পাখির প্রতি ভালোবাসা   -এহতেশামুল হক

পাখির প্রতি ভালোবাসা -এহতেশামুল হক

তোমাদের গল্প জুলাই ২০১৭

রেজভির বাড়ির পেছনের ছোট আমগাছের চারাটি খুব সুন্দর করে আলি চাচার শৈল্পিক হাতে রোপণ করেছিল। আজ থেকে প্রায় চার বছর আগেও রেজভি চারা-গাছটিতে প্রতিদিন পানি দিত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি। রেজভির স্কুলে যাওয়ার চাপ বেড়ে গেল। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সকালের নামাজ সেরে মকতবে যাওয়া। আবার মকতব থেকে ফিরে এসে স্কুলে যাওয়া। আবারও স্কুল থেকে ফেরার পথে অংক-ইংরেজি বিষয়ের প্রাইভেট পড়া। এসব করতে করতে প্রায় দিনের অর্ধেকটা ফুরিয়ে যায়।
বাড়িতে এসে যে সময়টুকু থাকে তাতে বাড়ির কাজটা সেরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে মাগরিবের আজান তার কর্ণকুহরে ভেসে ওঠে। কিন্তু কয়েক দিন গ্রীষ্মের বন্ধ হওয়াতে কিছুটা স্বস্তি পেল। একটু আধটু আমের চারাটির প্রতি নজর দিতে দেখা গেল রেজভিকে। এখন ছোট্ট আমের চারাটি আর নেই। সেটি বড় আমগাছে পরিণত হল। দৃশ্যটি রেজভির মনকে পুলকিত করে দিল। আমগাছটি বাড়ির চালের তিন থেকে চার ফুট লম্বা হয়ে তার শাখা-প্রশাখাগুলোকে চালের ওপর বিলিয়ে দিয়েছে। গাছটিতে কচি কচি সবুজ পাতায় ভরে উঠেছে। মনে হয় আমের মুকুল ফুটবে। এরপর আম ধরবে। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ে সেই মুকুল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আম ধরা তো দূরের কথা গাছের সেই সবুজ মায়াবী পাতাগুলো পর্যন্ত ঝরে গেল।
সূর্যের সোনালি আলো যখন গাছটির উপরে ঝলসে উঠে তখন সেখানে এক ঝাঁক পাখি না এলেও দুয়েকটি পাখি এসে ভিড় জমায়। মাঝে মাঝে চড়ুই, শালিক, ছোট টুনটুনি খুব বেশি চোখে পড়ার মতন হয়ে যায়। ওরা গাছের ডালে ছন্দে ছন্দে কিচিরমিচির সুর তুলে। মনে হয়, কবির ছন্দকে আর বাঁশির সুরকেও যেন হার মানাবে। এভাবে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসে। সেই সাথে পাখিরাও যেন কোথায় কোথায় হারিয়ে যায়।
প্রতিদিনকার মত আজও বেশ কয়েকটি টুনটুনি বেশি দেখা যায়। আরো বেশি আশ্চর্যের কথা হলো আতা গাছটির ডালে বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যেটি আম গাছটির পাশে অসম্ভব সুন্দর করে তার ডাল-পালাগুলো মেলে ধরেছে প্রকৃতির কুলে। রেজভি গ্রীষ্মের সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পেছনে গেলেই কি এক অজানা সুর তার কর্ণকুহরে ভেসে ওঠে। একটু জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই টুনটুনিকে চোখে পড়ে। তারা গান গায় আপন আনন্দে কিন্তু সেই আনন্দ গ্রামের প্রতিটি জাগ্রত হৃদয়ের কাছে পৌঁছাই। গান গাইতে গাইতে একবার আতা গাছের ডালে আবার আমগাছের ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ ঐ দূর আকাশে উড়ে যায়। চোখ দুটো তীক্ষè দৃষ্টি মেলে আকাশে তাকালে ও আর দেখা মিলে না টুনটুনি দু’টিকে। আবার ফিরে আসে সন্ধ্যা বেলায় একটি নতুন আশা নিয়ে। নতুন সোনালি স্বপ্ন নিয়ে।
কয়েকদিন থেকে টুনটুনিরা এখন আতা গাছে বেশি সময় কাটাচ্ছে। দিনে-দুপুরে শুধু একবারই যায় ঐ আমগাছটির মগডালে। দু-তিন দিন এভাবে কেটে যাচ্ছে। রেজভি একদিন খুব শান্ত হৃদয়ে সুনিবিড় নয়নের দৃষ্টি আতা গাছে প্রসারিত করে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। খুব স্পষ্টভাবে ভেসে এলো ছোট্ট একটি পাখির বাসা। মনে হয় এই কয়দিন অনেক পরিশ্রম করে বাসাটা বানাতে গিয়ে টুনটুনির দেখা মিলল না। তারা মনের সুখে দিন কাটাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে যেন তাদের জীবনের বাকি অংশটুকুন আতা গাছের এই সুন্দর কুঁড়েঘরে কাটাবে। এখন রেজভির মনে একটু একটু আনন্দ বাড়তে লাগল। স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে গেল। স্কুল থেকে এসে রেজভির প্রথম কাজ ঐ ছোট্ট বাসাটি দেখা। তারাও নতুন জীবনের আনন্দ চায়! শান্তি চায়! মানুষের মত অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকতে চায় না। তাদের দুটো পাখা আছে কিন্তু মানুষের কাছে নেই। নেই পাখির মত শৃঙ্খলা মানুষের। আহা! পাখির মত ভালোবাসাও নেই মানুষের!
রেজভির মন আজ অত বেশি ভালো নেই। স্কুলের সাপ্তাহিক পরীক্ষায় অংকে সামান্য নাম্বার কম পেয়েছে বলে। তবুও ক্লাসে বরাবরের মতন দ্বিতীয় স্থানটি দখলে রেখেছে। স্কুল থেকে খুব দ্রুত বাড়িতে ফিরে সোজা আতা গাছের তলায় চলে গেল। এক মনে চেয়ে রইল প্রিয় টুনটুনির বাসাটির দিকে। লক্ষ করছে আজ টুনটুনিরা বেশ পরিশ্রমী হয়ে উঠেছে। আগের চেয়ে চঞ্চলতাও বেড়েছে। বেড়েছে কিচিরমিচির সুরে মমতার সাথে রসবোধও। সেই সুর মানুষের কঠিন হৃদয়কে মোমের মত গলিয়ে দিচ্ছে। রেজভির মনে একগুচ্ছ প্রশান্তি নিয়ে সতর্কতার সাথে বাসাটি উঁকি মেরে দেখল। তৎক্ষণাৎ স্তম্ভ হয়ে চোখ-মুখ ঝলঝল করে আকাশের পানে চেয়ে কি যেন বলতে লাগল রেজভি।
Ñ হে আল্লাহ, তোমার মহিমার শেষ নেই! তুমি, টকটকে লাল গোলাপের মত না হলেও বিচিত্র রঙের এই কি দেখালে আমাকে!
তোমাকে ধন্যবাদ। আবারো উঁকি মেরে দেখল, পাখির ছানা দু’টি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে এক খন্ড ঝলসিত রোদ এসে পাখির ছানাগুলোকে বরণ করে নিচ্ছে। এখন রেজভির আনন্দ আর দেখে কে? রেজভির মনের সমস্ত বেদনা নিমিষেই মিলে গেল সেই আনন্দের ঘূর্ণিপাকে।
এবার রেজভি হাসি হাসি চেহারা নিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। উদ্দেশ্য একটাই টুনটুনি দম্পতির আগমন। নরম পাখা নেড়ে নেড়ে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ বুকে ধারণ করে টুনটুনি দম্পতিটি ফিরে এল আপনালয়ে। কিন্তু মা টুনটুনিটি বুলেটের বেগে নয় তার চেয়েও আগে উড়ে এল তার সন্তানের নীড়ে। দ্রুত ঢুকে পড়ল তার বাসায়। আতা গাছের মগডালে বসে অপূর্ব একটি সুর লয়ে কিচিরমিচির করছে। কিন্তু এই সুর রেজভির বোঝতে আর বাকি রইল না। প্রসন্ন মনে রেজভি ভাবছে-আহা! এই সুর তৃপ্তির। এই সুর একটি দায়িত্ব পালনের পর আনন্দের ঢেঁকুর। বাবা টুনটুনিটি এতক্ষণে পাশের আমগাছটিতে বসে ক্লান্তি ভাব ঝেড়ে ফেলেছে।
গাছটির ডালে বসে পাখা ঝাপড়াচ্ছে। আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডালে-ডালে লাফাচ্ছে।
রেজভি গাছটির ডালে দৃষ্টি দিতেই টকটকে লাল রক্তের ফোঁটা তার বাম চোখে এসে পড়ল। একরাশ হতাশা নিয়ে তার মুখ নিচে নামাতে গিয়েই আরেকটি লাল রক্তের ফোঁটা ডান চোখে গড়িয়ে পড়ল। আহা! দু’টি তাজা প্রাণ নিভে গেল। নিভে গেল তাদের চিরজীবন বসবাসের রঙিন স্বপ্ন। এভাবে ভেসে এলো এক ভয়াবহ মৃত্যুর চিত্র। এখন মনে হচ্ছে যেন আতা গাছটিতে দু’টি আতা আলাদাভাবে ফুটে আছে। অনেকদিন ধরে রেজভির অসাবধানতার কারণে রাস্তার দুরন্ত ছেলেরা ইট পাটকেল ছুড়ে সেই আলাদা আতা দুটোকে নষ্ট করে ফেলেছে। এখন ঐ টুনটুনির বাচ্ছা দু’টিকেও আর দেখা যাচ্ছে না। আগামীকাল সকালে কিংবা দুপুরে দখিনা বাতাসে দুল খাওয়া ডালে মায়ামাখা কিচিরমিচির শব্দের ঝংকার আর শুনা যাবে না!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ