ঝরা পাতার গল্প  -আ’বিরু সাবীল

ঝরা পাতার গল্প -আ’বিরু সাবীল

তোমাদের গল্প ডিসেম্বর ২০১৬

পুকুরপাড়ে ছোট্ট একটি কাঁঠাল গাছ। ছোট্ট হলেও বেশ নাদুসনুদুস। সুস্থ সবল। অন্য গাছগুলোর মতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়নি। গাছটিতে অজস্র পাতা। সবগুলোই সবুজ শুধু একটি ছাড়া। এই পাতাটির রঙ একটু ভিন্ন। কেমন জানি ধূসর। তার ধূসর রঙই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার ভিন্নতাই আমাকে কাছে টানে। তার ধূসর বর্ণে যেন তার জীবনের ধূসর মুহূর্তগুলো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।
তার রঙের মতো তার চরিত্রও ভিন্ন। সকালের সোনালি রোদে শিশিরভেজা পাতাগুলো যখন আনন্দে চিকচিক করে তখন এই পাতাটি তার বিষণœ মুখটি লুকিয়ে রাখে। গোধূলি বেলায় রক্তিম আকাশের আভায় যখন অন্য পাতাগুলোর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন এই পাতাটি তার মলিন চেহারা আড়াল করে রাখে।
মৃদু বাতাসের ঝাপটায় যখন অন্য পাতাগুলো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তখন এই পাতাটি গোমড়ামুখো হয়ে বসে থাকে। রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে অন্য পাতাগুলো যখন সজীবতায় ভেসে বেড়ায় তখন এই পাতাটির চোখের পানিতে বৃষ্টির স্বচ্ছ পানিও লোনা হয়ে যায়। অজস্র পাতার ভিড়েও যেন সে একা। অসংখ্য পশু-পাখির কোলাহলেও যেন সে নীরব নিস্তব্ধ।
পাতাটির চরিত্র আমার খুব ভালো লাগে। তাকে আমার খুব আপন মনে হয়। তার মধ্যে আমি নিজেকে দেখতে পাই। প্রতিদিনই তাকে দেখি, সেও আমায় দেখে। কখনো চোখে চোখে কথা বলি, কখনো হৃদয়ে হৃদয়ে বাক্য বিনিময় করি। কখনো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি, কখনো অন্তর দিয়ে স্পর্শ করি। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আমরা দু’জনে জেগে থাকি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসি। কান্নার চেয়েও করুণ সেই হাসি। কখনো আমি তাকে সান্ত¡না দেই, কখনো সে আমাকে। এভাবেই চলছিল আমাদের বন্ধুত্বের খেলা।
আমার আন্তরিকতার ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে সে কিছুটা সজীব হয়ে ওঠে। আমার বন্ধুত্বের স্পর্শে ধীরে ধীরে সে কিছুটা সবুজ হয়ে ওঠে। তার অবস্থার উন্নতি দেখে আমি খুশিতে বাগবাগ হয়ে যাই। তার সজীবতা দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। হায়! আমি যদি জানতাম এই সুখ-সজীবতাই একদিন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!
একদিন হঠাৎ সোনালি রোদ, রক্তিম আকাশ, রিমঝিম বৃষ্টি আর মৃদুমন্দ বাতাস সব একযোগে তার জীবনে চলে এলো। সুখের সব উপকরণ একসাথে পেয়ে তার সবুজ-সজীব দেহে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। আনন্দের আতিশয্যে সেও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। কিন্তু সে যে এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়ে ওঠেনি, তার শরীরে সজীবতা এলেও মনটা এখনো পুরোপুরি সজীব হয়ে ওঠেনি সেদিকে তার খেয়াল ছিল না। তার অসুস্থ শরীর আর দুর্বল মন এত আনন্দ সইতে পারেনি। খিলখিল করে হেসে উঠতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। সে নিঃশব্দে বোঁটা থেকে খসে পড়ল।
তার চলে যাওয়ার শোকে আমি কাতর হলাম না, বরং পাথর হয়ে গেলাম। শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় তার শূন্যতা টের পেলাম। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার অনুপস্থিতি অনুভব করলাম। তার হৃদস্পন্দনহীন দেহটি গাছের নিচে পড়ে রইল কিন্তু তার জীবন্ত স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে রইলো। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরল আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো। আমি আর তার দিকে তাকালাম না, তাকাতে পারলাম না।
এখন আমার জীবনে কত সুখের মুহূর্ত আসে। সোনালি রোদ, রিমঝিম বৃষ্টি, মৃদু বাতাস আর রক্তিম আকাশ। কখনো পালাক্রমে আসে কখনো বা একযোগে। কিন্তু আমি হাসি না। খিলখিল করে হেসে উঠি না। ভয় হয়, যদি আমিও ঐ ঝরা পাতার মতো এত সুখ সইতে না পারি! যদি আমিও বোঁটা থেকে খসে পড়ি!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ