নানার উপহার    -শরিফ আহমাদ

নানার উপহার -শরিফ আহমাদ

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছড়া কাটছে আফরিন। আবৃত্তির ঢংয়ে। নানাকে শুনানোর জন্য। খুশি করার জন্য। ও আজ মায়ের সাথে এসেছে নানাবাড়ি। এসে নানাকে পায়নি। তিনি অফিসে গেছেন। ফিরবেন বিকেলে। এই সুযোগে নানুর সাথে গল্প করেছে। খেয়েছে। একটু ঘুমিয়েও নিয়েছে। বিকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরেছে। আন্টি মায়মুনা সাজিয়ে দিয়েছে। বেণি বেঁধে দিয়েছে চুলে। টুকটুকে লাল ড্রেসটা পরেছে নিজে। দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে। পা জোড়া সমান রেখায়। দৃষ্টি আয়নার দিকে। কেউ ঘরে ঢুকলে দেখা যাবে। এই মাত্র ঘরে এলেন নানু। চোখের পলক না ফেলেই দেখলো। আবৃত্তি চালিয়ে গেলো। কী ভেবে একটু থামলো। এগুলো তার দিকে। তিনিও কাছে এলেন। বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-
একটু সবর করো
তোমার নানা আসবে
অনেক সময় দেবে তোমায়
এবং ভালোবাসবে।
নানুর কথায় সান্ত¡না পেলো সে। কোল ছেড়ে পুতুলটা নিলো। আন্টির কাছে গেলো। তিনি লিখছিলেন। তিনি লেখিকা। প্রায় সময়ে লিখেন। ছড়া-কবিতা বেশি লিখেন। গল্পও লিখেন। পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। তার নানার ফ্যামিলির সবাই শিক্ষিত। নানা একজন বড় মাপের কবি। পত্রিকায় কাজ করেন। বড় মামা সাংবাদিক। নানীও লিখেন মাঝে মধ্যে। নানীর থেকে মূলত বেশি প্রেরণা পান আন্টি। আফরিনকে দেখে তিনি লেখা বন্ধ করলেন। ডায়েরিটা রাখতে রাখতে বললেন,
চলো ছাদে গিয়ে বসে
বলবো নানান কথা
গল্পে সময় চলে যাবে
কমবে মনের ব্যথা।
দু’জনেই বেরোলো। হাত ধরাধরি করে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রিলঘেরা সুন্দর ছাদ। ছাদের এক দিকে একটা রুম। ওখানে নানাভাই সজীব সরোজ সাহেব থাকেন, প্রতিদিন অফিস থেকে এসে। ঘরটায় বইয়ের স্তূপ। এখানে নিরিবিলি তিনি বইপত্র পড়েন। এবং লেখালেখি করেন। ছাদের অপর পাশে দুটো চেয়ার। এখানে আন্টি ও নানু প্রায় সময় বসেন। গ্রিল ঘেঁষে অনেক টব। টবে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি নানা ফুল। চেয়ারে না বসে ওরা ফুলের কাছে বসলো। একদম মুখোমুখি। চোখাচুখি। মৃদু হাওয়ায় ফুলগুলো দুলছে।
বাহ! সুন্দর হয়েছে। অনেক সুন্দর। মিষ্টি করে বললো আফরিন। কবিদের একটাই সমস্যা। যা দেখবে ছন্দ খুঁজবে। অন্য রকম তালে থাকবে। ছড়া-কবিতা লিখবে। আচ্ছা আন্টি আকাশ নিয়ে একটা বানাও তো। আবদার ঝরে পড়লো আফরিনের গলায়।
শোন, কবিরা ইচ্ছা করলে কবিতা লিখতে পারে না। ভাব লাগে। সময় লাগে। চিন্তার প্রয়োজন হয়। আরো অনেক কিছু লাগে। তার পরে হয় কবিতা। উৎকৃষ্ট ছড়া।
: বুঝেছো?
: হুম !
: তুমি আবদার করেছো তাই একটা ছড়া শোন। আকাশকে নিয়ে লেখা। ছড়ার নাম নিরালা রাত। তারপর তিনি আবৃত্তির ঢংয়ে বলে গেলেন ছড়াটা।
: আচ্ছা আন্টি! আকাশে সূর্য তো থাকে। সে এমন রাগি কেন? তার দিকে তাকানো যায় না। দুপুরে রুপার থালার মতো জ্বল জ্বল করে। আর ড্রাগনের মতো ফোঁস ফোঁস করে। এমন রাগ না দেখালে কার কী ক্ষতি হতো? অথচ চাঁদকে দেখো। রাতে কী স্নিগ্ধ আলো ছড়ায়। ফুল ফোটে। ঘ্রাণ ছড়ায়। কার না ভালো লাগে! সূর্যটা চাঁদের মতো হলে কি ভালো হতো না?
: না হতো না। সূর্যটা চাঁদের মতো হলে আলো কোথায় থেকে পেতে? পেতে না। চাঁদের কোনো নিজস্ব আলো নেই। সূর্য থেকে ধার নেয়। তাছাড়া সৃষ্টিকর্তা যাকে যে কাজের জন্য বানিয়েছেন সেটাই তো সে করবে। করে। করা উচিত। সূর্য অমন রাগ না দেখালে কি ভোর হতো? হতো না। পাখ-পাখালি জেগে উঠতো? উঠতো না। মানুষ কাজে যেতো না। কোনো কিছুই ঠিক মতো হতো না। পরিবেশের অনেক ক্ষতি হতো।
: ঠিক আছে! ঠিক আছে! জানবো। একশোবার জানবো। এখন একটা গল্প বলো। লম্বা গল্প। গল্প শেষ হতে হতে যেন নানা ভাই আসেন।
দু’জনে অনেকক্ষণ ছাদে থাকলো। গল্প করলো। বিকেলের হালকা রোদ উপভোগ করলো। তার পর সন্ধ্যায় নিচে নেমে গেলো।
রাত ৮টা। ঘড়ির কাঁটা সামনে বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে। তবু সজীব সাহেব আসছেন না। তাই গাল ফুলিয়ে বসে আছে আফরিন। কিছু খাচ্ছেও না। শেষ পর্যন্ত ৮টা ৩০ মিনিটে তিনি এলেন। তিনি কাল রাতেই শুনেছেন তারা আসবে। আফরিন নিজে ফোনে কথা বলেছে। অন্য কোথাও যেতে মানাও করেছে। তিনি কথা দিয়েছিলেন। অফিসে যাবেন না। তাকে এবার সময় দেবেন। গত বারের মতো হবে না। কিন্তু হঠাৎ সকালে ফোন এলো। অফিস থেকে। জরুরি ভিত্তিতে হাজির হতে হবে। ওপর বসের হুকুম! কী আর করা! গেলেন। কাজ শেষে শাহবাগের এক সাহিত্য আড্ডা শেষে তবে বাসায় এলেন। আফরিন দেখেও না দেখার ভান করলো। কাছে তো এলোই না। কথা বললো না পর্যন্ত। তিনি তার রাগ বুঝতে পারলেন। অভিমান ভাঙার জন্য আগে কাছে গেলেন। হাসানোর মতো কৌতুক বললেন। কাজ হলো না। কাতুকুতু দেয়ার চেষ্টা করলেন। বহু চেষ্টা আর কৌশল ব্যয়ের পর ছড়ায় ছড়ায় নাতনীর রাগ ঝরালেন। দেরির জন্য মাফ চাইলেন। তারপর নানা-নাতনীর ভাব জমলো। চললো গল্প। অনেক রাত পর্যন্ত।
সজীব সাহেব ক্লাস ফোরে পড়া নাতনীকে অনেক ছড়া-কবিতা মুখস্থ করিয়েছিলেন। পড়তে দিয়েছিলেন শিশুতোষ ছড়া, গল্প, কমিকসের বইÑ সেগুলো পড়েছে কী না যাচাই করলেন। আফরিন একশোয় এক শ’ নাম্বারে পাস করলো। তিনি খুব খুশি হলেন। এবং ব্যাগ খুলে বের করলেন নতুন বই। উপহার দিলেন একটি চমৎকার ছড়ার বই।
নানার সান্নিধ্যে দুই দিন ছিলো আফরিন। তারপর বাড়ি ফিরে গেছে। এর মধ্যে নানার কাছে কত গল্প, ছড়া, গান শুনেছে তার কোনো হিসাব নেই। ঘুরেছে। কেনাকাটা করেছে। শিশুপার্কে গিয়েছে। জাদুঘর দেখাও বাদ যায়নি। কাজী নজরুল ইসলামের কবর জিয়ারতও করেছে। এই দুইদিনে নানার কাছ থেকে সে পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। লেখাপড়ার অদম্য স্পৃহা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কৌশল।
নানার অসংখ্য উপহারের মধ্যে একটা ডায়েরি ছিলো। দেয়ার সময় তিনি বলেছেন তাতে লিখতে। প্রতিদিনের মনের কথা, ইচ্ছা, স্বপ্ন, ছোট ঘটনা সব কিছু। তিনি আরো বলেছেন এগুলোকে রোজনামচা বলে। রোজনামচা সবার লেখা দরকার। লেখা উচিত। রোজনামচা লেখক হতে সাহায্য করে। বড় কবিরাও লিখেন। তাই সে নিয়ত করেছে লিখবে। নিয়মিত। লেখিকা হবে। একজন লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন ও পেয়েছে এবার নানাবাড়ি থেকে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ