দুহাতে বিলাও রোদ্দুর

দুহাতে বিলাও রোদ্দুর

উপন্যাস ছন্দা দাশ মে ২০২৩

একলা দুপুর 

মাঘ মাসের শীত। যদিও বড়রা বলেন আগের মতো শীতই নেই। তুষারের দাদী বলেন এখন নাকি সব নকল। আগের মতো কিছু নেই। মানুষ, গাছপালা, আবহাওয়া, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সবকিছু। তুষার দাদীর কথা শুনে ভাবে আগে কেমন ছিল? এর থেকেও ভালো? সে কেমন? ইস্ সে কেন আগে আসলো না? দাদীর কাছে গিয়ে বলে দাদী আগে কেন সব ভালো ছিল? তবে এখন খারাপ করলো কে? দাদী হেসে ওকে কাছে টেনে তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর গল্প করেন। শুনতে শুনতে তুষার যেন কল্পনার চোখে দেখতে পায় ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম। সুন্দর, সুন্দর গাছপালা আর নানা রঙের ফুল, ফল।

গ্রামের একপাশে রূপালী নদী। নদীর বুকে ভেসে যাচ্ছে ডিঙি নৌকা। মাঝি গান গাইতে গাইতে দাঁড় বেয়ে যাত্রী পারাপার করছে। নদীর দুপাশ জুড়ে সোনালি ধানের মাঠ। চাষি মনের সুখে গরু নিয়ে চাষ করছে। পুকুরের পানিতে দুরন্ত ছেলের দল গোসলে মত্ত। দেখে মনে হয় জীবন ওদের আনন্দ দিয়ে ঘেরা। পড়ার চাপ নেই, ধনী হবার তীব্র প্রতিযোগিতা নেই, ধনী-গরিবের বৈষম্য নেই। সবাই যেন সবার আপন। বড়রা যেমন ছোটদের শাসন করে তেমনি আদরও করে। আবার ছোটরা বড়দের ভক্তি, শ্রদ্ধার সাথে সাথে কথা শোনে, তাদের উপদেশ মেনে চলে।

দাদীর গল্পের সাথে তুষার এসব বুঝতে পারে। গল্প করতে করতে দাদীর চোখে কেমন নিবিড় ছায়া নেমে আসে। একসময় দাদী ঘুমিয়ে পড়ে গল্প শেষ না করেই। তুষারের আর ঘুম আসে না। সে দাদীর পাশে শুয়ে শুয়ে কতো স্বপ্নের জাল বোনে।

তুষার থাকে ঢাকা শহরে। তার বয়স এখন দশ। ওরা দুুই ভাই। তুষার আর সাগর। সাগর এখনও ছোট। ওর বয়স ছয়। ওদের সাথে ওদের দাদীও থাকে। এতে তুষার খুব খুশি। ওর বন্ধুদের আর কারো দাদী ওদের সাথে থাকে না। থাকলেও তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকে। ঈদ অথবা কুরবানির সময় যখন ওরা দেশের বাড়িতে যায় তখন দাদীকে দেখে। গ্রাম থেকে ফিরে ওরা যখন গল্প করে তখন দাদীর কথা বলে। তুষার মনে মনে ভাবে ওর কতো ভাগ্য ওর দাদী ওর সাথে আছে। নইলে এত গল্প ওকে কে বলতো? ওরা তো জানেই না রূপকথার গল্প। সেই ব্যঙ্গমা বেঙ্গমী, ডালিম রাজকুমার, সুখ সারী, লালকমল নীলকমল আরও কতো কতো গল্প। বিভিন্ন ঋতুতে গ্রামের রূপের আলাদা আলাদা চিত্র। শীতের সময় শিশির ভেজা মাঠ, খেজুর রসের মৌ মৌ গন্ধ, পৌষ পার্বণের পিঠে খাওয়া আবার বর্ষা পানিতে ডোবা গ্রাম কিংবা গ্রীষ্মের ধূধূ করা প্রকৃতি। তুষারের খুব ইচ্ছে করে গ্রামে বাস করার। কিন্তু ওর মা বাবা কেউ গ্রামে যাবার নামও করে না। বাবা বলে গ্রামে এখন কোনো ভালো মানুষ নেই, ভালো প্রযুক্তি নেই, খাবার পানি নেই। তুষার তখন গ্রামে যারা থাকে যেমন আব্দুল চাচা যিনি তুষারদের জমি চাষ করে, জরিনা বুবু ওদের গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। ঈদে যখন বাড়ি যায় জরিনা বুবু রান্না করে কতো রকমের পুকুরের মাছ, পিঠে, নাশতা। গ্রাম থেকে গরুর দুধ, ঘি এসব পাঠায়। ওরা কী করে থাকে? ওদের কি কষ্ট হয় না? এই যে দাদী শহরে থাকে তব্ওু উনার মন পড়ে থাকে গ্রামে। তুষার জানে দাদীর এখানে ভালো লাগে না। কিন্তু দাদীর তো বয়স হয়েছে। হাঁটতে, চলতে ফিরতে কষ্ট। তাই বাবা জোর করে নিয়ে এসেছে। 

এখানে দাদী মন খারাপ করে থাকে। কথা বলার লোক নেই তাঁর সাথে। এমনিতেই বুড়োদের সাথে তেমন কেউ কথা বলতে চায় না। আর এখন তো মানুষ সারাদিন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। তুষারের বাবা মাও তাই। নিজেরাই নিজেদের মধ্যে তেমন গল্প, আলাপ কিছুই করে না। সময় পেলেই মোবাইলের স্ক্রিনে। ওর বন্ধুরাতো আরও দশ ধাপ এগিয়ে। সবাই মোবাইলে ভিডিও গেম খেলে সুযোগ পেলেই। কেউ কারো সাথে গল্প করে না, খেলে না। তুষার একা একা ছবি আঁকে, বই পড়ে। তাই তো তার সব কথা দাদীর সাথে। দাদীর সাথে কতো গল্প তার। মায়ের সাথেও তেমন গল্প হয় না। দু’চার মিনিট কথা বলেই বলে এখন বিরক্ত করো না। পড়তে বসো। তুষার যদি বলে এইতো মাত্র পড়া শেষ করলাম। মা তখন বলে ছোট ভাইয়ের সাথে খেল, নয়তো বলবে টেলিভিশন দেখ তাহলে। তুষার কী আর করবে। বাবার ঘরে গেলে দেখে বাবাও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। তুষারের মোবাইল নেই। মায়ের মোবাইলটা নিয়ে মাঝে মাঝে কার্টুন দেখে। কিন্তু মা দেখলে খুব বকাঝকা করে। তাই ও এখন শুধু টিভিতে কার্টুন দেখে। অথচ ছোট ভাইটাকে মায়ের পুরনো মোবাইলটা দিয়ে রেখেছে। ছোট ভাই মোবাইল না পেলে এমন কান্না জুড়ে দেয়। ঘরে টেকা দায় হয়ে ওঠে। মা ছোটবেলা থেকে ওকে মোবাইল দিয়ে এমন অভ্যাস করেছে মোবাইল না পেলে ও খেতেই চাইতো না। ঘুমাতেও চাইতো না। তুষারের মেঝ চাচ্চু কতবার বলেছে ভাবী ওকে মোবাইল দিও না। কাঁদুক। কতোক্ষণ খিদে নিয়ে থাকবে। আমরা একটা প্রজন্মকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছি। প্রযুক্তি আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনে। মা কিছুদিন মোবাইল না দিয়ে দেখেছে। ভাই কাঁদতে কাঁদতে এমন অবস্থা করে, শেষ পর্যন্ত মোবাইল ওকে দিতেই হলো। তাছাড়া মায়েরও অত ধৈর্য নেই ওর কান্না থামাবার।


মেজ চাচ্চুর গল্প

মেজ চাচ্চুকে তুষার খুব ভালোবাসে। চাচ্চুও তুষারকে আপন সন্তানের মতোই স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন দিয়ে আগলে রাখে। চাচ্চুর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। চাচ্চু আর চাচী দু’জনেই শিক্ষকতা করে। চাচ্চু থাকে মোহাম্মদপুরে।

কিন্তু রোজ এসে তুষারকে পড়িয়ে যায়, দাদীর সাথে গল্প করে, হাত পা টিপে দেয়। তুষারকে বলে দেখ মাকে কখনও কষ্ট দিবি না বাবা। যার মা নেই তার মতো হতভাগ্য আর কেউ হয় না। দাদী চাচ্চুকে যে কতো দোয়া করে। সত্যিই মায়ের মতো এমন ভালোবাসা বোধ হয় আর কেউ দিতে পারে না। 

চাচ্চুকে কখনও তুষার স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেখেনি। সেই কবেকার একটা ছোট কিপ্যাড মোবাইল আছে। তাই দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। 

ছোটদের হাতে মোবাইল দেখলেই চাচ্চু রেগে যায়। বলে মোবাইল এসে জাতির মেরুদণ্ডটাই নড়বড়ে করে দিলো।

মোবাইল মাদকের চাইতেও বিষাক্ত জিনিস। তুই কখনও মোবাইল আসক্ত হবিনে বাবা। এই যে ছাত্ররা আজ পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মোবাইল নিয়ে মগ্ন থাকে, এর ফল কি জানিস? লেখাপড়ায় তার আগ্রহ কমে যাবে, চোখের, ব্রেইনের ক্ষতি হবে, ঘুমের ক্ষতি হবে।

মাঝে মাঝে চাচ্চু তুষারের জন্য ভালো ভালো গল্পের বই দিয়ে বলে পড়বি এসব বই। তবে ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে না। বই হচ্ছে মানুষের প্রকৃত বন্ধু। একটা বই তোর জ্ঞানের দরজা খুলে দেবে। আমি বলছি না মোবাইল ব্যবহার না করতে। তবে তার ব্যবহার হবে শিক্ষামূলক। ঠিক দা বা ছুরির মতো। এদের ব্যবহার আমরা ঘরের কাজেও ব্যবহার করি আবার কেউ কেউ সেটা মানুষ খুনের কাজেও ব্যবহার করে। মূল ব্যক্তি তুই। তোকেই ঠিক করতে হবে কী কাজে তুই ব্যবহার করবি। 

চাচ্চুর সব কথা তুষার মন দিয়ে শোনে। সে ভাবে বড় হয়ে সে চাচ্চুর মতই হবে।

ছোট ভাইটাকেও সে অনেক ভাবেই বোঝায় মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে। কিন্তু সে কোনভাবেই তুষারের কথা কানে নেয় না। মোবাইলের কারণে সে কোনো গল্পের বইও পড়ে না। বইয়ের প্রতি তার কোনো আকর্ষণও নেই। তুষারের মন খুব খারাপ হয়। চাচ্চুর সাথে সে এ নিয়ে একদিন কথা বলেছিল। চাচ্চু অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবছিল। তারপর বললো আমি যে এ নিয়ে ভাবি না তা নয়। কিন্তু এ বিষয়ে আমার চাইতে তোর বাবা-মাই পারেন ওকে ফেরাতে। 

শোন বাবা আমি যদি নিজে মোবাইল চালাতে চালাতে তোকে বলি মোবাইল না চালাতে, তবে কখনও তুই মানবি না। মানুষ নিজেকে উপযুক্ত করে তবে অন্যকে উপদেশ দিতে হবে। সে যতই ছোট হোক না কেন বড়দের চালচলন, আচার আচারণই ছোটরা অনুসরণ করে। মুখের কথায় ততটা না। আর এ রকম শিক্ষা নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন করে। কিন্তু তাই বলে তো আমরা হাত গুটিয়ে চুপচাপ থাকলে হবে না। আমাদের চেষ্টা করতেই হবে ওকে ফেরাবার। তুষার তারপর থেকে ভেবে চলছে মাকে, বাবাকে সে কী বলবে। মা নিশ্চয় খুব রাগ করবে।

বলবে তুমি খুব পেকে গেছো। 

তুষার কিছুতেই চাচ্চুর কথা বলবে না মাকে। 

পরদিন শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। তুষার তার পড়াশোনা শেষ করে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে মা কাপড় গুছিয়ে রাখছে আবার মোবাইলও খুলে রেখেছে। সাগর খাটের ওপর পা দুলিয়ে মোবাইল ছেড়ে তন্ময় হয়ে আছে। 

তুষার ওর কাছে এসে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে বলে, এসব তোর ভালো লাগে?

সাগর ওর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দেয় তাহলে আর কী করবো?

তুষার বলে কেন খেলবি আয়?

কী খেলবো? ওর প্রশ্নে তুষার বলে কেন? কতো খেলাই তো আছে। খেলবি ব্যাডমিন্টন?

কিন্তু আমি তো তোর সাথে পারি না।

তুই খেলে দেখ আগে। না খেলেই বলে দিলি পারবো না।

আয় বলেই ওর হাত ধরে টানে। সাগর নিমরাজি হয়ে মোবাইল রেখে ছাদে তুষারের সাতে উঠে দেখে ওখানে পাশের ফ্ল্যাটের দুই ছেলে ইমতিয়াজ আর অরণ্যও আছে। 

তুষারদের দেখে বলে আজ খেলায় খুব মজা হবে। এরপর খেলতে খেলতে সাগর এতই খুশি ওর আর মোবাইলের কথা মনেই পড়লো না। দুপুর হলে সাগরকে অনেকটা জোর করে নিচে ঘরে আনতে হয়েছে তুষারের। এই কথা চাচ্চুকে বলতেই চাচ্চু ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, খুব বড় কাজ করেছিস রে বাপ। এভাবেই আমাদের কিশোর, তরুণদের ফেরাতে হবে। আবার তাদের পাঠে মন আনতে হবে। ওদের এখনও কাদামাটি মন। একবার ছাপ ফেলতে পারলেই হলো। তারপর আর চিন্তা নেই। চিন্তা শুধু বড়োদের নিয়ে। বড়রা যেন তাদের কর্তব্য, আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয় এদিকে তাদের সচেতন থাকতে হবে।

কিন্তু আজকাল বড়রা শুধু ছোটদের অবক্ষয়ের কথাই বলছে। কিন্তু আত্মসমালোচনা যে খুব দরকার এটা তাদের জানা নেই। 

এরপর থেকে তুষার ছুটির দিনগুলোতে সাগরকে নিয়ে খেলতে যায় ছাদে, কখনও পার্কে বা পার্কিং-এ। আর ও নিজেই অবাক হয়ে দেখে সাগর আর আগের মতো করে না। খুশি হয়েই খেলতে চলে আসে। তুষার মনে মনে তার পরবর্তী অভিযান বইয়ের নেশা শুরু করবার কথা ভাবে।


প্রজন্মের দিনকাল

তুষার স্কুলে এসেই শুনলো আজ ক্লাস হবে না। কিন্তু কেন? তুষার ভাবে আজ তো স্মরণীয় কোনো কিছুই মনে করতে পারছে না। তাহলে কী হলো? কিন্তু কেউ সঠিক কিছু বলতে পারছে না। এ ওকে, ও তাকে প্রশ্ন করছে। হঠাৎ কে যেন বললো ক্লাস সিক্সের একজন ছাত্র গতকাল বাসা থেকে উধাও হয়ে গেছে। তার জন্য স্কুল ছুটি ঘোষণা করেছে। শুনেই তুষারের রক্ত হিম হয়ে গেছে। তারই ক্লাসের ছাত্র। কিন্তু কে? নাম কী? 

উৎকণ্ঠিত হয়ে সে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতেই ক্লাসমেট সুবীরকে দেখে বললো, আমাদের ক্লাসের কে উধাও হয়ে গেছে রে? নাম জানিস? সুবীর ছলোছলো চোখে বললো, মিনার! নাম শুনে তুষারের চোখ ফেটে কান্না এলো। 

এতো ভালো ছিল, দেখতেও সুন্দর। কখনও মনে হয়নি তো তার মনে এতো দুঃখ ছিল। অবশ্য কথা বলতো কম। লেখাপড়ায়ও বেশ। তুষার আরও কাছে এসে বললো, কেমন করে যে কী হলো! বাড়ির কেউ টের পায়নি? 

না রে। 

তুষার আর ভাবতেই পারছে না। ইতোমধ্যে ছাত্ররা এলোমেলোভাবে ভিড় করছে দেখে বাংলা স্যার এসে সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমরা হলঘরে গিয়ে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বসো। তোমাদের হেড স্যার আসছেন। উনি তোমাদের কিছু বলবেন। সবাই স্যারের কথামতো হলঘরে চুপচাপ বসলেও একটা চাপা অস্থিরতা যেন। কিছুক্ষণ পর হেড স্যার আর সকল শিক্ষকেরা এসে দাঁড়ালেন। সবার মুখে বিষণœতার ছাপ।

স্যার বললেন, তোমরা সবাই ইতোমধ্যে শুনেছো আমাদের স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মিনার গতকাল বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। এ যে আমাদের জন্য কতটা নিদারুণ কষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খবরটা আমাদের জন্য যেমন কষ্টের আবার লজ্জারও।

তবে কি আমরা তাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি? নইলে ভিরু, কাপুরুষের মতো কেন এইপথ বেছে নিয়েছে? আমরা তো এমন শিক্ষা দিইনি যাতে আমাদের ছাত্র সমস্যার মুখোমুখি হতে ভয় পাবে। সমস্যার মোকাবিলা করার সৎ সাহস কেন তার থাকবে না? 

কিন্তু খুব দুঃখের সাথে আমার বলতে হচ্ছে যে কারণে সে নিজেকে নিজেই শেষ করে দিলো তা সামান্য।

মিনার মায়ের কাছে বায়না করেছিলে একটি স্মার্টফোনের। মা রাজি হয়নি বলেই সে হুমকি দিয়েছিল পালিয়ে যাবার। মা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সত্যি সত্যিই সে তা করবে। 

তোমরা সবাই আমাদের সন্তান। আমরা চাইবো না তোমরা তোমাদের অমূল্য জীবন সামান্য কারণে নষ্ট করে ফেলবে। আমরা তোমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা তোমাদের ভালোটাই চাইবো। যেমন মিনারের অভিভাবক তার মা চায়নি মিনারের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে। তাই তাকে এতো অল্প বয়সে মোবাইল দিতে রাজি হয়নি। মনে রেখ পিতা-মাতা কখনও তাঁর সন্তানের অকল্যাণ চান না। এই বিশ্বাস তোমাদের রাখতে হবে। তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ, কর্ণধার। তোমরাই যদি খারাপ পথ বেছে নাও তবে দেশ বাঁচবে কী করে। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ। তুষার তন্ময় হয়ে শুনছে। চাচ্চুর কথার সাথে স্যারের আজকের বক্তব্যে একই সুর ওর মধ্যে গভীর বোধের জন্ম নিচ্ছে। স্যার আরও বলেছেন, তোমরা এই মুহূর্ত থেকে শপথ নাও এমন কোনো কাজ তোমরা করবে না। স্যার আরও অনেক কিছু বলে স্কুল ছুটি ঘোষণা দেন। 

তুষার খুব মন খারাপ করে বাড়ি এসে মা বাবাকে এই ঘটনার কথা বলতেই ওদের মুখে চিন্তার গভীর রেখা। বাবা বললেন, সত্যিই আজকাল ছেলেপেলে মানুষ করা বড় কঠিন। আমরা কখনও বায়নাও করিনি কোনো কিছুর জন্য। মাও বাবাকে সমর্থন করলো। সাগর চুপ করে শুনছে। সে ভাবছে সত্যিই কি এটা শুধু প্রজন্মের দোষ!


প্রবীণ দিবস

কাল সারা রাত তুষারের ঘুম হয়নি। পড়ায়ও তার মনঃসংযোগ রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। বারবার তার মিনারের মুখটাই মনে পড়ছিল। একসাথে পড়ে তবুও কেন জানলো না তার মনের কষ্ট। আসলে ক্লাসে তো কথা বলা যায় না। শুধু টিফিনের সময়ে সবাই যার যার কাছের বন্ধুদের সাথে গল্প করে। কিন্তু এখনতো প্রায় সবাই মোবাইল নিয়ে বসে কী দেখে তুষার জানে না। ওর নিজের তো মোবাইল নেই আর স্কুলে মোবাইল নিয়ে এই ধরনের আড্ডা দেওয়া তার পছন্দ নয়। মিনারের হাতে তুষার মোবাইল দেখেছে। তাহলে আবার কেন চাইলো ওর মায়ের কাছে? মনে হয় নুতন মডেলের মোবাইল সেট চেয়েছিল। প্রায় এমন কথা শুনেছে সে। বাবা কী তাহলে সত্যি বলে, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নীতিচ্যুত!

সে ভাবে একজন মানুষ তো জন্ম নেয় নিষ্কলুষ চরিত্র নিয়ে। সে যা শিক্ষা পায় প্রথমে পরিবার থেকে, তারপর স্কুল আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। তখন যদি তাকে ভালো শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে কেন সে বিপথগামী হবে? 

তুষার কাছে গিয়ে বলে, ও দাদী তুমি না খেয়ে বসে আছো কেন? দাদীর মুখে কোনো কথা নেই। ফ্যাল ফ্যাল করে বাইরে তাকিয়ে আছে। 

তুষার ঝাঁকি দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে, দাদী কী হয়েছে বলো? 

এবার দাদী ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ও দাদু ভাই আমাকে একবার দেশে নিয়ে যাবি? মনটা খুব উতলা হয়েছে রে। কতদিন দেখি না আমার ভিটে বাড়ি। তোর দাদার কবরে একবার যাবো। বয়স হয়েছে রে। কখন মারা যাই না যাই।

তুষার বলে, তুমি সকালবেলা কেমন কথা বলছো দাদী। 

আজ তো চাচ্চু আসবে। তখন চাচ্চুকে বলবো তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। এই সামান্য কথাতেই দাদীর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। তার মতো নয়/দশ বছরের একটা বাচ্চার কথার দাম কতই বা। সে নিতে পারবে কি পারবে না দাদীর সে চিন্তাও নেই। পরম বিশ্বাসে দাদী বললো, ও ভাই আয় আমার সাথে একটু খাবি।

তুষার দাদীর প্লেটের রুটি ছিঁড়ে সবজি দিয়ে খেতে গিয়ে দেখে চাচ্চু ঘরে ঢুকছে। মনে মনে সে খুব খুশি হয়। কালকের স্কুলের ঘটনাটা চাচ্চুর সাথে আলোচনা করতে পারবে।

চাচ্চু ওখান থেকেই বলে, এই না হলে আমার ভাতিজা! কাছে এসে বলে, আম্মার নিশ্চয় মন খারাপ আজ। তাই তো চলে এলাম। চলো আম্মা তোমাকে আজ চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবো। তুষার, সাগর তোরাও চল। সবাই একসাথে আজ অন্যরকম দিন কাটাবো। তুষার বললো, দাদী যে দেশের বাড়িতে যেতে চাইলো। চাচ্চু বললো, নিশ্চয় যাবো। সেটা সামনের মাসে। তখন আব্বার মৃত্যু দিবস। দাদী শুনে বলে, নিয়ে যাবি তো বাজান? চাচ্চু বলে, তোমার ছেলে কি তোমাকে মিথ্যে বলতে পারে আম্মা? এই মুহূর্তগুলো তুষারের বড় ভালো লাগে। তুষারের বাবা বড় ছেলে। কিন্তু দাদীর সাথে এমন করে কথা বলে না। অথচ বাবাও দাদীকে খুব ভালোবাসে।

আসলে এক একজনের প্রকাশের ভাষা এক এক রকম। কেউ কেউ হয়তো পারেই না।

তুষার সাগরকে তৈরি হবার কথা বলতে এসে দেখে সে আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। তুষার বকলো না, কাছে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো ভাই চিড়িয়াখানায় যাবি? সাগর চুপ করে রইলো। তুষার আবার বললো চল ভাই। দাদীও যাবে, চাচ্চু যাবে।

চিড়িয়াখানায় কী আছে? বাঘ, ভালুক, পাখি সব দেখতে পাবি। কতো মজা হবে?

দূর ওসব তো মোবাইলেও দেখা যায়। 

তুষার বললো, মোবাইলে দেখা আর সত্যিকার দেখা কি এক হলো? এভাবে ঘরে বসে থাকলে একদিন তো তোর হাঁটাচলাই বন্ধ হয়ে যাবে। সাগর যেন ভয় পেল। সে মোবাইল বন্ধ করে তখনই তৈরি হতে আরম্ভ করে দিলো।

দাদীকে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় চাচ্চু তুষারের মাকে বললো, ভাবী আমরা তাহলে আসি। বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবো। তুমিও যেতে পারতে আমাদের সাথে। 

মা হেসে বলে, এখন আর এসব ভালো লাগে না। চাচ্চু বলে, মোবাইলই তোমাদের জগৎ এখন। মায়ের মুখটা একটু কেমন যেন হয়ে গেল।[চলবে]

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ