দূরের শত্রু

দূরের শত্রু

সাইন্স ফিকশন আহমেদ বায়েজীদ জুন ২০২৩

রাত নয়টার কিছু পরে ল্যাবরেটিতে ঢুকে গেলেন প্রফেসর আমজাদ। যাওয়ার আগে মিজানের ঘরের সামনে উঁকি দিয়ে দেখলেন লাইট বন্ধ হয়েছে কি না। রাতের খাওয়া শেষে মিজান শুয়ে পড়ে, আর প্রফেসর ঢোকেন ল্যাবরেটরিতে। এটাই দুজনের প্রতিদিনের রুটিন। ল্যাবরেটিতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন প্রফেসর। একবারও পেছনে তাকালেন না।

তাকালেও অবশ্য কোনো লাভ হতো না। মিজান যে নীরবে ঘরের বাইরে এসেছে সেটা দেখতে পেতেন না। কারণ মিজানের ঘর ও বারান্দার বাতি নেভানো। প্রফেসর ল্যাবরেটরির দিকে হাঁটতে শুরু করার পরই মিজান চুপচাপ অন্ধকার বারান্দায় চলে আসে। দৃষ্টি তার ল্যাবরেটরির দরজার দিকে। গত কয়েকদিন ধরেই মিজানের রুটিন বদলে গেছে। সেটা জানেন না প্রফেসর।

পুরো বাড়ি তখন অন্ধকার। শুধু ল্যাবরেটরিতে বাতি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে গাছপালা থাকার কারণে এতটাই অন্ধকার যে নিজেকেও দেখা যায় না। গ্রামের কিছুটা বাইরে বাড়িটা। গ্রাম থেকে বের হয়ে যে রাস্তাটা বাজারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার পাশে, তবে রাস্তা ঘেঁষে নয়। বড়ো রাস্তা থেকে একটা ছোটো রাস্তা চলে গেছে বাড়িটার দিকে। চারদিকে ঘন গাছপালা ঘেরা বাড়ি, তবে জঙ্গল নয়। বিলের মধ্যে বাড়ি করার পর চারদিকে গাছ লাগানো হয়েছে। সেই গাছপালা বড়ো হয়ে বাড়িটাকে জঙ্গলবাড়িতে পরিণত করেছে। রাতে বাতি বন্ধ করলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বেশ কয়েক বছর পরিত্যক্ত ছিল বাড়িটা। বাড়ির মালিক বিদেশে থাকেন। একটা সময় বছরে একবার এসে মাসখানেক থাকতেন; কিন্তু ৫-৬ বছর ধরে দেশে আসেন না। বছর দুই আগে বাড়িটায় থাকতে শুরু করেন স্থানীয় কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আমজাদ হোসেন। গ্রামের সবার কাছে তিনি ‘প্রফেসর আমজাদ’ নামেই পরিচিত। কেউবা ডাকেন ‘আমজাদ স্যার’ বলে।

দেশের নামকরা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এরপর আমেরিকা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কেন তিনি গ্রামের একটা অখ্যাত কলেজে শিক্ষকতা করছেন সেটা অনেকের কাছেই ধাঁধার মতো। বিয়ে-শাদি করেননি। মিজান নামে ১৮-২০ বছরের একটি ছেলে থাকে তার সাথে। ছেলেটাই বাজার আর রান্নার কাজ করে। ছেলেটাও তার মতো স্বজনহীন। একদিন শহর থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে নিয়ে এসেছেন। তিন কুলে কেউ নেই শুনে সঙ্গে রেখে দিয়েছেন।

গ্রামের মানুষদের সাথে খুব একটা মিশতে দেখা যায় না প্রফেসর আমজাদকে। মাঝে মধ্যে বিকেলে বাজারে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে ফিরে আসেন। কলেজ সময় ছাড়া বাকি দিনটা বাড়িতেই কাটান। রাত নয়টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঢুকে পড়েন ল্যাবরেটরিতে। বাড়ির একটা কক্ষে নিজেই গড়ে তুলেছেন ল্যাবরেটরি। ছাদের একটি কোনায় কিছু যন্ত্রপাতিও বসানো আছে। আরেকটা ঘরে বানিয়েছেন লাইব্রেরি। প্রচুর বইপত্র আছে সেখানে।

অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিজান কী করছে সেটা প্রফেসর জানেন না। তবে মিজান জানে, প্রফেসর এখন ডুবে যাবেন কাজের গভীরে। সারা রাত কাজ করবেন। জটিল একটা গবেষণা করছেন তিনি। অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছেন। আর কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মাঝে কাজটা শেষ হতে পারে।

গত কয়েক বছর ধরেই কাজটা করে চলছেন প্রফেসর আমজাদ। মহাকাশের কোনো একটা জায়গা থেকে সিগন্যাল ধরা পড়ছে তার তৈরি করা অ্যান্টেনায়। এটা কোনো যোগাযোগ নয়। কেউ তাকে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না; কিন্তু মহাকাশের কোথাও বড়ো ধরনের তৎপরতা টের পাচ্ছেন তিনি। মনে হচ্ছে, সেখানে বড়ো ধরনের কোনো কার্যক্রম চলছে।

কারা এটা করছে, তারা কী করছে, এসবের কিছুই জানেন না প্রফেসর। তবে সেখানে বিশাল কর্মতৎপরতার আভাস পাচ্ছেন। তার ধারণা, সৌরজগতের বাইরের একটা গ্রহ থেকে আসছে এসব সিগন্যাল। সেখানে কারো নড়াচড়া বা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের কারণে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে সেটাই ধরা পড়ছে তার তৈরি করা অ্যান্টেনায়।

সিগন্যালটা পড়তে পারলেই বোঝা যাবে কোথায় এত যোগাযোগ চলছে, কারা করছে এসব। যে কারণে প্রফেসর গত কয়েকদিন ধরে সারারাত কাজ করছেন। প্রতিনিয়ত নিজের যন্ত্রগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো আর প্রাপ্ত সিগন্যালগুলোর অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

মূলত এই কাজটার জন্যই প্রফেসর আমজাদ গ্রামে এসেছেন। বিদেশে পিএইচডি করে গ্রামের একটি বেসরকারি কলেজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হওয়ার কারণ এটাই। গ্রামের কলেজে ব্যস্ততা কম, আর নিরিবিলি পরিবেশে কাজের সুযোগ- দুটোই এক সাথে পেয়েছেন তিনি। বাড়িটাও পেয়েছেন নিজের মন মতো। সেখানে গড়ে তুলেছেন আধুনিক ল্যাবরেটরি। মাঝে মধ্যে কোনো কিছু দরকার হলে শহরে গিয়ে নিয়ে আসেন। বাকি সময়টুকু গবেষণার কাজেই ব্যয় করেন।

পিএইচডি করার সময় এই গবেষণাটা শুরু করেন এবং এটাকে পূর্ণতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে চলে আসেন এখানে। এরপর গত কয়েক বছর শুধু নিরলস পরিশ্রম। যার ফলে এখন সফলতার অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। জানেন, এই কাজে সফল হতে পারলে সারা পৃথিবী তাকে মাথায় তুলে নেবে। তবে যেটা জানেন না, তা হলো তাকে ব্যর্থ করে দিতে শত্রু লুকিয়ে আছে আশপাশেই।

সেদিন শেষ রাতের দিকে প্রফেসর ল্যাবরেটরি থেকে বের হলেন। সারা রাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। চোখে ঘুমঘুম ভাব। দরজা খুলে বের হতেই সামনে মিজানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন। অন্ধকারে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল মিজান। দরজা খোলার সাথে সাথে ল্যাবরেটরির আলো পড়ে তার মুখে।

প্রফেসর কিছু বলার আগেই ভারি কিছু দিয়ে মিজান আঘাত করে তার মাথায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েন প্রফেসর। টেনে দরজার একপাশে তাকে শুইয়ে দিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করে মিজান। ল্যাবে ঢুকে আধা ঘণ্টা কী সব কাজ করে সে। তারপর বেরিয়ে যায়- ল্যাব থেকে, বাড়ি থেকে এবং পৃথিবী থেকেই।

কয়েক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে প্রফেসর আমজাদের। কী হয়েছে সেটা বুঝতে মিনিটখানেক সময় লাগে। যখন সব কিছু মনে পড়লো- এক দৌড়ে ল্যাবরেটরির ভেতর ঢোকেন। যন্ত্রপাতি সব জায়গা মতোই আছে- তবে দেয়ালে লাগানো বড়ো মনিটরের দিকে চোখ পড়তে বুঝতে পারলেন গোলমাল হয়েছে। দ্রুত হাতে যন্ত্রগুলো পরীক্ষা করে বুঝলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে! সব ডাটা মুছে ফেলা হয়েছে সার্ভার থেকে। সিগন্যাল রিসিভারটাকেও অকজো করে দেওয়া হয়েছে।

মাথায় হাত দিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন প্রফেসর। মিজান কেন এই কাজ করলো সেটা যখন ভাবতে শুরু করলেন তখন পাশের একটা কম্পিউটার মনিটরের দিকে চোখ পড়লো। সেখানে কয়েকটা লাইন লেখা রয়েছে। ‘আমাদের বিষয়ে জানার অধিকার কাউকে দেব না আমরা। তোমার বাড়িতে সে জন্যই আমাদের একজনকে মিজান বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। চাইলে ও তোমাকে হত্যা করতে পারতো; কিন্তু আমাদের নিয়মে হত্যা বলতে কিছু নেই। গুডবাই।’

মেসেজটা কীভাবে এলো বোঝার জন্য কম্পিউটারের মাউসটার ওপর হাত রাখলেন প্রফেসর আমজাদ; কিন্তু মাউসটা নাড়াতেই লেখাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

বুঝতে পারলেন আর চেষ্টা করে লাভ নেই। মেসেজটাকে এভাবেই সেট করে রাখা হয়েছে তার জন্য। এটা তার কম্পিউটারের কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করে লেখা হয়নি। তাই মাউস নড়ে উঠতেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর তার দীর্ঘদিনের গবেষণার সব কিছুও শেষ হয়ে গেছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ