পথের সন্ধানে   -নাবিউল হাসান

পথের সন্ধানে -নাবিউল হাসান

গল্প এপ্রিল ২০২০



অর্ধেক লাউয়ের খণ্ডটা নিয়ে চিল্লাতে চিল্লাতে বেরিয়ে এলো আবিদের দাদি। নালিশ দেয় মিলনের বাবার কাছে। মাচার ওপর সুন্দরভাবে দোল খাচ্ছিল লাউগুলো। ধান কাটা কাঁচিটা দিয়ে কখন যে মিলন এই কাজ করেছে টের পাননি রুহুল মিয়া। মিলন তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। নয় বছরের এক ডানপিটে ছেলে। তার বিরুদ্ধে লোকজনের অভিযোগের শেষ নেই। নানান জনের কাছ থেকে দিনমজুর রুহুল মিয়াকে নিত্যদিন কত কথা যে শুনতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এই মানুষটি সারাদিন পরিশ্রম করে যা পায় তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চালায়। ছেলেকে নিয়ে ভাবার সময় কই আর? প্রায় দিনই তো হালকা পাতলা শাসন করেন ছেলেটাকে। মিলনের দাদা-দাদী বেঁচে নেই বলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াও লাগে। ওকে মারলে যেন নিজেরই কষ্টটা বেড়ে যায়। অন্য দিকে মিলনের মা একজন সহজ সরল মহিলা। ছেলেকে মারলে তিনিও কান্না ধরে রাখতে পারেন না। তাই প্রতিবেশীদের অভিযোগ ও অপবাদগুলো নীরবে হজম করে যেতে চায়। কিন্তু এরপরেও মানুষের কথা আর কত সহ্য করা যায়? গ্রামের এক মুরব্বির সাথে ছেলের সম্বন্ধে পরামর্শ করলো রুহুল মিয়া। এমন বেয়াড়া আচরণ থেকে রক্ষা পেতে তিনি দূরের কোন আত্মীয় থাকলে সেখানে রেখে পড়াশোনা চালানোর পরামর্শ দিলেন। ক্লাস ফোরে পড়ুয়া ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি বাইরে কিভাবে দিবে তাও ভাবিয়ে তোলে তাকে। বাইরে রেখে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্যও তার নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন তিনি। বাড়ির কাছে পাড়ার লোকদের একটা জটলা দেখে এগিয়ে যান রুহুল মিয়া। তাকে দেখেই লোকজন গালিগালাজ বর্ষণ করতে থাকলো একাধারে। বিব্রত হয়ে সে লক্ষ করলো ছেলেকে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি খুঁটিতে। ভয়ে ও আতঙ্কে কাঁপছিল মিলন। “ছেলেকে শাসন করতে পারো না মিয়া? দিনে দিনে কেমন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে ও।” বলছিলেন আসগর আলী মাতব্বর। মাতব্বরের পা জড়িয়ে ধরেন রুহুল মিয়া। “আমার এই ছোট ছেলেটাকে এবারের মতো মাফ করে দেন চাচা। ওকে এবার গ্রামের বাইরে পাঠিয়ে দিবো।”
চাপা ক্ষোভ নিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনেন বাড়িতে। পরদিন ঢাকায় রওয়ানা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ছেলেকে কোন রিকশা গ্যারেজের কাজে লাগিয়ে দিতে হবে। তাতে এই নিত্যদিনকার বিচার-অভিযোগও শুনতে হবে না, বরং কিছু টাকাও আসতে পারে। এ বিষয়ে মিলনের মায়ের সাথে কথা বলেন রাতে। দিনের ঘটনার কারণে রাগে অভিমানে জ্বলছিলেন তিনিও। “এমন বেয়াড়া ছেলের প্রতি আর সোহাগ দেখাতে চাই না” সাফ জানিয়ে দেন রুহুল মিয়াকে। মিলন তখনও ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করছিল। এই অভিনয় না করলে হয়তো দ্বিতীয়বার পিটুনি খেতে হতে পারে যেকোন মুহূর্তে। তবে বাবা-মায়ের ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত শুনে ভিতরে শুকিয়ে গেছে কলিজাটা। ঢক ঢক করে বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। চোখের ভেতর থেকে পানি বের হতে চাচ্ছে কিন্তু জোর করে চেপে রাখতে হচ্ছে। একদিক থেকে অন্যদিকে কাত ঘুরাতেও ভয় পাচ্ছে।
একটি গভীর জঙ্গলে কিভাবে ঢুকে পড়লো মিলন বুঝতে পারেনি। এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। অন্ধকারে ঢাকা থাকলেও একদিকে ঝাপসা আলোয় সরু একটা পথ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে যেতেই কালো কুচকুচে একটা বিড়াল এক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বড্ড ভয় পেয়ে যায় মিলন। চিৎকার দিতে গিয়ে আটকে যায় সে, গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। এমন সময় বিড়ালটাই বলে উঠলো, “কিরে তুই আমাকে দেখেই ভয় পাচ্ছিস এখন? কয়েক দিন আগে তো ধারালো ফলাটা ছুড়ে আমার বাম চোখটা নষ্ট করে দিলি। আজকে একচোখে তাকিয়ে আছি দেখে অবাক হচ্ছিস খুব। আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা হতভাগা!” ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল মিলন। খানিকটা পেছনে চলে আসতে থাকে সে। কক করে চেঁচিয়ে উঠে একটা ল্যাংড়া মুরগি। আচমকা এই শব্দ শুনে ধড়াস করে লাফিয়ে উঠে হৃদপিণ্ডটা। ওরে বাবা বলে একটা চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে মিলন, কিন্তু ক্ষীণ কণ্ঠে আওয়াজই বের হতে চাচ্ছে না। এর মধ্যে পায়ে ঠোকর বসিয়ে দিতে লাগলো মুরগিটা। এরপর বললো “তুই দুইদিন আগে কাড়াল দিয়ে আমার পা ল্যাংড়া করে দিয়েছিলি, আজকে আবার কষ্ট দিলি..? তোকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।” মুরগির কথা শুনে ভোঁ একটা দৌড় দিয়ে সামনে যেতে লাগলো মিলন। শত কষ্ট করেও আগের মতো স্পিড বাড়াতে পারে না সে। প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে তবুও। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে পেছনে ফিরে তাকায়নি মিলন। মুরগিটা কতদূর এসেছে দেখার জন্যে পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। জঙ্গল পেরিয়ে এখন অনেকখানি সামনে চলে এসেছে মিলন। মুরগিটাকেও দেখা যাচ্ছে না আর। এবার বুঝি ভালোভাবে বাড়িতে ফিরে যাওয়া যাবে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে আবারও হতভম্ব হয়ে যায়। অচেনা এ কোন জায়গা মনে পড়ছে না কোনমতেই। তেমন গাছপালা নেই এখানে। কিছু কাশবন আর এলোমেলো পুরাতন কিছু গাছের গুঁড়ি যেখানে সেখানে পড়ে আছে। এমন সময় হঠাৎ তার মনে হলো এইসব তো বাঘের শিকার করার জায়গা। দুইদিন আগে মণ্ডল কাকুর দোকানে টেলিভিশনে এই জায়গাটায় দেখালো। যেখানে বাঘ আর বন্য মহিষের ভয়ঙ্কর মারামারি দেখে দৌড়ে বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে। লম্বা কেশওয়ালা সিংহ নামক প্রাণীটার চেহারার কথা ভাবতে ভাবতেই এক ভয়ঙ্কর গর্জন ভেসে এলো কানে। শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেছে মিলনের। নাক দিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নেয়। সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে, “বাঁচাও, সিংহ খেয়ে ফেললো।” কিন্তু এবারও শব্দ বের হলো না গলা থেকে। সিংহটি তার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। সামনের পা দুটো দিয়ে চেপে ধরলো মিলনকে। তারপর বাম কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে আরেকটা গর্জন দিলো। এমন সময় জীবনের শেষ চেষ্টা হিসেবে জোরে একটা লাফ দেয়। সঙ্গে চিৎকার করে উঠে, “বাঁচাও, সিংহ খেয়ে ফেললো।” দুই চোখে অন্ধকার দেখছে সে। মস্ত এক আছাড় দিয়েছে সিংহটা। এতক্ষণে হাড়গোড় হয়তো একটাও আর আস্ত নেই। এই সময় কালেমা পড়ে বিদায় নেয়া যেত, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার চিরসঙ্গী। ফলে সেটিও মনে পড়ছে না। সিংহটি এখনো কামড় বসাচ্ছে না কেন বুঝতে পারে না মিলন। চোখ দুটো আরেকবার খোলার চেষ্টা করে ভয়ে ভয়ে। কিন্তু একি? বাবার ওপর দিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারটাতে আছড়ে পড়েছে সে। ওর বাবা রুহুল মিয়া-ই নাক ডেকে সিংহের মতো গর্জন দিচ্ছিল। মিলনের চিৎকার ও লাফিয়ে চেয়ার ফেলে দেয়ার ঘটনায় হম্বিতম্বি করে জেগে ওঠে মা-বাবা। চেপে রাখা কান্নাকে দ্বিগুণ শব্দে বেগবান করে মিলন। একি স্বপ্ন, নাকি ভালো হয়ে যাওয়ার জন্য কোন পথের সন্ধান? ছেলের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে মায়া বিগলিত স্বরে তড়িঘড়ি করে নেমে আসে মা। জড়িয়ে ধরে মিলনকে। “আমি আর কারও কোন ক্ষতি করবো না মা। ভালো হয়ে যাবো। আমাকে তোমাদের থেকে আলাদা করে দিও না।” কান্নাজড়িত কাতর কণ্ঠে অনুরোধের সুর মিলনের। এগিয়ে আসে ওর বাবা। খুব মিষ্টি করে জানিয়ে দেয়, “তুই ভালো হয়ে গেলে আমি আর কিছু চাই না মিলন। তোকে বুকের কাছেই আগলে রাখবো সারা জীবন।”
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ