নীলাভ পৃথিবীর জাদুকর

নীলাভ পৃথিবীর জাদুকর

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১৩

নাসরুল্লাহ শারাফাত রুহি

সন্ধ্যার কালো আঁধার নামল বলে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে; না হলে অসুস্থ মা তার জন্য চিন্তা করবেন। ভাবল নীলু। দুপুরে বন্ধুদের সাথে খেলতে বেরিয়েছিল নীলু। কিন্তু দারুণ এক ক্রিকেট ম্যাচ থাকায়, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলা চলল। বড় স্কুল মাঠের পাশের জঙ্গলে রাস্তা দিয়ে গেলে, দ্রুত মনপুরা গাঁয়ে পৌঁছানো যায়। পাকা রাস্তা থেকে জঙ্গলের রাস্তা ধরল নীলু। চাঁদের রূপালি জোছনায় গাছের ছায়াগুলো নীলুর কাছে বড়ই অদ্ভুত লাগছে দেখতে। ‘ভূতের ভয় লাগছে?’ মনের ভেতর থেকে প্রশ্ন করল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ‘হালকা হালকা।’ মনের প্রশ্ন মুখে দিল নীলু। ভৌতিক শিহরণ বয়ে চলেছে ওর শরীরে। সত্যিকারে ভূত এসে এখন সামনে দাঁড়ালে, বেহুঁশ হতে বেশি দেরি লাগবে না। পথে যেতে যেতে ভাবছে নীলু। ভূত নিয়ে তবে ভয় করছে হালকা হালকা। বন্ধুদের সাথে এ পথে আরো বহুবার যাতায়াত করেছে সে। কিন্তু এখন সে একা ভয়তো খানিক লাগতেই পারে। সামনে ওটা কী? নীলাভ আলো না? চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতেও স্পষ্ট লাগছে। খানিক দূরে। বাঁশঝাড়ের মধ্য থেকে আবছা আবছা নীল আলোর ঝলকানিটা দেখতে পেল নীলু। ভীতু মনে, অতি কৌতূহলে সামনে এগিয়ে গেল সে। শালগাছের পাতাওয়ালা ডালটা সরিয়েছে নীলু, তখনই নীল আলোসমৃদ্ধ তীব্র ঝলকানিটা তার বাম চোখে এসে লাগল। ডান চোখটা শালপাতার আড়ালে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে, মূর্ছা গেল নীলু। নিথর দেহটা পড়ে আছে মাটিতে। তবে প্রাণের সঞ্চার আছে। দুই মিনিট পর। ‘নীলু ছোকড়াটা নিশ্চয় আমাদের ভূত মনে করেছে।’ বলল প্রথম কণ্ঠটা। ‘কিভাবে, জানলে?’ প্রশ্ন করল দ্বিতীয় কণ্ঠ। ‘কিভাবে আবার, আমার মনে যে প্যারাসাইকোলজিক্যাল বিম ফিট করা। তোমারটায় নেই বুঝি!’ বলল প্রথম কণ্ঠ। ‘না, আমারটায় নেই। তবে নিম্নমানের তথ্য কানেকশন লাগানো আছে মগজে। কিন্তু ছেলেটা কি বেঁচে আছে?  চলো গিয়ে দেখে আসি।’ চিন্তিত স্বরে বলল দ্বিতীয় কণ্ঠ। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, এইমাত্র জানতে পারলাম বেঁচে আছে। তবে গিয়ে দেখতে কোনো বাধা নেই, কী বলো?’ বলল প্রথম কণ্ঠ। ‘অবশ্যই। এত কষ্ট করে পৃথিবীতে এলাম, আমাদের স্বজাতিদের দেখতে।’ খুশি খুশি গলায় বলল দ্বিতীয় কণ্ঠ। পাঁচ মিনিট পর  হুঁশ ফিরে এল নীলুর। চিত হয়ে শোয়া অবস্থায়ই ঘাড় ফেরাল সে। প্রথমে শালগাছ বলে ভুল করল। পরে দেখল মোটেই গাছ নয়, কালো কাপড়ে ঢাকা, লম্বা কিছু। প্রায় আট ফুট। মনে হয় ভূত! আবার মূর্ছা গেল নীলু। ‘মানুষরা এত ভিতু আগে তো জানতাম না।’ বলল প্রথম কণ্ঠ। ‘আবারো কী আমাদের ভূত বলে ভয় পেয়েছে?’ প্রশ্ন করল দ্বিতীয় কণ্ঠ। ‘হতে পারে।’ উত্তর দিল প্রথম কণ্ঠ। ‘কিন্তু একে তো হুঁশ ফেরাতে হবে দাঁড়াও আমি চেষ্টা করছি। ছয় মিনিট পর আবার জ্ঞান ফিরে এল নীলুর। তবে চারদিকে এখনও অস্পষ্ট। কালো কাপড়ে আবৃত, বিরাট শরীর দু’টোকে আবারো দেখতে পেল নীলু। ‘ভূত!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল নীলু, কিন্তু কালো কাপড়ের ভেতর থেকে লোমবিহীন হাত বাড়িয়ে দিয়ে নীলুকে থামাল ওদেরই একজন। আতঙ্কে, শিহরণে শিহরিত সে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে এখন আর ভয় পাচ্ছে না। এবার নীলুর সামনে থেকে গমগমে গলায় কথা বলে উঠল, ডান পাশের ভূতটা।  ‘ভয় পেও না বাছা, আমরা ভূত নই। কিচ্ছু করব না তোমাকে।’ বাম পাশের ভূতটা বলল, ‘ও ঠিকই বলেছে ছেলে, আমরা ভূত নই। স্রেফ মানুষ। তবে নীলাভ পৃথিবীর। তোমাদের গ্রহ বা পৃথিবী যেমন সবুজ, আমাদের তেমনই নীল। তবে সাগরের রঙ সবুজ।’ ঠিকই বলেছে লোক দুটো। এরা মানুষই, ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় মুখ দেখা যাচ্ছে। চোখ, নাক, মুখ, চুল সবই আছে। শুধু দাড়ি গোঁফ নেই, হয়তো কামানো। তাহলে তো মানুষই! অস্পষ্টে বলে উঠল নীলু। ভয় আতঙ্ক সব কেটে গেছে তার মন থেকে। বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল লোক দু’জন। আবারও দু’জনের আসল উচ্চতা বেরিয়ে পড়ল। এবার নীলু নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা মানুষ হলে এতো লম্বা কেন? দানবের মতো?’ ‘অহেতুক সন্দেহ করছ বাছা, আমরা মানুষই। তোমাদের অনেক আগে জন্মেছি। আমাদের পৃথিবীর মানুষ আরও অনেক লম্বা হয়।’ তাদের পৃথিবী! কোন পৃথিবীর কথা বলছে মানুষগুলো? ভাবল নীলু। জিজ্ঞেস করল, ‘কোন পৃথিবীর কথা বলছেন? পৃথিবী তো একটাই!’ ‘আরেক পৃথিবীর কথা বলছি। এটা দু’নম্বার পৃথিবী। আমাদেরটা তো অনেক পুরনো। কিন্তু আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ এটা (পৃথিবী) থেকে বহুগুণ সুন্দর। আমাদের পৃথিবীর মানুষ গাছ কাটে না, পরিবেশ নোংরা করে না। আমরা অনেক বুদ্ধিমান তো।’ ‘কই আমি তো এরকম কোনো গ্রহ বা পৃথিবীর কথা শুনিনি?’ ‘শুনবে কোথা থেকে। তোমাদের টেঁকি মার্কা বিজ্ঞানীরা যে আজও আমাদের গ্রহটা আবিষ্কার করতে পারল না।’ ‘ও:! তো আপনারা আমাদের পৃথিবীতে এসেছেন কেন?’ ‘এসেছি এই পৃথিবী দেখতে। এই পৃথিবীর মানুষদের ডাটা সংগ্রহ করতে।’ নীলু এবার মুখ ফিরিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনারা বলছিলেন আপনাদের পৃথিবীর মানুষ অনেক বুদ্ধিমান। তাহলে আপনারা কি আমার একটা আশা পূরণ করতে পারবেন?’ ‘কেন পারবো না। বলে ফেলো তোমার আশাটা, দেখি পূরণ করতে পরি কি না?’ ‘দেখুন, আমার মা এক জটিল দুরারোগ্য রোগÑ ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তার চাচা বলেছেন, মা নাকি আমার আর মাসখানেক বাঁচবেন। আপনারা কি পারেন না আমার মায়ের রোগ সারিয়ে দিয়ে, আমার আর আমার ছোট ভাই রাফির কাছে ফিরিয়ে দিতে?’ বলেই কাঁদতে লাগল নীলু। ‘হ্যাঁ, কেন পারব না? অবশ্যই পারবো। মা আমাদেরও আছে। তবে তাদের রোগ-শোক নেই।’ বলেই প্রথম জন তার কালো কাপড়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। বের করে আনল জাজ্বল্যমান নীলাভ একটি ‘পাথর’। বলল, ‘এই নাও, এটা তুমি তোমার মাকে পানির সাথে খাওয়াবে। পানিতে দেয়া মাত্র ওষুধটা গলে যাবে।’ এমন সময় হঠাৎ কোনো একজনের কালো কাপড়ের ভেতর বেজে উঠল, বিপ.. বিপ.. বিপ...। বাম পাশের লোকটি অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে ছিল। এবার সে তার কালো কাপড়ের আসতিন থেকে বের করে আনল সবুজ রঙয়ের উজ্জ্বল একটা যন্ত্র এবং জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘সিনিয়র, কাছে পিঠে কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ আছে। তারা দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে। চল, যত দ্রুত পারা যায়, এই পৃথিবী ছেড়ে পালাই।’ ‘আমাদের সময় শেষ, এখন যেতে হবে’Ñ এই বলে দু’জনেই উঠে দাঁড়াল। হাত নেড়ে প্রথম জন বলল, ‘ছেলে, তোমার সাথে আবার দেখা হবে। তোমার নাম আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসে প্লাটিনাম অক্ষরে লিখে রাখব। চলি, গুডবাই।’ নীলু কোনো কথা বলল না শুধু দেখল, বিরাট ভঁপু নিয়ে অন্য পৃথিবীর মানুষ দুটো হারিয়ে যেতে লাগল নীলাভ আলোর মাঝে। ঠিক তার পরেই নীলু দেখল তার বাবা এবং তার বন্ধুরা তাকে দেখে, তার দিকে, খুশি হয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই নীলুকে খুঁজছিল তারা। এক বছর পর। অন্য পৃথিবীর দয়ালু ওই দু’জনের ওষুধ খেয়ে নীলুর মা সবাইকে অবাক করে দিয়ে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠল। এখন নীলুর মনে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু একটা আক্ষেপ আছেÑ সে তো ওই দু’জনকে একটা ধন্যবাদও দিতে পারল না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ