দৈত্যের দেশের বামন রাজা

দৈত্যের দেশের বামন রাজা

খেলার চমক জুলাই ২০১২

মিজানুর রহমান মিজান...

সে  এক ক্রিকেট দৈত্যের দেশ। সেদেশে গাছে গাছে ক্রিকেটার ধরে, ঝাঁকি দিলে টুপটাপ দু’একটা ক্রিকেটার পড়ে। রূপকথা নয় বাস্তবেই আছে সে দেশ। গ্যারি সোবার্স, কোর্টনি ওয়ালশ বা মাইকেল হোল্ডিং যেমনি তাদের দেহাবয়ব তেমনি তাদের পারফরম্যান্স, সব মিলিয়ে যেন দৈত্যই এক একটা।
ওই দেশেরই এক বামন রাজাকে নিয়ে আমাদের আজকের গল্প। নাম তার শিবনারায়ন চন্দরপল। আকৃতিতে একেবারেই ছোটখাট তা নয়; কিন্তু দেশটা যে দৈত্যেরÑ সে দেশে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতা এমন কী আর আহামরি! ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, গর্ডন গ্রীনিজ বা ব্রায়ান লারার পর চন্দরপল নামটাও হয়ত খানিকটা ছন্দ পতনের মতই শোনায়। সব মিলিয়ে চন্দরপল যেন সেই দৈত্যের দেশের এক বামন রাজাই। এই বামন রাজাই বর্তমান ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিরেট বাস্তবতা, শেষ ভরসার জায়গা। ক্যারিয়ার যখন শুরু করেছিলেন তখন চারপাশের তারকার আলোয় তিনি ছিলেন ম্রিয়মান, আর আজ তিনিই উ’ইন্ডিজের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তারা, তার আলোয় বাকিরা ম্রিয়মান। সোনালি সময় পার করে আসা ক্যারিবিয়ানরা টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে কেবল বাংলাদেশ আর জিম্বাবুয়ের ওপরে।
প্রথম দুই বিশ্বকাপ জেতা একসময়ের অপ্রতিরোধ্য দলটি টিকে আছে যেন নিজেদের ছায়া হয়ে। ধুঁকতে থাকা সেই দলটির এই ব্যাটসম্যানই বর্তমান টেস্ট দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান। টেস্টের এক নম্বর ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতি তো তারই প্রমাণ। দশ হাজারি রানের বনেদী ক্লাবের নতুন সদস্য তিনি। লারার পর মাত্র দ্বিতীয় ক্যারিবিয়ান হিসেবে নাম লিখিয়েছেন অভিজাত এ ক্লাবে। লারার মত সহজাত প্রতিভাধর নন চন্দরপল যে বোলারদের নিয়ে যাচ্ছেতাই করবেন। বরং তার এ অর্জন কঠোর পরিশ্রমের ফসল। তার ইতিহাস যতটা না আগ্রাসনের তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিরোধের। লারা যেখানে দশ হাজার রানে পৌঁছেছেন সবচেয়ে দ্রুত ১৯৫ ইনিংসে, চন্দরপল সেখানে খেলেছেন ২৩৯ ইনিংস। তার চেয়ে পিছিয়ে আছেন কেবল স্টিভ ওয়াহ, ২৪৪ ইনিংস খেলে। স্ট্রাইক রেটেও কেবল রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থেকে দশ হাজারি ক্লাবের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে আছেন।
তবে আগ্রাসন যে তিনি জানেন না তা নয়। অন্তত টেস্টের চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড সেটাই বলছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৬৯ বলে শতক পূর্ণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের প্রয়োজনেই অমন খোলসবন্দী থাকতে হয় তাকে, নইলে তিনিও পারতেন বিলাসী ক্রিকেট খেলতে। দলের পর্বত প্রমাণ ভার একাকী কাঁধে নিতে গিয়ে তিনি হারিয়ে যাননি, বরং একে তিনি নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
সে চ্যালেঞ্জে তার সাফল্যও বলার মতই। তিনি মাত্র ছয় ব্যাটসম্যানের একজন যারা উইকেটে ১০০০ মিনিট করে পার করেছেন। আর এ কাজটি তিনি করেছেন মোট চারবার যেখানে অন্য কারও দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতাও নেই। টানা ১০০০ বল মোকাবিলা করা একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনিই। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১৪০ টেস্ট খেলা চন্দরপলের টানা সাত ইনিংসে রয়েছে অর্ধশত রান। তিনি ছাড়া এই কীর্তি রয়েছে মাত্র দু’জনের।
লারার বিদায়ে যে সীমাহীন চাপ তার উপর এসে পড়েছে তা তাকে আরও পরিণত করেছে। লারার সঙ্গে খেলা ৮৪টি টেস্টে তার গড় যেখানে ৪৩.৬৭, লারার বিদায়ের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১.৪০ তে। ২৫ সেঞ্চুরির ১৩টাই করেছেন লারা পরবর্তী যুগে। ব্যক্তিগত এত সাফল্যও না চাওয়া যে রেকর্ডটা ঠেকাতে পারেনি তা হল সবচেয়ে বেশি টেস্ট হারা খেলোয়াড়ের নামও এই চন্দরপলই।
উ’ইন্ডিজ দল আর চন্দরপল উভয়ের যে বিপরীতমুখী ফর্ম তাতে খুব সম্ভবত আরও একটি অনাকাক্সিক্ষত রেকর্ডের মালিক হতে যাচ্ছেন তিনি। হেরে যাওয়া টেস্টে চন্দরপলের মোট রান ৪৪৪৬ যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, আর প্রথমে আছেন স্বদেশী ব্রায়ান লারা ৫৩১৬ রান নিয়ে। ক্যারিয়ারে এখনও পর্যন্ত মোট ৬২ বার শতরানের জুটির ভাগীদার হয়েছেন যার ৯টি লারার সাথে। এ জুটিগুলোর মাঝে যেটার কথা বলতেই হবে সেটা ২০০২-০৩ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। রামনরেশ সারওয়ানের সাথে জুটিতে ৪১৮ রানের অসম্ভব টার্গেট তাড়া করে দলকে জয়ের বন্দরে ভিড়িয়েছিলেন যা টেস্টে আজও সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের বিশ্বরেকর্ড। ব্যক্তিগত এসব সাফল্যের স্বীকৃতি ছিল ২০০৮ সালের আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার হওয়া। একই বছরে উইজডেনও তাকে ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার মনোনীত করে। দলে তার এত অবদান বা ব্যক্তিগত এত সাফল্যের পরও ক্রিকেট বিশ্ব তাকে চেনে দারুণ বিনয়ী আর ভদ্র একজন মানুষ হিসেবে। তিনি এমন একজন যে কথাটা কম বলেন বরং তার কাজটা বেশি করেন। প্রচার প্রচারণা থেকে সবসময়ই নিজেকে দূরে রেখে নিজের কাজটা ঠিকমত করতেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। এ কারণেই হয়ত তার উপর প্রচারের আলোটাও কম। লারা যেখানে মহানায়ক, চন্দরপল সেখানে নেপথ্যেই থেকে যান বরাবর। অথচ অনেক ম্যাচেই লারার বড় রানের সৌধ গড়ে উঠেছে চন্দরপলের স্থিতধী ইনিংসে ভর করে। এই যেমন গ্যারী সোবার্সের ৩৬৫ রানের রেকর্ড ভাঙা ইনিংসটি যেদিন লারা খেলেছিলেন তখন ২৬৪ মিনিটের ধৈর্য নিয়ে ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাজিত ৭৫ রানে তার পাশে দাঁড়িয়ে এই চন্দরপল। ৩৭৫ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসের পাশে ৭৫ রানের ইনিংসটা হয়ত তেমন কিছু নয়, কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখবেন চন্দরপলের ২৬৪ মিনিট আর ৭৫ রানের ইনিংসটা না হলে লারার ওই মহাকাব্যটা লেখা হত কিনা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ