তাদের ঈদ -মোহাম্মদ মিরাজুল হক

তাদের ঈদ -মোহাম্মদ মিরাজুল হক

তোমাদের গল্প মে ২০২০

গ্রামের ছেলে রমিজ। জীবিকার জন্য বছর খানেক আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে পিয়নের চাকরি নেয়। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী সুরমা আর একমাত্র মেয়ে ময়না গ্রামে থাকে। রমিজ মাসে মাসে টাকা পাঠায়। ৪-৫ মাস আগে একবার তিন দিন ছুটি নিয়ে গ্রামে ঘুরে এসেছে। সারা দিন অফিসের কাজের চাপে দম ফেলানোর উপায় নেই। রাতে যখন মেসে আসে, একে একে মনে পড়ে মা, বউ আর মেয়ের কথা। ছোট্ট মেয়ে ময়না ইদানীং মোবাইলে কথা বলতে শিখেছে। চাচাতো ভাই লোকমানের মোবাইলে ফোন দিয়ে মাঝে মাঝে পরিবারের সাথে কথা বলে রমিজ। ময়না একবার ফোন ধরলে আর কিছুতেই ছাড়তে চায় না। কত কিছু যে বলতে চায়! কাজের চাপে সব সময় কথাও বলতে পারে না। রাতে যখন ফ্রি হয়, ততক্ষণে গ্রামে অনেক রাত।
কাজ করতে করতে রোজা শুরু হয়। বস অফিসে না থাকলে সবাই শুরু করে গল্প। কে কী কিনল? নতুন কোন ড্রেস এলো? কোন ভাবী কত দামের শাড়ি কিনলো এই সব। দেখতে দেখতে ২০ রোজা চলে গেল। একদিন বাড়িতে ফোন করলো রমিজ। ময়না ফোন ধরে শুরু করে তার বায়না। ঈদে তার পরী ড্রেস চাই। নতুন স্যান্ডেল, লিপস্টিক, নেইল পলিশ এসব তো লাগবেই। তার ওপর কিছুদিন আগে জ্বরের পর সে যখন ডাল ভাত খেতে না চায়। মা তখন বলে দশ দিন পরেই তো ঈদ। ঈদে কত ভালো ভালো খাবার খাবে। সেমাই, মাংস-পোলাও কত কী?
ঈদের আর মাত্র তিন দিন বাকি। সবার বেতন হয়ে গেছে। যারা ঢাকার বাইরে ঈদ করবে তাদের কেউ কেউ টিকেটের তারিখ অনুযায়ী চলে গেছে। শুধু রয়ে গেছে যারা ঢাকায় ঈদ করবে তারা। রমিজের বেতন এখনো হয়নি। ফলে কেনাকাটা কিছুই করা হয়নি। ময়না ফোন করে করে তাড়া দেয়। কখন আসবা বাবা? সবার তো জামা কেনা হয়ে গেছে।
রমিজ ভয়ে ভয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ায়। আমতা আমতা করে বেতনের কথা বলে। স্যার ২৯ রোজার দিন বেতন আর ছুটি দিতে রাজি হয়। স্যারের চিন্তা বেতন আগে দিলে রমিজ চলে যেতে পারে। তাহলে অফিসে সমস্যা হবে।
২৯ রোজায় হাতে বেতন পেয়ে রমিজ ছোটে নিউমার্কেট। কোনভাবেই তার বাজেটে মার্কেটে পরী জামা পাওয়া যায় না। অনেক ঘুরে মেয়ের একটু হাসি মুখের জন্য ফুটপাথ থেকে কিনে নেয়। মেয়ের অন্যান্য বায়নার জিনিসপত্র কিনে ফেলে তাড়াতাড়ি। নিজের জন্য কিছু না কিনলেও মা আর বউয়ের জন্য কিছু না কিনে পারে না। যত কষ্টই হোক সে এখন শহরে চাকরি করে। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে মানসম্মান বজায় রাখতে হবে না!
সব কেনাকাটা করতে করতে বেলা প্রায় শেষ। জ্যাম ঠেলে এবার গাবতলী পৌঁছতে হবে। গাবতলীতে টিকেটের দাম অগ্নিমূল্য। সব বাসের আগাম টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। দুই একটা যা সিট বাকি আছে তার দাম তিন-চার গুণ।
বাসস্ট্যান্ডের বাইরে একটু মোটামুটি ফাঁকাজায়গায় এসে দাঁড়ায় রমিজ। পকেট হাতড়ে দেখে টাকা আছে মোটে ১৫০০। এবার সে মনে মনে হিসাব কষে। ঈদের দিন সেমাই, সুজি কিনতে হবে। মাংস কিনতেই চলে যাবে ৫০০-৭০০ টাকা। তার ওপর ফিরে আসার সময় ভাড়ার জন্য হাত পাতবে কার কাছে?
এই সময় তার সাথে দেখা হয় গ্রামের এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে। সেও ঈদ করার জন্য বাড়ি যাচ্ছে। রমিজ তার কাছে জামা কাপড় আর টাকা পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে বলে অফিসে কাজের চাপে ছুটি মেলেনি।
এবার মেয়েকে ফোন দিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে বলে। মেয়ে প্রথমে মন খারাপ করলেও জামা কাপড় পাঠানোর কথা শুনে খুশি হয়। রমিজ মেসে ফিরে আসে। বাকি সবাই চলে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি গোসল করে রমিজ। রাতে বালিশের নিচে ভাঁজ করে রাখা পুরনো জামা পরে ঈদের নামাজ পড়তে যায়। ঈদে নতুন জামা নেই বলে তার মনে কোন দুঃখ নেই। কারণ তার পাঠানো জামা কাপড় পরে প্রতিবেশী ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলে বেড়াচ্ছে ময়না। ফিরে এসে আগের রাতে পানি দিয়ে রাখা পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে খেতে বসে। সারা মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিন এই খাবার খেতেও তার ভালো লাগছে। কারণ মা, বউ আর মেয়ের মুখেতো তুলে দেয়া গেছে ঈদের খাবার।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ