নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ

নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ

স্মরণ মে ২০১০

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তোমাদের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে তোমাদের আরো জানতে ইচ্ছে করে না? আমি জানি, তোমরা এক বাক্যে বলবে, হ্যাঁ, ইচ্ছে করে। শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে আমারও জানতে আগ্রহ ছিলো বলা যায় শৈশব থেকেই। আমি তখন গাঁয়ে। রেডিওতে তাঁর আবৃত্তি শুনেছি। আমার মন কেড়ে নিয়েছিলো তাঁর দরাজ গলায় আবৃত্তি করা কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা। তখন থেকেই তাঁকে দেখার একটা বড় সাধ ছিলো। ১৯৭৯ সালের কথা, তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছি না। তোপখানা রোডে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখা হলো কবি আবদুল মুকিত চৌধুরীর সাথে। আগেই জানতাম শাহাবুদ্দীন আহমদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগে কাজ করেন। কবি আবদুল মুকিত চৌধুরীর সাথে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় শাহাবুদ্দীন আহমদকে দেখার কথা বললাম। তিনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন শাহাবুদ্দীন আহমদের অফিস কক্ষে। দরজায় দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ইনি শাহাবুদ্দীন আহমদ। ভয়ে ভয়ে শাহবুদ্দীন আহমদের রুমে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে বসতে বলে একটি বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছেন। পাশাপাশি একটা করে বাদাম ছিলে মুখে দিচ্ছেন। আমি তাঁর ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি কবি নজরুলকে দেখেছি। মনে হলো নজরুলের চেহারার সাথে শাহাবুদ্দীন আহমদের যথেষ্ট মিল। তখন মনে হয়েছে যেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। শাহাবুদ্দীনের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে আমি অভিভূত হলাম। নিবদ্ধ দৃষ্টির অধিকারী ডাগর ডাগর বিরল চোখ। উন্নত, প্রশস্ত ললাট এবং সুদৃশ্য নাক এবং নিটল দৈহিক গঠন আমাকে অভিভূত করে, আন্দোলিত করে। বইটা বন্ধ করে বড় বড় চোখ করে তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোমার? লেখালেখি করো বুঝি! কথা বলতে বলতে পুনরায় বইয়ের পাতায় নজর দিলেন। আমি নিজের নাম বলতেই, ত্বরিত ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছোটদের ফররুখ’ নামে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কি তোমার? খুব ভালো। ছোটদের জন্য এই বইটি লেখাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। মনে মনে তোমাকে খুঁজছিলাম। তারপর তিনি আমাকে অনেক পরামর্শ দিলেন। এভাবে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর শাহাবুদ্দীন আহমদের সাথে ‘সাপ্তাহিক অগ্রপথিক’ পত্রিকায় কাজ করেছি। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি। শাহাবুদ্দীন আমহদকে দেখলে মনে হতো এক রাজপুত্তুর। আসলেও তাই। জমিদার পরিবারের ছেলে তিনি। এখনো তাঁর পৈতৃক ভিটা জমিদার বাড়ি তাঁর পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। ধারণ করে আছে শাহাবুদ্দীন আহমদের ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি। ১৯৩৬ সালের ২১ মার্চ। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বশিরহাটের আরশুল্লাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শাহাবুদ্দীন আহমদ। তাঁর পিতার নাম আফিল উদ্দীন আহমদ ও মাতা মোমেনা খাতুন। তিনি পিত্রালয়ে থেকেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৫২ সালে বাদুড়িয়া মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে তিনি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাস করেন। তখন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা হতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তারপর তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে আইএ পড়াশোনা করেন। এই কলেজটির এক সময় নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ। বর্তমানে নাম আবুল কালাম আজাদ কলেজ। সময় বদলায় না, মানুষ বদলায়। ইতিহাস বদলায় না, মানুষই ইতিহাস নির্মাণ করে। বিষয়টি যখন এরকম, তা হলে শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তোমাদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যখন ভারত জুড়ে ভিন্নতর আবহাওয়া বইতে শুরু করে এবং যা এদেশের মাটি, মানুষ এবং নিসর্গ চলমান উত্তাপ সৃষ্টি করে, তখন কোনো সহসা থেমে যাওয়া অথবা পূর্বালয়েই যা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় অস্বীকৃত এবং উপেক্ষিতÑ বাঁশরি বাজানো? শাহাবুদ্দীন আহমদ এই চলমানতা থেকে দূরে নন। তা হলে তিনি কী করলেন? ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে নিজের জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৫৩-১৯৫৪ সালে তিনি খুলনার বিএল কলেজে আইএসসি পড়েন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তার একাডেমিক পড়াশোনা আর এগোয়নি। ১৯৬৩ সালে তিনি নূরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন। তিনি দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক ছিলেন। তাঁর কন্যারা হলেন রোখসানা নাজনীন ও নুসরাত শাহাব। পুত্ররা হলেন নূরউদ্দিন আহমদ ও সালাহ উদ্দিন আহমদ। দুঃখজনক হলো, তাঁর বড় ছেলে নূরউদ্দিন আহমদ যুবক বয়সেই ইন্তেকাল করেন। শাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের মুখপত্র ‘লেখক সংঘ পত্রিকা’র সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ‘আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরাম’-এরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালে লেখক সংঘ পত্রিকা ‘পরিক্রম’ নামে প্রকাশিত হলে তিনি তারও সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। এবং ক্রমশ সংস্কৃতি ও সাহিত্য জগতে এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নাগরিক’ এর সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ সালে ‘নজরুল একাডেমী’ পত্রিকার সম্পাদক হন। ১৯৭৫-১৯৭৭ পর্যন্ত ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনা সংস্থার খণ্ডকালীন সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে শাহাবুদ্দীন কিছু দিনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য গবেষণা পত্রিকার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮০ সালের মার্চে ঢাকা ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রকাশনা সংস্থায় অনিয়মিত সম্পাদক হিসেবে ও পরে ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়মিত সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক অগ্রপথিক’ পত্রিকার তিনি প্রথম নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অবসর গ্রহণের পর দৈনিক ‘আল মুজাদ্দেদ’-এ প্রথমে সহকারী সম্পাদক এবং পরে প্রধান সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৬৮ সাল থেকে নজরুল চর্চায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই নজরুল গবেষক হিসেবে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন এবং বিপুলভাবে অভিনন্দিত হন। ‘নজরুল বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে তিনি সর্বমহলে স্বীকৃত। ১৯৮৫ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য করা হয়। শাহাবুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণীর সমালোচক, সাহিত্যিক ও কাব্যরসিক। অনুবাদ সাহিত্যেও তাঁর খ্যাতি আছে। এ ছাড়া তিনি একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার। তাঁর একক ও যৌথ আবৃত্তির একাধিক ক্যাসেট রয়েছে। তাঁর পরিবারে সঙ্গীতচর্চা ছিল। এ কারণে সঙ্গীতের প্রতিও তাঁর একটি সহজাত দখল এবং আকর্ষণ ছিল। শাহাবুদ্দীন আহমদ বিশাল হৃদয়, নির্মল মানস চরিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। মানবতাবাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুশীলনকারী। সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। ব্যক্তিস্বার্থের কাছে তিনি কখনো নৈতিক ও আদর্শিক স্বার্থ বিসর্জন দেননি। সত্যিই তিনি অপ্রতিরোধ্য, হিমালয়ের মতো অটল অবিচল ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন সাহসী পুরুষ ছিলেন। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের আদর্শগতভাবে উজ্জীবিত করতে সচেতন মুসলিম মনীষা, দার্শনিক কবি-সাহিত্যকদের কাতারে যাদের নাম রয়েছে সেখানে শাহাবুদ্দীনের জীবন দর্শন ব্যক্তি ও ভাবনায় স্বতন্ত্র এক মুখপত্র। তাঁর সমস্ত চিন্তায় কবি নজরুলের মতো কালজয়ী পুরুষের ভাবনার ছায়া পড়েছে। এই ভাবনায় তাঁর মানস গড়ে উঠেছে মানবতাবাদের মজবুত ভিতের ওপর। অন্তরে-বাইরে অভিন্নতা, সততা ও বিশালতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছে দুর্দান্ত সাহসী ও তেজস্বী। ব্যক্তিজীবন, প্রাত্যহিক, ব্যবহারিক জীবনে, কর্মে তার দৃষ্টান্ত রেখেছেন সারা জীবন জুড়ে। শাহাবুদ্দীন আহমদ বাংলা সাহিত্যের একজন প্রকৃত গবেষক। তাঁর ত্যাগ ও পরিশ্রমের সম্মান এ দেশ ও জাতি কোনদিন দিতে পারবে না। তবুও তিনি কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন : সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা নজরুল পরিষদ পুরস্কার, চুরুলিয়া নজরুল একাডেমী কর্র্তৃক প্রদত্ত নজরুল পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি পুরস্কার, দুবাই ইংলিশ স্কুল প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদ পুরস্কার, স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদ প্রদত্ত নজরুল পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার প্রভৃতি। প্রিয় মানুষ শাহাবুদ্দীন আহমদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি রেখে গেছেন তাঁর সাহিত্যের বিশাল সৃষ্টি। এসো আমরা দু’হাত তুলে এই সৎ ও সাহসী ব্যক্তিত্বের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাত দান করেন।

লিখেছেন: শরীফ আবদুল গোফরান

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ