নক্ষত্রের ভাবনা -তমসুর হোসেন
গল্প আগস্ট ২০১৭
নক্ষত্র একটা কাজ করেছে আজ। সহপাঠী রীনাকে দারুণ একটা ডাব্বা মেরেছে। রীনা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো রাইস মানে কী? ও বলেছে ওপরে ওঠা। কেন বলবে সে রাইস মানে ভাত? সেদিনও নক্ষত্রের একটা অঙ্ক ভুল করে দিয়েছিল। রীনার কথা শুনে সে পরীক্ষায় ভুল লিখেছিল। আজ নক্ষত্রের সব কমন পড়েছে। মাথা ঘোরাবার সময় নেই ওর। পেছন থেকে বারবার রীনা ওকে বিরক্ত করছিল। ‘নক্ষত্র ভাইয়া। বলো না রাইস মানে কী?’ ‘রাইস মানে কি যেন।’ ‘বলো না ভাইয়া। আমার মনে আসছে না।’ ‘আমারও তো মনে নেই।’ ‘ইস, রাইস মানে জানো না?’ ‘ও মনে পড়েছে। রাইস মানে ওপরে ওঠা।’ রীনাকে অমন করে বলার পর খুব ভয় করছে নক্ষত্রের। ও যদি ইংরেজি স্যারকে বলে দেয়। তাহলে খেয়েছে। স্যার কান টেনে লাল করে দেবে। ওর কাছে জেনে ক্লাসে ফার্স্ট হবে রীনা। তাহলে অঙ্কটা ভুল করে দিলো কেন? বাবাকে বিষয়টা বললো নক্ষত্র। ‘বাবা, আজ কি হয়েছে জানো?’ ‘কিসের কথা বলছো?’ ‘আজ রীনাকে ডাব্বা মেরেছি।’ ‘এটা আবার কেমন কথা।’ ‘আমাকে বলে রাইস মানে কি? আমি বলেছি ওপরে ওঠা।’ ‘রাইস মানে ভাত। তুমি ভুল বলেছো।’ ‘ওটাই তো ডাব্বা। তুমি এখনো বোঝোনি।’ বড় চাচার লিচু বাগানের পাশে একটা গভীর খাল আছে। সেখানে বাবু ভাইয়ার সাথে ও মাছ ধরতে যায়। বাবু ভাইয়া ডাক্তারি পড়ছে। এবার পাস করে বের হবে। নক্ষত্রের মনে হয় না ও ডাক্তারি পাস করতে পারবে। বড়শি ফেলে বাবু ভাইয়া যেভাবে বসে থাকে তাতে ডাক্তারি চলবে না। রোগীরা চেম্বারে কষ্ট করবে আর বাবু ভাইয়া বড়শি ফেলে বসে থাকবে। বাবু ভাইয়াকে নক্ষত্র জিজ্ঞেস করে, ‘বাবু ভাইয়া, দাঁতের ডাক্তারি আবার কেমন?’ ‘দাঁতের অসুখ হয় না? তার চিকিৎসা দাঁতের ডাক্তার করে।’ ‘তুমি যে শুধু মাছ ধরো। রোগী দেখবে কখন?’ ‘ধুর পাগল। সব সময় মাছ ধরবো নাকি।’ ‘না ধরে থাকতে পারবে?’ ‘এখন কাজ নেই। তাই মাছ ধরে সময় কাটাই।’ নক্ষত্র ডাক্তার হবে না। ডাক্তার হলে রোগী নিয়ে ঝামেলা হবে। তার চেয়ে মিজু ভাইয়ার মতো কলেজের লেকচারার হবে। মিজু ভাইয়া বাড়ি এসে নভেল পড়ে। বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। আর বড় চাচা রোগীর সাথে ক্যাচম্যাচ করে দিন কাটায়। একটা রোগী বড় চাচার গায়ে বমি করে দিয়েছে। মানুষের বমির যা গন্ধ। বড় চাচীর কী রাগ! ‘তুমি কি রোগীর গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকো?’ ‘কী বাজে কথা বলো?’ ‘তাহলে গায়ে বমি করলো কি করে?’ ‘রোগী পরীক্ষা করতে হবে না। পাগলের মতো কথা বলে?’ জানালা দিয়ে বড় চাচাকে পরখ করে নক্ষত্র। বড় চাচা ঔষধ লিখে বলে সাত দিন পরে আসবেন। আর ভালো করে খাওয়া দাওয়া করবেন। নক্ষত্র ভাবে ডাক্তারি কোন বিষয়ই না। ইচ্ছে করলে সেও পারবে। একদিন সে মমিন কাকুর ঔষধের দোকানে বসে ছিল। সে দেখলো স্কুলের প্রহরী বীরেন দাদা যাচ্ছে। ওর মনে হলো বীরেন দাদার কঠিন অসুখ হয়েছে। একটু সাজেশন দেয়া দরকার। ও ডাকতে লাগলো- ‘বীরেন দাদা, একটু শুনুন তো।’ ওর কথা শুনতে পায়নি বীরেন দাদা। সে আপনমনে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। নক্ষত্র আরও জোরে ডাকতে থাকে। ‘দাদা, শুনছেন না কেন?’ ‘কে, নক্ষত্র নাকি? এখানে কী করছো?’ ‘ঔষধের নাম শিখছি। আপনার শরীর খারাপ নাকি?’ ‘কই নাতো। আমি তো ভালোই আছি।’ ‘না না, আপনার শরীর আগের মতো নেই। ভালো করে খাওয়া দাওয়া করবেন।’ ‘তা বেশতো! ভালো দেখে একটা ফাইল দাও দেখি।’ ‘আজ না। আর একদিন আসবেন। আপনাকে একটা ফাইল দেবো আমি ।’ নক্ষত্রের বাবার মনটা বুঝি ভালো নেই। বাবার মুখ দেখেই সে বুঝতে পারে। নিলয়টা ইদানীং বেশ পাজি হয়েছে। সে বাবাকে যখন তখন বিরক্ত করে। বাবার মন খারাপ দেখলে নক্ষত্র চুল টেনে দেয়। পাকা চুল তুলে মনটা ভালো করার চেষ্টা করে। বাবার মন বুঝে নক্ষত্র বলে- ‘বাবা, আজ কি হয়েছে জানো?’ ‘কেমন করে জানবো। সারাদিন তো বাইরে ছিলাম।’ ‘একটা ছেলে একজন মুরুব্বিকে অপমান করেছে।’ ‘তাই নাকি? এমন ঘটনা কোথায় ঘটেছে?’ ‘বাজারের পান হাটিতে।’ ‘বেশ খারাপ ঘটনা দেখি।’ ‘বাবা, তোমাকে কেউ অপমান করলে আমাকে বলবে।’ ‘কী করবে তুমি?’ ‘কী যে বলো! তোমার অপমান আমি সহ্য করতে পারবো?’ ‘কী করবে? বলো না শুনি।’ ‘সময় হলে বুঝবে। এমন লাথি মারবো, জান রাখবো না।’ নক্ষত্রদের বাড়ির চালাটা বেশ বড়। দাদু মরে যাওয়ার পর ওর বাবারা এক বাড়িতে আছে। নক্ষত্রের বাবার একটা জমি আছে কলোনির পাশে। ডাক্তার চাচা প্রায়ই বলে বাড়ি ভেঙে ওদেরকে সেখানে যেতে হবে। একদিন বড় চাচা লোক ডেকে বাড়িচালার জমি মাপজোখ শুরু করলেন। মিজু ভাইয়াকে বড় চাচা বলতে লাগলেন, মিজু, নক্ষত্র কোথায় গেলো? ওকে বলো ওরা যেন কলোনির জমিতে যেয়ে বাড়ি করে।’ কথাটা শুনে নক্ষত্রের টেনশন বেড়ে যায়। সে বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে, ‘বাবা, এদিকে শোনো। এসব কী শুনছি?’ ‘কিসের কথা বলছো?’ ‘আমাদের নাকি কলোনিতে যেতে হবে?’ ‘তেমন কথা আমিও তো শুনছি।’ ‘যাবে তুমি কলোনিতে?’ ‘আমি তো যাবো না।’ ‘বাবা ঠিক বলছো তো? বুকে সাহস রাখো। এ বাড়ি ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না।’ একদিন মাথা খাটিয়ে নক্ষত্র একটা গল্প লিখলো। একটা বাসায় পাখির দুটো ছানা। ছানারা তার মাকে বললো, মা আমরা কি উড়তে পারবো না? মনের সুখে গান গাইতে পারবো না? কীটপতঙ্গ ধরে খেতে পারবো না?’ এভাবে অনেক বড় একটা গল্প লিখেছে সে। গল্পটা লিখতে তার বেশ কয়েকদিন লেগে গেছে। ছোটভাই নিলয় বললো পেপারে দিলে গল্পটা ছাপবে। পেপারে দিতে গেলে লেখাটা ফটোস্ট্যাট করতে হবে। নক্ষত্র পয়সা পাবে কোথায়। বই খাতার পয়সা জোগাড় করতে বাবা হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপর লেখা ছাপার কথা বললে বাবা কষ্ট পেতে পারে। সে গল্পটা ছিঁড়ে ফেললো। লেখাপড়া শেষে চাকরি হলে অনেক গল্প লিখতে পারবে সে। একদিন বাবা দেখলো নক্ষত্র মাথা ন্যাড়া করে বাড়ি ফিরেছে। যে ছেলেকে ধরে নিয়ে মাথার চুল কেটে দিতে হয় সে কিনা মাথা ন্যাড়া করে এসেছে। অবাক হলো বাবা ওর কাণ্ড দেখে। বাবা নক্ষত্রকে ডাকলো, ‘নক্ষত্র, এদিকে শোনতো।’ ‘কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো। গোসল করতে হবে আমাকে।’ ‘মাথার চুল কী হলো। কে ন্যাড়া করতে বলেছে?’ ‘ভাইয়া বলেছে।’ ‘কোন ভাইয়া?’ ‘ঐশী হোটেলের ভাইয়া। উনি আমাদের কমান্ডার।’ ‘উনি কিসের কমান্ডার?’ ‘কেন, রিংকু বাহিনীর কমান্ডার।’ ‘আমি তো রিংকু বাহিনীর নাম কোনো দিন শুনিনি।’ ‘বাবা, তুমি দেখি কিছুই জানো না। রিংকু বাহিনী এখন কত কি করছে।’ খুব অবাক হয় বাবা নক্ষত্রের কথা শুনে। এ ছেলে কার কথায় কী করে বেড়াচ্ছে কে জানে। কোথাকার রিংকু বাহিনীর চালে মাথা ন্যাড়া করে বিশ্রী হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মা এ দৃশ্য দেখে খুব মন খারাপ করে। এমনিতো সে মায়ের সাথে কথায় কথায় তর্ক করে। তার ওপর হুট করে মাথা ন্যাড়া করে এসেছে। ওকে রান্নাঘরে আসতে দেখে মা বলে, ‘ভাত দেবো মনে করেছো। ভাত খাবে ঐশীর হোটেলে।’ ‘তুমি ভাত রাঁধোনি? টাকা দাও হোটেলে যাই।’ ‘যার কথায় মাথা ন্যাড়া করেছো সেই ভাত দেবে।’ ‘রিংকু ভাইয়ার তো হোটেল নেই। উনি হোটেলের ম্যাসিয়ার।’ ‘একটা ম্যাসিয়ার তোদের কমান্ডার? যা সামন থেকে।’ ‘কথা পরে বলো। ভাত দাও খিদে পেয়েছে।’ ‘বললাম তো ভাত খাবে হোটেলে। বাড়িতে তোমার খাওয়া হবে না।’ ‘আগে ভাত দাও। ভাইয়া এ ঘটনা জানলে তোমাদের সমস্যা হবে।’ ‘কী সমস্যা হবে বলতো শুনি?’ ‘সমস্যা হবে না? ছোট বাচ্চাদের যখন তখন শাসন করছো।’ ‘শাসন বন্ধের পথ বের করলে। তাই না নক্ষত্র?’ ‘তোমরা যদি কথা না বোঝো তাহলে উপায় তো বের করতেই হবে।’ ‘ছেলে হয়ে এমন কাজ করতে পারলে?’ ‘ওসব কথা রাখো। সদস্য বাড়াতে হবে। মাথায় একটাই চিন্তা।’ নক্ষত্রকে ভাত দিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকে মা। মায়ের কষ্ট তাহলে কোন কাজে লাগেনি। রিংকু বাহিনীর সাথে মিশে সে বাজে কথা শিখছে। স্নেহে ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে চায়। ভাত মুখে তোলে না মা। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অন্য ঘরে। নক্ষত্রের সাথে কোন কথা বলে না। মায়ের কোন সাড়া পায় না নক্ষত্র। মায়ের মুখখানা মলিন হয়ে গেছে। সারা রাত বিছানায় ছটফট করে নক্ষত্র। কেন সে মাকে অমন করে বলতে গেল। কমান্ডার তাকে যেসব কথা বলে তা মাকে বলা উচিত নয়। সকালে নক্ষত্র মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ের কোমল পরশ না পেয়ে তার হৃদয় শুকনো পাতায় ভরে গেছে। একটি কথাও সে বলতে পারে না মাকে। বোবার মতো শুধু কাঁদতে থাকে। মা কোন কথা বলে না। নক্ষত্রকে কাছে টেনে নেয় না মা। নক্ষত্র বুঝতে পারে মা মন খারাপ করেছে। কাছে যেয়ে নক্ষত্র বলে, ‘মা আমি ভুল করেছি। আমাকে মাফ করো।’ ‘এখন তুমি বড় হয়েছো। মায়ের তো প্রয়োজন নেই।’ ‘আমি বুঝেছি মা। আমার ওপর রাগ করেছো।’ ‘কী জন্য রাগ করবো? তোমাকে প্রশ্রয় দেয়ার জায়গা হয়ে গেছে। সেখানে যাও।’ ‘দুপুর থেকে খাওনি। আমার চোখেও ঘুম আসেনি। কাছে নাও আমাকে।’ ‘বাজে লোকের কাছে যাবে কোন দিন? কথা দাও।’ ‘তুমি দেখবে। তোমার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবো না।’ নক্ষত্রকে বুকে নিয়ে মা অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে। মায়ের চোখের পানিতে ভিজে নক্ষত্র এক নতুন পৃথিবীর সন্ধান লাভ করে। হ
আরও পড়ুন...