নীড়হারা পাখি

নীড়হারা পাখি

গল্প হারুন ইবনে শাহাদাত ডিসেম্বর ২০২৩

নীল আকাশে এক টুকরা সাদা মেঘ নিরুদ্দেশে ছুটছে। তার অনেক নিচে একটি পাখি উড়ছে। এত দূর থেকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না, ওটা কি পাখি। তারপরও হাবিব ইয়াসিরের মনে হয় ওটা একটা আবাবিল। ইয়াসিরের প্রিয় পাখি আবাবিল। সূরা ফিল তার মুখস্থ। এই সূরার আবাবিলের কাহিনীও তার জানা। সে প্রতিদিন আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে, ‘হে আল্লাহ আমার প্রিয় ফিলিস্তিনকে জালেমদের হাত থেকে উদ্ধার করতে একঝাঁক আবাবিল পাঠাও।’ এই শরণার্থী শিবিরে তার আর ভালো লাগে না। তার হৃদয়জুড়ে আল জাহারার এক টুকরো নীল আকাশ। বিস্তীর্ণ সবুজ জলপাই বন। সাজানো গোছানো ছোট অথচ সুন্দর বাড়ি। দো’তলার ছাদ নয় তো বেলকুনিতে ছোট বোন ফাতেমার সাথে রাতের আকাশের তারার মেলা, বিকেলে পাখিদের ঘরে ফেরা দেখার সেই হারানো দিনগুলো বারবার মনে পড়ে। দু’ভাই-বোন মিলে জলপাই বাগানের সবুজ শীতল ছায়ায় ছুটো-ছুটি, খালি পায়ে মাটির স্পর্শ কী সুখের ছিলো সেই দিনগুলো। হাবিব ইয়াসির আজও স্বপ্ন দেখে স্বাধীন ফিলিস্তিনের মুক্ত আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ছোট বোন ফাতেমা অনেক বড় হয়েছে। বাবা-মা ধুম-ধাম করে ওর বিয়ে দিচ্ছে। দফ বাজছে। লাল-নীল রঙিন বাতির মিষ্টি আলোয় ভরা ওদের বাড়ির সামনের জলপাই বাগান। নতুন চকচকে গাড়িতে করে বর আসছে। বরের মাথায় সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পাগড়ির মতো পাগড়ি। ছেলে-বুড়ো সবার মুখে হাসি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কথা মনে পড়তেই হাবিব ইয়াসির হারিয়ে গেল ইতিহাসের গলি পথে হাজার বছর দূরে। যেখানে নেই তার আদরের ছোট ফাতেমাকে হারানোর করুণ ব্যথার বুকফাটা কান্না। বাবার ঘরে না ফেরা। মায়ের রক্তাক্ত লাশ।

হাবিব ইয়াসির রাজনীতির মার-প্যাঁচ বোঝে না। শরণার্থী শিবিরের লাইব্রেরিতে সে ফিলিস্তিনের ইতিহাস পড়েছে। তার প্রিয় জন্মভূমির ইতিহাস বড় করুণ। তাদের বারবার পরাজিত হতে হয়েছে। এখনো চলছে ক্ষমতার লড়াই। বর্তমান আর অতীতের মধ্যে ক্ষমতার ব্যবধান অনেক কিন্তু এই লড়াইয়ের চরিত্র এক ও অভিন্ন। হাবিব ইয়াসিরের মন চলে যায় ইতিহাসের পাতায়। ১৫ জুলাই, ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ প্রথম ক্রুসেডে মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়েছিল মুসলিম বাহিনী। হাজার হাজার মুসলিমের লাশের ওপর দিয়ে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করল সম্মিলিত খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী। ক্রুসেডারদের এই বিজয়ে সর্বত্র খ্রিস্টান দেশগুলোতে শুরু হয়ে গেল বিজয়ের উৎসব। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ উৎসব হলো বায়তুল মুকাদ্দাসে। বিজয়ী ক্রুসেডার বাহিনী বেপরোয়া লুটপাট শুরু করল প্রতিটি মুসলিম ঘরে। কোনো ঘরে কোনো পুরুষ মান্‌ুষ, হোক সে বৃদ্ধ বা দুগ্ধপোষ্য শিশু, কাউকেই জীবিত রাখলো না। জীবিত ছিল শুধু কিশোরী-যুবতীরা, তাদেরকে ইহুদি সৈনিকরা কোথায় নিয়ে গেছে কেউ জানে না। 

এই পরাজয়ের ৮৮ বছর পর ৬ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই রজব ৫৮৩ হিজরিতে সম্মিলিত ক্রুসেডার বাহিনীকে পরাজিত করে বায়তুল মুকাদ্দাসে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। যে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে রাসূল (সা) বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মেরাজে গিয়েছিলেন, আল্লাহপাকের অপার মহিমায় সে রজব মাসেই মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করলেন। মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মুসলমানদের মাঝে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ দিনের বন্দিত্ব আর সীমাহীন অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দ বেদনার এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে ওঠে তাদের হৃদয়গুলো। অপর দিকে শহরের খ্রিস্টান অধিবাসীদের মনের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তারা ভাবছিল ৮৮ বছর আগে মুসলিমদের ওপর যেভাবে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম বাহিনীও প্রতিশোধ নেয়া শুরু করবে। কিন্তু ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে জানা যায় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এই ব্যাপারে উদার মনোভাব ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। তিনি তার সেনাপতি ও কমান্ডারদের শহরে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে কঠোর নির্দেশ দেন যাতে করে কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার না হয়। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা সুলতান সালাহউদ্দিনের এই মহানুভবতার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ আট শত বছর পর দখলদার ইহুদিরা হাবিব ইয়াসিরদের সাথে কী আচরণ করছে, সে কথা ভাবতেই রাগে দুঃখে ক্ষোভে ওর মনটা আবার ভারী হয়ে যায়। সে আবার হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়।

১০ জুন, ১৯৬৭ সাল। সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মুকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রায় ৮০০ বছর পর এবং ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের ৪৩ বছর পর মুসলিম বিশ্ব আবার প্রত্যক্ষ করল এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। ৮০০ বছর পর আবার মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করল ফিলিস্তিনের মাটি। ১৯২৪ সালে ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা হারায় ফিলিস্তিন। দখলদার ইহুদিরা নিজ আবাসভূমি থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাত করতে আবারও মেতে উঠে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে। হাবিব ইয়াসির সেই নির্মমতার বাস্তব সাক্ষী। সে নিজেই আজ ইতিহাস।

আর দশটা সকালের মতো সেদিনের সকালেও রক্তিম আভা ছড়িয়ে পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছিল। হাবিব ইয়াসিরের বাবা ইয়াসির মাহমুদ গাড়ি নিয়ে বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন, দু’সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবেন। ইয়াসির মাহমুদ একজন ডাক্তার। তিনি ফিলিস্তিনের আল জাহারা হাসপাতালে চাকরি করেন। লন্ডনের রয়েল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফআরসিএস করার পর ইউরোপ-আমেরিকা  ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ থেকেও তিনি বেশি বেতন-ভাতার চাকরির অফার পেয়েছেন, কিন্তু তিনি মজলুম ফিলিস্তিনিদের কথা চিন্তা করে দেশ ছাড়েননি। ইহুদি আগ্রাসনের পর থেকে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ মানুষই দখলদার ইহুদিদের নির্যাতনের শিকার। গুলি, বোমার আঘাতে আহত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তাদের ফেলে তিনি কোথায় যাবেন? 

মা ব্যস্ত হাবিব ও ফাতেমাকে স্কুলের জন্য রেডি করতে। হঠাৎ বাইরে গুলির শব্দ। তারপর একটা চিৎকার, ‘আল্লাহু আকবার, স্বাধীন ফিলিস্তিন অটুট রাখো আল্লাহ।’ গুলির শব্দ আর বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে ইয়াসির হাবিরের হাত থেকে স্কুল ব্যাগটি পড়ে যায়। ব্যাগে রাখা টিফিন বাক্সটি গড়িয়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে। মায়ের হাতে বানানো তীনের তেলে ভাজা রুটি আর দুম্বার গোশতের কিমা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মা ফাতেমাকে কোলে নিয়ে হাবিবকে জড়িয়ে ধরে বেলকুনির দিকে পা বাড়ান। নিচে তাকিয়ে যে দৃশ্য তিনি দেখেন তাতে তার বুক ফেটে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করে, সন্তানদের কথা ভেবে ধৈর্যধারণ করেন।

সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ। এখন তিনি কী করবেন? নিচে ইহুদি হায়েনাদের গুলিতে আহত আল জাহারা হাসপাতলের বিখ্যাত চিকিৎসক তার স্বামী ইয়াসির মাহমুদ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে হায়েনার দল। স্বামী-সন্তানদেরকে তিনি কিভাবে বাঁচাবেন? না তিনি আর ভাবতে পারছেন না। যুদ্ধের সময়ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী কিছু নিয়ম মেনে চলে। তারা কোনো শিশু ও নারীকে হত্যা করে না। বেসামরিক এলাকায় ভুলেও গুলি ছোড়ে না। চিকিৎসকদেরকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে প্রশিক্ষিত সেনাসদস্যরা কারণ তারা জানে চিকিৎসকরা অসুস্থ কিংবা আহত রোগীর চিকিৎসার সময় শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করেন না। তারা ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না করে সকল মানুষকে সুস্থ করার দায়িত্ব পালন করেন। তাই তাদেরকে হত্যা করা চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ। ইহুদি দখলদার বাহিনী তো যুদ্ধনীতির কোনো তোয়াক্কা করে না। তারা মানুষ নয়, মাটি চায়।

ফিলিস্তিনের মাটি মুসলিম শূন্য করে ইহুদি বসতি স্থাপনই তাদের লক্ষ্য। না। তিনি আর ভাবতে পারছেন না। দু’সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির পিছনের গোপনে দ্রুত বের হওয়ার সিঁড়ির দিকে চলে যান। তারপর জলপাই বাগানের মাঝ দিয়ে দ্রুত দৌড়াতে থাকেন। জলপাই বাগান পার হয়ে বালিয়াড়ির আড়াল থেকে পেছনে  তাকিয়ে দেখেন, তার জীবনের হাজারো স্মৃতি জড়ানো বাড়িটি হায়েনাদের দেয়া আগুনে জ্বলছে।

বাজখাই আওয়াজ তুলে ছুটে আসছে একঝাঁক জঙ্গিবিমান। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিরোধ থেকে ইহুদি হায়েনাদের পদাতিক বাহিনীকে উদ্ধার করতেই জঙ্গি বিমানের এই অভিযান।

ইয়াসির হাবিবের মা সন্তানদেরকে নিয়ে আবার বালিয়াড়িতে মুখ লুকায়। বিকট শব্দে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তারপরে আর কিছু মনে নেই ইয়াসির হাবিবের। কয়দিন পর জ্ঞান ফিরেছে তাও সে জানে না। বাবার লাশ কোথায় দাফন হয়েছে। মা ও আদরের ছোট বোন ফাতেমা বেঁচে আছে কি না, তাও সে জানে না। জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বেডে। পরে সে ডাক্তার চাচাদের কাছে জানে ইসরাইলের বোমারু বিমানের বোমার আঘাতে আহত অবস্থায় রেড ক্রিসেটের স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে এই হাসপাতালে রেখে গেছে। 

সুস্থ হওয়ার পর তার স্থান হয়েছে লেবাননের এই শরণার্থী শিবিরে। এখানে তার সময় কাটে বাবা-মা আর স্বজনহারা ফিলিস্তিনের আরো হাজার হাজার শিশু-কিশোরের সাথে। একটু সুযোগ পেলেই ইয়াসির হাজারো শিশুর ভিড়ে তার হারানো বোন ফাতেমাকে খোঁজে। মায়ের বয়সি মহিলাদের দেখলেই, ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি তাকে ডেকে বলবে, ‘বাবা হাবিব, তাড়াতাড়ি আসো ফাতেমাকে নিয়ে স্কুলে যাবে।’ মনের ভুল ভাঙার পর মনকে শক্ত করে ভাবে, কোথায় পাবেন সে তার মা ও বোন ফাতেমাকে? সে তো নীড়হারা পাখি। প্রতিদিন নিজের বাড়ি ফিলিস্তিনের আল জাহারায় ফেরার স্বপ্ন দেখে। চোখের পাতা বন্ধ করলেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে স্বাধীন ফিলিস্তিনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। রাত শেষ হয়। ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু এই কিশোরের স্বপ্নের রেশ কাটে না...!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ