতি হতে পারে পরাধীন। জাতির এত বড় ক্ষতি করতে না চাইলে গুরুত্ব দিতে হবে শিশু-কিশোরদের। ঐতিহ্য সচেতন কবি ফররুখ আহমদ শিশু-কিশোরদের গুরুত্ব দিলেন। তিনি কিশোর মন নিয়ে ভাবলেন। তিনি দেখলেন,  কিশোর মন ভাঙাগড়ার মন। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তাদের চেতনা। হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকতে চায় সারাক্ষণ। এই হৈ হুল্লোড় দিয়েই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সেই হৈহুল্লোড় যেন সুস্থ হয়। ফররুখ আহমদ  ভেবেছেন সুস্থ বিনোদনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে আগামী। আজকের শিশু-কিশোরই আগামীর মহানায়ক। তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা জরুরি। তা না হয় জাতি হবে জীর্ণশীর্ণ। কাজেই তিনি দায়িত্ব নিলেন শিশু মনকে আনন্দ দেওয়ার। শিশু-কিশোর মনের আবেগকে তিনি ধারণ করলেন এবং এক এক করে লিখলেন কবিতা। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখলেন-পাখির বাসা; হরফের ছড়া; চাঁদের আসর; ছড়ার আসর; ফুলের জলসা;  ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ।


ফররুখ আহমদ সহজ করে কিশোর মনের প্রকৃতি বুঝেছিলেন। চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ দুপুরে কিশোর ঘুমাতে চায় না। এ সময় পাখির বাসা খোঁজা তাদের নেশা। কিশোরদের এই নেশাকে স্মরণ করলেন ফররুখ। নতুন শিশুদের তিনি পাখির বাসা দিয়ে স্বাগত জানালেন। ফররুখ ‘পাখির বাসা’ কবিতায় লেখলেন- 

নতুন মানুষ এল যারা

খোদার দুনিয়াতে

ছোট্ট আমার পাখির বাসা

দিলাম তাদের হাতে ॥


আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া

দিনটাতে,

পাখির বাসা খুঁজতে যাব

একসাথে ॥


কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়

ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়

কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে

সাঁঝ রাতে ॥


আত্মসম্মানে বলিষ্ঠ জাতির মাথায় সর্বদা সম্মানের তাজ থাকে। আত্মসম্মান যাদের নেই তারা নিম্নমানের। নিম্নমানের মানুষ অন্যের দয়া চায়। অথচ পরের দয়া ভালো নয়। পরনির্ভরশীলতাও ভালো নয়। বাঁচতে হলে স্বাধীনভাবে বাঁচা ভালো। চড়ুই পাখির স্বভাব গোলামির স্বভাব। ফররুখ কিশোরদের আত্মমর্যাদায় বাঁচার আহ্বান করলেন। তিনি ‘চড়ুই’ কবিতায় বললেন-

চড়ুই পাখি চালাক তবু ভাই

নিজের বাসার ঠিক ঠিকানা নাই ॥


পরের দালান বাড়ি খুঁজে

থাকে সে তার মাথা গুঁজে,

সবাই তাকে খারাপ বলে

বলে যে দূর ছাই ॥


পরের দয়ায় বাঁচতে যারা চায়,

দুঃখ তাদের ঘোচানো যে দায় ॥

পরের কোঠায় চড়ুই পাখি

নিজেরে হায় দিল ফাঁকি,

পরের দয়ায় চড়ুই পাখি

গোলাম হলো তাই ॥


জীবন কিভাবে গড়তে হয়; জীবন চলার পথে দরকার কী; কিভাবে সেসব দরকার মিটাতে হয়, ফররুখ আহমদ শিশু-কিশোরদের সেসব শেখাতে চাইলেন। জীবনকে সুন্দর করতে হলে জীবনের শুরুতে দরকার মৌলিক কিছু জ্ঞান। ফররুখ সেই জ্ঞান তুলে ধরার ব্যবস্থা করলেন কিশোর কবিতায়। ছেলেমেয়েরা বন্ধু ছাড়া চলতে চায় না। জীবনকে এগিয়ে নিতে ভালো বন্ধুর দরকার হয়। অনেকেই বলে সঙ্গ দোষে স্বভাব নষ্ট।  সেজন্য খুব সচেতনভাবে ফররুখ আহমদ শিশু-কিশোরদের জন্য ‘বন্ধু নির্বাচন’ ছড়া লেখলেন। তিনি বললেন  বন্ধু দেখতে মানুষেরই মতো। কিন্তু তার আচরণ ভালো হবে না। মন্দ স্বভাবের বন্ধুরা সবসময় দ্বন্দ্ব করে। ঝগড়া করে। ভিতরে বাইরে হিংসা করে। কিপটে হয়। পরের টাকায় ফূর্তি করে। বন্ধু নির্বাচনের সময় এমন মানুষকে বন্ধু করা যায় না। ফররুখ আহমদ লিখলেন-

বন্ধু যদি বেড়াও খুঁজে

চিনবে তাকে চক্ষুবুজে

লোকটা কেমন?

মন্দ কি আর

মন্দ শুধু স্বভাবটা তার

হর হামেশা বাইরে ঘরে

দ্বন্দ্ব মানে ঝগড়া করে

হিংসুটে আর কিপটে বেজায়

ফূর্তি শুধু পরের কথায়।


কুসুমকুমারী দাশ লিখেছেন, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। কুসুমকুমারী দাশ খেয়াল করেছেন, আমাদের ছেলেরা কাজে বড় নয়; তারা কথায় বড়। আর ফররুখ আহমদ বললেন যারা কাজ পছন্দ করে না; তারা কথার বোঝা মাথায় করে ঘোরে। কাজ না করেই বড় হবার স্বপ্ন দ্যাখে। অথচ কাজ ফাঁকি দিয়ে বড় হওয়া যায় না। ফররুখ আহমদ কর্মবিমুখ ছেলেদের স্বভাব তুলে ধরলেন ‘পথের গান’ ছড়াতে-

কাজের মানুষ নয়রে যারা

কথার বোঝায় মরে তারা

ছেঁড়া কাঁথায় তাদের স্বপ্ন

লুটায় ধূলি পারা

নাইরে কাজের শঙ্কা যাদের

নাইরে ভয়ের মানা

তাদের কাজেই সবুজ নিশা

মেলে সবুজ ডানা ॥ 


তারাই ফাঁকা তেপান্তরে

নতুন দিনের তরে ॥


আবহমান গ্রাম বাংলায় জমে ওঠে মেলা। এই মেলা পৌষের শীত শেষে গ্রামগঞ্জে শুরু হয়। সেসব মেলায় বড়রা যেমন যেতে চায়, তেমন ছোটদেরও মন নেচে ওঠে। তারা বায়না ধরে মেলায় যেতে। শেষমেশ ছোটরাও দল বেঁধে মেলায় যায়। ছোটদের উল্লাসে ধুম পড়ে যায় গ্রামে গ্রামে। তবে মেলায় বিড়ম্বনাও আছে। গ্রামীণ মেলার পরিবেশ নিয়ে ‘মেলায় যাওয়ার ফ্যাঁকড়া’ নামে চমৎকার এক ছড়াকবিতা লিখেছেন ফররুখ আহমদ। তিনি লেখলেন-

বাপরে সে কী ধুম ধাড়াক্কা

দিচ্ছে ধাক্কা খাচ্ছে ধাক্কা

গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত

হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলাকান্ত

লাগলো যখন বিষম তেষ্টা

ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা

তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ

ভিড়ের ভেতর দেয় সে লাফ।


ফররুখ আহমদ শেকড় থেকে ভাবতে পারতেন। তিনি বিস্তর বহু দূরকেও বুঝতে পারতেন। অতএব তিনি যা  লিখেছেন তা গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন। আজকের আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম কিছু লেখেননি। ফররুখ আহমদ শিশুদের বর্ণ শিখালেন ছড়ার মাধ্যমে। লিখলেন ‘হরফের ছড়া’

অ-বর্ণ

অ- য়ে অতসী তিসির মাঠ

অশত্থ গাছের সামনে হাট।

অলিগলি শহর চাই

অলিগলি শহর পাই।


ক-বর্ণ

ক-য়ের কাছে কলমিলতা

কলমিলতা কয় না কথা।

কোকিল ফিঙে দূর থেকে

কলমি ফুলের রঙ দেখে।

শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠুক ফররুখ আহমদের কবিতা পড়ে। ফররুখের কবিতায় শিশু পেতে পারে  প্রশান্ত মন। সুন্দর ভবিষ্যৎ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ