প্রতিশ্রুতি । আজম সিদ্দিক রুমি
গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৯
চারিদিকে নিঝুম চাঁদের ঝলমলে আলোর ছড়াছড়ি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে দৃষ্টি পড়ে নারকেল গাছের দিকে। আশ্চর্য হয়ে গা শিওরে ওঠে! কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ খনিকের মধ্যে হাওয়া! আতঙ্কে জড়সড়। বাবা পাশে, মা মাথা ম্যাসেজ করছে। টুম্পা হাত ধরে। ভাইয়া এত চিৎকার করলি কেন? কাঁপতে কাঁপতে মায়ের বুকে। মায়ের ঘরে ঘুমালো। টুম্পা নিজের ঘরে। রাত গভীর। সবাই নিদ্রাচ্ছন্ন। জারিফ এখনও জাগা, কী করবে ঘুম আসছে না তার। চোখ বুজলে ঐ দৃশ্য চোখে ভাসে। বাঁক হারিয়ে ফেলে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এলো। সকাল বেলায় টুম্পা মায়ের কাজে সহযোগী। বাবা অফিস। ভাইয়া ওঠেনি ভেবে টুম্পা ঘরে যায়- ভাইয়া এই ভাইয়া উঠ না এই ভাইয়া উঠ- দেখ, তোর জন্য নাস্তা এনেছি। খুমির করা রুটি তোর বেশ পছন্দ। আজ আমি তৈরি করেছি। মা শুধু বসে বসে দেখেছে। উঠ না ভাইয়া দেখ! কোনো উত্তর নেই। চাদর উল্টে দেখে, কেউ নেই। মা, মা, ভাইয়া কই ভাইয়া কোথায় গেল, জারিফ নেই, না মা! ভাইয়া নেই। কোথায় গেল! খোঁজাখুঁজি করে। মা বড় টেনশনে পড়ে গেল এই সময় বাসায় ছেলে না থাকা, বুক ধড়াক করে উঠলো। কী করবে এখন! কোথায় খুঁজবে চারিদিকে ঘন কুয়াশার আহাজারি। কয়েক দিন থেকে গ্রামের অবস্থা করুণ। কখন জানি কী ঘটে। বড় টেনশনে পড়ে গেলেন রাহেলা আক্তার লিপি। চারিদিকে শিয়াল শকুনের থাবা মা ভাবলো সে ফিরে আসবে। মনের বিশ্বাস। মন মানে না তবুও। খোঁজাখুঁজি করতে বের হয়। টুম্পা ভাইয়ের জন্য কাঁদে। বাবা অফিসে গেল আর ফিরে এলো না। তিন দিন হয়ে গেল। হাসনাহেনার ঘ্রাণ হৃদয় ভেদ করে মুগ্ধতা এনে দেয়। ঠিক এই ঘ্রাণটাও হৃদয় ভেদ করার মতো। সবাই চেয়ে। চেহারা বিবর্ণ চেনা যায় না ক্ষত-বিক্ষত রক্তে রঞ্জিত দেহ। আহা- কী নির্মম। দৃষ্টি দিতে রক্ত জল ঝরে। এটা কে? কোন উত্তর নেই, সবাই নিশ্চুপ। আমার বাবা না তো। না না আমার বাবা হতে যাবে কেন? এ এই। এই শার্ট পরেতো বাবা অফিসে গিয়েছিল! ব্যাগ ঘাড়ে, ঘড়ি হাতে টাই গলায় সবইতো চেনা চেনা লাগছে। আমারই বাবা! বাবা বাবা বলতে বলতে, হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো, কে থামাবে টুম্পার স্বজন হারানো কান্না। সবার একই অবস্থা! সেদিন রাতে এসেছিল। মা বাবা টুম্পা কেউ বুঝতে পারেনি, পেরেছিল জারিফ, হাফিজের বড় ভাইবোনকে তারা মেরে ফেলেছে ওহ- তাদের চেহারার বিবরণে জারিফ চিৎকার দিয়েছিল। কেউ বুঝেনি কিছু বলেনি বললে হয়ত মা কাঁদবে। আজ ডাক এসেছে যুদ্ধে যাওয়ার যেতে হবে আমায়। আমার বাবাকে হত্যা করেছে কাল ওর, কাল এর, এভাবে সবাই। আর থেমে থাকা যায় না। নির্বিঘ্নে নীরবে জীবন দানের চেয়ে যুদ্ধ করে জীবন দান যথাযোগ্য ও উত্তম। - মা, - মাগো আমাকে বিদায় দাও। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো মা জননী। কেঁদো না মা দেখ আমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ। হাসি মুখে বিদায় দাও মা। যেন, এ দেশকে, আমার মাটিকে আমার প্রেমকে, ঐ সকল ঘাতক নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। জারিফ কাঁদছে- কান্না সংযত করে আবার কাঁদো কাঁদো হাসি কিছুতেই যেতে দেবে না মা বারণ করছে। ওকে হারালে কাকে নিয়ে বাঁচবো! হাফিজ, আমাদের জন্য দোআ করুন। পথ রুদ্ধ না মা। আমরা সেই সৈনিক আমরা বীরেরজাত। আমরা বীর। আমরা হার মানবো না। হার মানতে জানি না। বিজয় আসে কিভাবে আমরা জানি। আমরা না জাগলে কেমনে আঁধার কাটবে মা, মা আর পারলো না থেমে থাকতে। কান্নার সুরে সুরে মা জারিফকে বিদায় দিল- হাফিজ এবং জারিফ রওনা হলো। টুম্পা পেছন থেকে, ভাইয়া চিঠি লিখিস টুম্পা খুব সাহসী ও বুদ্ধিমতী। ছোট্ট থেকে টুম্পা জারিফ বিভিন্ন কাজে খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। টুম্পার অনুপ্রেরণা ভাইয়া তুই সৈনিক হবি মানুষের জন্য, দেশের জন্য, মাটির জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবি। আমাকেও নিয়ে যাবি। কিন্তু মাকে দেখে রাখার জন্য টুম্পার আর যাওয়া হল না। যাওয়া না হলেও, গ্রামে টুম্পা বিভিন্ন হেনেস্তার শিকার- টুম্পার জীবনে অনেক ভয়াবহ নির্যাতনের বিচিত্র ঘটনা আছে। টুম্পার জীবনটাই যুদ্ধে জড়িত। মা কিছুদিন আগে হাসপাতাল গিয়েছিল আর ফেরা হয়নি। টুম্পা ভেবে নিয়েছে মা আর আসবে না, মেরে ফেলেছে ঐ ঘাতকরা। এখন কী করবে। বাবা নেই, মা নেই, ভাইয়া নেই- একা একা কয়দিন কেটে গেল। পরিস্থিতি আরও তীব্রতর হয়ে উঠছে। টুম্পা ডুকরে ডুকরে কাঁদে আর বলে বাবা-মা- তোমরা আমায় ফেলে চলে গেলে। কেউ নেই তার কান্না ভাগাভাগি করার। কার সাথে ভাগ করবে, সবার অবস্থার কোনো ভিন্নতা নেই। সবাই একই দুরবস্থায়। কারো বাবা কারো মা কারো ভাই কারো বোন নির্যাতনের শিকার- অনেককে হত্যা কারা হয়েছে। এ দুর্লভ রক্ত জল আর কত দেখবে। দেখতে দেখতে টুম্পা বেহুঁশ। ভাইয়া কোন চিঠি পাঠায় না। ভাইয়া বেঁচে আছে কি না, জানি না! টুম্পা কী করবে? তার এক মামার বাসায় গেল। সেখানে একই অবস্থা! তাদের বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড। নির্মমভাবে তার মামা মামাতো ভাইকে হত্যা করেছে। মামাত বোনকে ধরে নিয়ে গেছে নরপিশাচ হায়েনারা। টুম্পা আর থেমে থাকতে পারল না। চেনা অচেনা সকলকে সাথে নিয়ে মিশন শুরু করল। লড়াকু হয়ে লড়ে গেলো নতুন একটি দিগন্তের উন্মেষে। এভাবে টুম্পা জারিফ ইতিহাস হয়ে বিদায় নেবে। নিপীড়ন জুলুম বহমান। সোনার হীরেরা সব মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে, সম্মান ফিরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শত শত জারিফ টুম্পা কালে কালে জেগে উঠবে।
আরও পড়ুন...