তালপাকা ভাদ্র

তালপাকা ভাদ্র

প্রচ্ছদ রচনা মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম আগস্ট ২০২৩

‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ...’ সেই ছোটোবেলা থেকেই আমরা এই কবিতাটি পড়েছি। আসলে তালগাছ অনেক লম্বা হয়। তাই অনেক দূর থেকেই চিহ্নিত করা যায়। এজন্যই হয়তো কবি এভাবে লিখেছিলেন।

বন্ধুরা তোমরা কখনো তালগাছ দেখেছো? হয়তো কেউ কেউ দেখেছো, আবার কেউ দেখনি। একসময় গ্রামে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে সারি সারি তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকত। তালগাছ খুবই পরিবেশবান্ধব একটি গাছ। কিন্তু, আধুনিকায়নের নিষ্ঠুরতায় তালগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর তালগাছে বাবুই পাখির বাসার সেই সৌন্দর্য খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ একসময় তালগাছের পাতায় বাবুই পাখিরা বাসা বুনত। কী সুন্দর লাগত সেই দৃশ্য! আর সারাদিন বাবুই পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যেত। সে খুবই অপরূপ ছিল।

তালগাছ হচ্ছে পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ। এই গাছ উচ্চতায় ৩০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং জীবনকাল হয় প্রায় ১০০-১৫০ বছর। তালগাছের প্রায় সবকিছুই ব্যবহারের যোগ্য। তালের রস, ফলের ব্যবহার খুবই পরিচিত। তাল দিয়ে পিঠা বানানো হয়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তালের রস, ফল, বীজের শাঁস বাঙালির প্রিয় খাবার। আবার তাল গাছের ডাল দিয়ে হাতপাখা বানানো হয়। একসময় তীব্র গরমে গ্রামের মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই হাতপাখা।

তাল নিয়ে লিখতে গেলে অবশ্যই তালশাঁসের কথা বলতেই হবে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে কাঁচা তাল ফলের শাঁস মানুষের প্রিয় খাবার। এসময় শহরের মোড়ে মোড়ে এই তালশাঁস বিক্রি হয়। আর ভাদ্র মাসে তালগাছের তলায় গেলেই পাকা তালের সুবাসে মন জুড়িয়ে আসে। কখনো কখনো ঝুপঝাপ করে গাছতলায় তাল ঝরে পড়ে। তবে, মাথায় পড়লে কিন্তু বিপদ। তাই ভুল করে ভাদ্র মাসে তালগাছ তলায় যাওয়া ঠিক হবে না। যখন তাল পাকতে শুরু করে তখন গাছতলায় মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে।

পাকা তাল সংগ্রহ করে আঁটি থেকে হলুদ রস বের করেন গ্রামের গৃহিণীরা। সেই রস দুধ ও কোরানো নারকেল দিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। গ্রামের মানুষ পান্তা ভাত দিয়ে জ¦ালানো তাল মাখিয়ে খান। যদিও এখন এই দৃশ্য খুব বেশি চোখে পড়ে না। আবার কেউ কেউ জ্বালানো তালের সঙ্গে চিঁড়া-মুড়ি মাখিয়ে খান। ভাদ্র মাসের শুরুর দিকে গ্রামের বাড়িতে তালের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। শুধু তালের ভাজা পিঠাই নয়, তালের রুটি, তালের চুসি, তালের বড়া ও তালসত্ত্বসহ বাহারি পিঠা বানানো হয়! সেইসব পিঠা আবার আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠান গ্রামের মানুষ।

মূলত তাল পাকে ভাদ্র মাসে। এজন্য বলা হয় ভাদ্র মাসের ‘তালপাকা’ গরম। গ্রামের মুরব্বিরা বলেন ভাদ্র মাসের গরমে তাল পাকে। তাই আমরা ধরে নিতে পারি ভাদ্র মাসের সঙ্গে তালের একটি সম্পর্ক আছে। শুধু ভাদ্র মাস বলা ঠিক হবে না, বলতে হবে ভাদ্র মাসের গরমের সঙ্গে তালের সম্পর্ক আছে। ভাদ্রের গরমেই মূলত তাল পাকে। এ সময় প্রতিটি ছোটো-বড়ো বাজারেই পাকা তাল পাওয়া যায়। পাকা তালে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়ামসহ আরও অনেক খনিজ উপাদান। এর সঙ্গে আরও আছে অ্যান্টি-অক্সিজেন ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান।

সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস তাল খেতে দেখা যায় না। কারণ, এ সময় তাল বড়ো হতে থাকে। বর্ষা শেষ হয়ে শরতের প্রথমে তাল পাকতে শুরু করে, কারণ তখন ভাদ্রের প্রচণ্ড গরম থাকে। মূল তাল খাওয়া শুরু এ সময়েই। পাকা তাল গাছ থেকে খসে পড়ে। গ্রামের মানুষ কিন্তু ভোরে উঠে তালগাছ তলা থেকে তাল কুড়িয়ে আনে। তাল কাড়াকাড়িতো এক সময় গ্রামে শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ঘটনা ছিল। কিন্তু, এখন এসব হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের রঙিন দিনগুলো।

পাকা তালের প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যযোগ্য অংশে থাকে খাদ্যশক্তি ৮৭ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৭৭.৫ গ্রাম, আমিষ .৮ গ্রাম, চর্বি .১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন .০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন .০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন .৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন সি ৫ মিলিগ্রাম।

পাকা তাল খাওয়ার নানা উপায় আছে। তবে পাকা তালের রসের সঙ্গে নারকেল, দুধ, চিনি, কলা ইত্যাদি মিশিয়ে আরও নানা স্বাদের খাবার তৈরি হয়। এর মধ্যে আছে তালসত্ত্ব। তালের রস ও চিনি দিয়ে বানানো হয় তালসত্ত্ব। এটি রোদে শুকিয়ে সারা বছর খাওয়া যায়। অনেকে ভাত ও দুধের সঙ্গে এই তালসত্ত্ব খেয়ে থাকেন। আরও আছে তালের জুস। তালের রস, দুধ, চিনি দিয়ে জুস বানানো যায়। তাল যেহেতু ভাদ্র মাসে পাকে, সেই সময়ের গরমে এই জুস খাওয়ার প্রচলন আছে। আরও বানানো যায় তালের বড়া। তালের ঘন নির্যাসের সঙ্গে ডিম, চালের গুঁড়া, গুড় বা চিনি এবং কখনো নারিকেল দিয়ে তালের পিঠা তৈরি করা হয়। গ্রামগঞ্জে এই পিঠার ঐতিহ্য আছে। তালের বড়ার সুন্দর সুবাস রয়েছে। অনেকে আবার তালের কেক বানান। কেকের সব উপকরণের সঙ্গে তালের রস মিশিয়ে কেক বানানো হয়। এর রং খুবই আকর্ষণীয় হয়। তালের কেকের মধ্যে চিনি কম এবং ডিমের সাদা অংশ ব্যবহার করলে ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগীদের জন্য ভালো খাবার হতে পারে।

পাকা তালের নানারকম উপকারিতা আছে। তাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এ ছাড়া স্বাস্থ্য রক্ষায়ও তাল ভূমিকা রাখে। স্মৃতিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাল ভিটামিন বি-এর উৎস তাই ভিটামিন বি-এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে তাল ভূমিকা রাখে। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে, যা দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো করতে তাল ভালো ভূমিকা রাখে।

বন্ধুরা তাল নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। কিন্তু, দুঃখের কথা হলো দিন দিন এই তালগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর গ্রামে গেলেও খুব বেশি তালগাছ চোখে পড়ে না। অথচ এই তালগাছ পরিবেশের খুব ভালো বন্ধু। তালগাছ বুক পেতে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে পরিবেশকে ও আমাদের রক্ষা করে। সরকারিভাবেও এখন বাড়ির আনাচে কানাচে তালগাছ লাগাতে বলা হয়। কেন জানো? কারণ তালগাছ বজ্রপাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। তাহলে ভেবে দেখ তালগাছ মহান আল্লাহর কত বড়ো নেয়ামত। অথচ আমরা তালগাছ ধ্বংস করে আল্লাহর নেয়ামতকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ সবকিছুই আমাদের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাই আমরা যত এসব নেয়ামত ধ্বংস করব, ততই পরিবেশ ধ্বংস হবে। আর আমাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই এসো আমরা বেশি করে গাছ লাগাই আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, ‘হে আল্লাহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের হেফাজত করুন।’

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ