দুরন্ত ছেলে

দুরন্ত ছেলে

তোমাদের গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১২

এ এইচ এম মারুফী..

সারা গাঁয়ে দাপিয়ে বেড়ায় লিয়াকত। ওর চেহারাটাও সবার মন কাড়ে। শ্যামলা রঙ, দোহারা গড়ন, বেশ লম্বা। সুঠাম শরীর। আর এই মজবুত শরীরের পরিচয় সে দেয় যখন তখন। কারো ডাবের পানি খেতে ইচ্ছে হয়েছে? সবার আগে তড় তড় করে নারকেল গাছের মাথায় উঠে যাবে লিয়াকত। চোখের পলকে পেড়ে আনবে কচিডাব। একটা দু’টা তিনটা যে ক’টা চাই। কিংবা ঝড় বাদলের দিনে চার মাইল দূরে ভূতের বিলে যেতে হবে? গ্রামের আর কাউকে রাজি করানো যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু লিয়াকত এক কথায় রাজি। ডিঙি নৌকা বেয়ে অনেক দূরের টেকেরহাটের বাঁক থেকে পদ্মফুলও তুলে আনতে পারে সে। সবাই বলে দুরন্ত ছেলে। লিয়াকতকে কেউ কখনো মন খারাপ করতে দেখেনি। সব সময়ই সে হাসি খুশি। তার কচিমুখের হাসি দেখলে সবারই মন ভালো হয়ে যায়। দরাজ গলায় সে গান গেয়ে থাকে। গভীর রাতে অনেক দূর থেকে গান শুনে বোঝা যায় লিয়াকত। হাডুডু খেলায় লিয়াকতের ভারি নাম। গ্রামের দলের কোনো হাডুডু খেলা খেলায় লিয়াকতের ভারি নাম।
শুধু কি নিজেদের গ্রামে?
অনেক দূরের গ্রাম থেকেও লিয়াকতকে সেধে নিয়ে যায় হাডুডু খেলতে। খেলতে গিয়ে শুধু যে গায়ের জোর খাটায় লিয়াকত তা নয়, তার কায়দা কৌশলই আলাদা। আর এই কৌশলের জোরেই সে দলকে জিতিয়ে দেয়। তবে লিয়াকতের দোষও আছে। পড়াশোনার কথা শুনলেই তার গায়ে জ্বর আসে।
তার সঙ্গীরা যখন স্কুলে যায়, লিয়াকত তখন হাওর বিলে ডিঙি বায়। আর গান গায়।
বেশ কয়দিন হলো লিয়াকতকে দেখা যায় না। এমনকি সে খেলার জন্য মাঠেও যায় না। সবাই ভাবনায় পড়ে। একদিন পরেই পাশের গ্রামের সাথে হাডুডু খেলা হবে। আর এ সময় লিয়াকতের কি না দেখা নেই!
সে দিন খেলাশেষে ছেলেরা দল বেঁধে লিয়াকতের বাড়ি যায়। কিন্তু লিয়াকতকে দেখে সবাই অবাক হয়। এ কী চেহারা হয়েছে লিয়াকতের! অমন সুন্দর সুঠাম শরীরটা একবারে ভেঙে পড়েছে। এগিয়ে আসেন লিয়াকতের মা। ছেলেদের বলেন, তোমরা বস বাবারা, লিয়াকত একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে।
সবাই এক সাথে জানতে চায় কী হয়েছে লিয়াকতের?
লিয়াকতের মা বলেন, ডায়রিয়া। ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন। এখন একটু ভালো। এবারে সবাই লিয়াকতকে ঘিরে ধরে। হারুন বলে, কিরে ডায়রিয়া হয়ে এত কমজোর হয়ে গেলি?
খাওয়ার স্যালাইন খেতে পারিসনি? পরশু দিন চরবিনোদপুরের সাথে আমাদের হাডুডু খেলা না? এখন কী হবে? তুই খেলতি পারবি না। হাডুডু খেলায় আমাদের গ্রামের এত দিনের নাম ধুলায় মিশে যাবে।
চিরদিনের হাসিখুশি লিয়াকত কাঁদকাঁদ গলায় বলে, আমি কী করব? আমার কী দোষ? আনোয়ার বলে, দোষের কথা বলছি না। কিন্তু খাওয়ার স্যালাইন খেলি না কেন? তাহলে এত দুর্বল হয়ে পড়তি না।
লিয়াকত বুঝতে পারে না ওরা কিসের কথা বলছে।
তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রতন বলেই ফেলে, কী করে খাবে? লিয়াকত ভাই কি স্কুলে যায়, না লেখাপড়া করে? লিয়াকত ভাই মনে হয় খাওয়ার স্যালাইনের নামই শোনেনি। নইলে আমারও তো গত সপ্তাহে ডায়রিয়া হয়েছিল। আমি খাবার স্যালাইন খেয়েছি।
স্কুলের আপা আমাদের শিখিয়েছেন, ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খেলে মানুষ একটুও দুর্বল হয় না। স্বাস্থ্য বইতেও এ কথা লেখা আছে।
লিয়াকত চুপ করে থাকে। এমনিতেই তার শরীরে জোর নেই। হাডুডু খেলতে পারবে না বলে মনটাও খুব খারাপ হয়ে আছে। তার ওপর এতটুকু ছেলে এভাবে কথা বলে।
দুঃখ আপমানে চোখে পানি চলে আসে লিয়াকতের। সে কোনো রকমে বলে, ঠিকই তো, আমি কি তোমাদের মতো স্কুলে যাই, না পড়তে পারি? আমি কিভাবে স্যালাইনের কথা জানব?
ছেলেরা সবাই মন খারাপ করে চলে যায়। তাদের চাইতে বেশি মন খারাপ হয় চিরদিনের হাসিখুশি লিয়াকতের। এতটুকু ছেলে রতন পর্যন্ত যে কথা জানে, সে কি না তাও জানে না। স্কুলে না যাওয়ার জন্যই সে এতবড় বোকা হলো। লেখাপড়া শিখলে আজ তো এ রকম হতো না। লিয়াকত মনে মনে ঠিক করে, সে আর ভুল করবে না। এবারে ভালো হয়ে উঠেই সে স্কুলে ভর্তি হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ