দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের আরেক কান্ডারি

দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের আরেক কান্ডারি

স্মরণ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৮৪০ সালে। গ্রামের ভেতরে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকের বাতাস বইতে থাকে পুরো বাংলাজুড়ে। বাংলার বাইরেও তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে যায়। বুকের ভেতরে শূন্যতার কান্না পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর। তবে ইংরেজরা ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়। তাদের পথের কাঁটা সরে গেল। ইংরেজ হটাও আন্দোলনের অপমৃত্যু হলো।

মানুষ মরে যায় কিন্তু আদর্শ মরে না। অনুসারীদের মধ্য থেকেই তৈরি হয় আরেক কান্ডারি। হাল ধরে সংগঠনের। এগিয়ে নিয়ে যায় আন্দোলন। শরীতুল্লাহর ক্ষেত্রে তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না। হাজী শরীতুল্লাহর শূন্যস্থানে এগিয়ে এলেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র মহসিনউদ্দীন আহমেদ ওরফে দুদু মিয়া। ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন তিনি। মুসলিম জনমনে প্রশান্তির ছোঁয়া লাগলো। নতুন আশায় বুক বাঁধলেন সবাই। বাদ সাধলো ইংরেজ বেনিয়া এবং তাদের সহযোগী বন্ধুরা।

দুদু মিয়া ছিলেন বয়সে তরুণ। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচি সাজানোর চিন্তা করলেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তখন ইংরেজদের দাপট। অত্যন্ত শক্তিশালী তাদের অবস্থান। তবুও ভয় পেলেন না দুদু মিয়া। নিরীহ সহজ-সরল জনগণের ওপর জমিদারদের অত্যাচার তখন অসহনীয়। নীলকরদের দৌরাত্ম্যে মুসলমান কৃষকরা অতিষ্ঠ। অসহ্য নিপীড়ন চোখ বুজে সহ্য করতে রাজি ছিলেন না দুদু মিয়া। তিনি দৃঢ়তার সাথে এদের প্রতিরোধ করার স্বপ্ন দেখলেন। সেই মোতাবেক পরিকল্পনাও গ্রহণ করলেন।

আন্দোলনের সুবিধার জন্য দুদু মিয়া পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করলেন। প্রত্যেক এলাকায় একজন করে খলিফা মনোনীত করলেন। খলিফাগণ তাঁর কথা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। আন্দোলনের খরচ জোগানোর জন্য সাধারণ মানুষের কাছে থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তাদের এলাকার খবরা-খবর কেন্দ্রকে জানাতেন। মুজাহিদদের বিপদের সময় কেন্দ্রীয় সংগঠন টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতো।

দুদু মিয়া বলেন, সব মানুষই সমান। তাই সব মানুষের সমান সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। একচ্ছত্র অধিকার খাটাবার ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা কাউকে দেননি। সুতরাং কারো ওপর কারো কর ধার্য করারও অধিকার নেই। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে শুধুমাত্র সরকারি খাজনা দিতে বলেন। এছাড়া সকল প্রকার অবৈধ কর দিতে নিষেধ করেন। তিনি জমিদার, নীলকর ও অন্যান্য জুলুমকারীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।

অল্প সময়ের মধ্যে দুদু মিয়ার কথা সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়লো। ফলে জমিদারশ্রেণিও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ভণ্ডপীর, স্বার্থবাদী মৌলবী ও সুফি নামধারী কতিপয় লোক ছাড়া সকল স্তরের মুজাহিদগণ তাঁর আন্দোলনে যোগদান করতে লাগলেন।

দুদু মিয়ার স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদ বাহিনী বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ বাহিনীর সাহায্যে তিনি ১৮৪০ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দাঙ্গা ও যুদ্ধ মোকাবেলা করেন। প্রতিপক্ষকে শক্তি দিয়ে দমন করেন। ইংরেজ ও জমিদারমুক্ত এলাকাও নির্ধারণ করেন। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চাষিদের ওপর জমিদার শ্রেণির নিপীড়ন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামগঞ্জে শান্তি বিরাজ করতে থাকে।

দুদু মিয়ার আন্দোলনে জমিদার শ্রেণি বেসামাল হয়ে পড়ে। তাকে দমানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে। ১৮৩৮ সালে পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর জীবদ্দশাতেই দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে বাড়ি-ঘর লুট করার উসকানির অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়। তৎকালীন হাইকোর্টে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৮৪১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এবারও তিনি বেকসুর খালাস পান। এভাবে যতবারই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে গ্রেফতার করানো হয় ততবারই তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে ময়দানে ফিরে আসেন। মিথ্যা মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনিও জমিদার এবং কুঠিয়ালদের শায়েস্তা করার জন্য পদক্ষেপ নেন। ফলে তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণকামী বন্ধু হিসেবে সমাদৃত হন। 

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব নামে পরিচিত সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। তার উত্তাল তরঙ্গ গোটা উপমহাদেশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী দুদু মিয়ার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। তারা এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে উঠে যে, দুদু মিয়া যদি তাঁর অসংখ্য অনুসারীসহ এ বিপ্লবের স্বপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠবে। তাই এ সময় তাঁকে কলকাতায় নজরবন্দী রাখা হয়। এ সময় দুদু মিয়া আশি হাজার শিষ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা তৎকালীন ভূস্বামীদেরকে বহিষ্কৃত করে তার স্থলে মুসলিম শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। জমিদার শ্রেণি যতই মুজাহিদদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, ততই তারা সক্রিয় হয়ে একতাবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তারা এ আন্দোলনকে বিভিন্ন দিক থেকে জোরদার করে তুলেছে। 

দুদু মিয়ার এ সংস্কার আন্দোলনের পিছনে ভূমিহীন দরিদ্র মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। তিনি স্বীয় সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের সবাইকে সমান ভাবতেন। তিনি প্রচার করতেন যে, তাঁর কাছে নিম্নবিত্তদের আয়-উন্নতি এবং উচ্চবিত্তদের আয়-উন্নতি সমান। তিনি প্রতিবেশীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব কামনা করতেন। কেউ দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে অন্যজনকে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন। 

বাংলার ভূস্বামীদের অধিকাংশই হিন্দু ছিল। নীলকর ও তাদের অধীনস্থরাও ছিল হিন্দু ও খ্রিষ্টান। তারা মুসলমানদের জীবন ও জীবিকার ওপর হস্তক্ষেপ করে। চাষবাসের ওপর মাতাব্বরি করে। জোর করে নীলচাষ করায়। অতিরিক্ত খাজনা আদায় করে। দুদু মিয়ার অনুসারীরাও সচ্ছল হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। 

জমিদাররাও দুদু মিয়ার আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী দল গঠন করে। তারা নিরীহ মুসলমানদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। দাড়ি রাখলে আট আনা থেকে আড়াই টাকা পর্যন্ত খাজনা ধার্য করে। এ খাজনা না দিতে পারলে কঠিন অত্যাচার করা হতো। দুইজন মুজাহিদের দাড়ি একসাথে বেঁধে দিয়ে উভয়ের নাকে মরিচের গুঁড়া দিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। মুজাহিদদেরকে উলঙ্গ করে সারা গায়ে লাল পিঁপড়া ছেড়ে দিতো। হাত পা বেঁধে চিৎ করে তপ্ত রোদে ফেলে রাখা হতো। জামার ভেতরে পিঁপড়া ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। কখনো কখনো বিশেষভাবে তৈরি আবর্জনা ভর্তি কুয়ার মধ্যে বুক পর্যন্ত পুঁতে রাখা হতো। 

জালালউদ্দীন মোল্লা ছিলেন প্রভাবশালী লাঠিয়াল। তিনি হাজী শরীয়তুল্লাহর হাতে সরাসরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদ। দুদু মিয়া তাঁর সহায়তায় একদল লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন। 

১৮৪১ সালে দুদু মিয়া প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর সহকারী জালালউদ্দীনসহ কয়েকশ লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে কানাইপুরে জমিদারের প্রসাদ আক্রমণ করেন। জমিদার শিকদারকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হলো যে, যদি তারা আপস মীমাংসায় না আসে এবং মুজাহিদদের ওপর অত্যাচার বন্ধ না করে তবে তার প্রাসাদের প্রত্যেকটি ইট পর্যন্ত খুলে নেওয়া হবে। কানাইপুরের জমিদার শিকদার বাধ্য হয়ে দুদু মিয়ার সাথে আপস মীমাংসা করেন। 

ফরিদপুরের জমিদার জয় নারায়ণ ঘোষ ক্ষমতা দেখালেন। তিনি আপস-মীমাংসা করলেন না। ১৮৪২ সালে বাধ্য হয়ে দুদু মিয়ার বাহিনী জয় নারায়ণ ঘোষের বাড়ি আক্রমণ করে। জমিদার পরাজিত হয়। তারা জমিদার বাড়ি দখল করেন। সমস্ত জিনিসপত্র স্থানীয় জনগণ নিয়ে চলে যায়। সেইসাথে জমিদারের ভাই মদন ঘোষ নিহত হয়।

দুদু মিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা আস্তে আস্তে বেড়েই চলে। কুঠির ম্যানেজার নীলকর ডানলপ ও কালিপ্রাসাদ দুদু মিয়ার নামে বেশ কয়েকটি মামলা দেয়। বারবার দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে প্রতিবারই দুদু মিয়া মুক্তি পান।

১৮৪৬ সালের কথা। জমিদারদের অত্যাচার আরো বেড়ে গেল। দুদু মিয়া এবং তাঁর অনুসারীগণ আর শান্ত থাকলেন না। জমিদারদের অত্যাচারে ক্ষেপে গেলেন। ঐ বছর ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে দুদু মিয়া প্রায় পাঁচশ লোকের একটা বিরাট বাহিনী নিয়ে নীলকুঠি আক্রমণ করলেন। এ আক্রমণে মুজাহিদ বাহিনী জিতে গেল। পরাজিত হলো জমিদার বাহিনী। তারা প্রতিশোধ নেওয়ার কৌশল খুঁজতে থাকে। কয়েকদিন পরেই ডানলপের আটশ লোকের সশস্ত্র বাহিনী দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়ি আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণে তারা চারজন প্রহরীকে হত্যা করে। প্রায় দেড় লাখ নগদ টাকাসহ অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। ডানলপ পাল্টা মামলাও করে। তার দায়েরকৃত মামলায় ১৮৫৯ সালে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে। বিচার নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। বিনা বিচারে আটক রাখে অনেকদিন। নিম্ন আদালত তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করে। আপিল করেন দুদু মিয়া। কলকাতার নিজামত আদালত তাঁর দলবলসহ সবাইকে বেকসুর খালাস দেন।

দুদু মিয়ার আন্দোলন এখন বিজয়ী বেশে। বারবার গ্রেফতার হন। আবার মুক্তি পান। তাঁরও বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে দুদু মিয়া আর ফরিদপুরে থাকেননি। ঢাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। অনবরত সংগ্রাম ও কারাবাসের ফলে দুদু মিয়ার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিনি ১৮৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তাঁর নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা ১৩৭ নং বংশাল রোডে এখনও তাঁর কবর মুক্তি আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করছে। 

দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তারপর দ্বিতীয় পুত্র নয়া মিয়া আন্দোলনের হাল ধরেন। তাঁর মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় পুত্র আলাউদ্দীন আহমেদ এ আন্দোলন পরিচালনা করেন। 

দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর থেকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়। ফলে ফরায়েজি আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। আলাউদ্দীন আহমেদ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সমর্থনে নওয়াব সলিমুল্লাহর সাথে সহযোগিতা করেন। আলাউদ্দীন আহমেদ এর মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র বাদশা মিয়া এ আন্দোলন পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে তিনি খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। এ সময় সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। ফরায়েজি আন্দোলন ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ে। 

পরিশেষে বলা যায়, পিতা শরীতুল্লাহর মতো পণ্ডিত ছিলেন না দুদু মিয়া। তাই ইংরেজরা ভাবলো দুদু মিয়াকে সহজে পরাস্ত করা যাবে। কিন্তু তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা ছিল অতুলনীয়। নেতৃত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তাই তাঁকে ফরায়েজি আন্দোলনের যৌথ প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়ে থাকে। মূলত, মুসলমানদের মধ্যে শিরকমুক্ত নবজাগরণ সৃষ্টিতে ফরায়েজি আন্দোলনের ভূমিকা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ