জীবন্ত রঙধনু

জীবন্ত রঙধনু

ফিচার জুলাই ২০১৩

মাহমুদ হাসান রঙধনুর সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। মেঘলা দিনে আকাশজুড়ে আঁকা রঙধনু কার না মুগ্ধ দৃষ্টি কেড়েছে! না বন্ধুরা, রঙধনু নিয়ে আজ বেশি বকবক করবো না। তবে মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এসো এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জেনে নেয়া যাক। আমরা অনেকেই জেনেছি যে রঙধনুর সাতটি রঙ যাকে সংক্ষিপ্ত করে মনে রেখেছি বেনীআসহকলা। ‘বেনীআসহকলা’ মানে বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। রঙধনুর এই সাত রঙ বলেই আমরা জানি। তবে ১৭ শতক পর্যন্ত কারও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না রঙধনুর আসলে রঙ কয়টি? রঙধনু বা রামধনু : রঙধনু সাধারণত বৃষ্টির পর আকাশে সূর্যের বিপরীত দিকে দেখা যায়। সাতটি রঙের সমাহারÑ দেখতে ধনুকের মতো বাঁকা হওয়ায় নাম রঙধনু। একে রামধনুও বলা হয়। ইংরেজিতে বলে রেইনবো। গ্রিক মহাকবি হোমার বলেছেন, রঙধনুতে মাত্র একটি রঙ। আর তা হচ্ছে ‘রক্তবর্ণা’। তবে হোমারের সমসাময়িক আরেক দার্শনিক কবি জেনোফেন বলেন, রঙধনুতে রঙ তিনটিÑ হলুদ, সবুজ ও লাল। তাকে সমর্থন জানান অ্যারিস্টটল। মেটেরোলজিকা গ্রন্থে তিনি বলেন, রঙধনুতে ওই তিনটি রঙই রয়েছে। তার এ মত থেকে রেনেসাঁ-যুগ পর্যন্ত সবাই মেনে নিয়েছিল, রঙধনুতে চারটি রঙÑ লাল, নীল, সবুজ ও হলুদ। এদিকে আইজ্যাক নিউটন এসে জানিয়ে দিলেন, রঙধনুতে রঙ পাঁচটিÑ লাল, হলুদ, সবুজ, নীল ও রক্তবর্ণ। এখনও চীনের অনেক মানুষ মনে করে রঙধনুতে রঙ পাঁচটিই। বাল্টিক দেশগুলোর (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া ও ফিনল্যান্ড) লোকেরা বিশ্বাস করে, রঙধনুতে উল্লেখযোগ্য রঙ দুটিÑ লাল ও নীল। সাত রঙ : বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৬ সালের দিকে প্রথম জানান, রঙধনুতে পাঁচটি রঙÑ লাল, হলুদ, সবুজ, নীল ও রক্তবর্ণ। তবে পরে তিনি বলেন, রঙধনুর রঙ সাতটিÑ লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, আকাশি ও বেগুনি। প্রথমে পাঁচটি বললেও পরে বাকি দুটি রঙ যোগ করেন বিশ্বজগতে সাতের মিল থেকে। যেমনÑ গানে সাতটি সুর, সাতদিনে এক সপ্তাহ, সৌরজগতে সাতটি গ্রহ জানা ছিল তখন। রঙধনু কেন : রঙধনু সৃষ্টি হয় আসলে পানির ফোঁটায় আলো পড়ে। আকাশের একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ অল্প মাত্রায়। এ অবস্থায় রঙধনুর জন্ম হয়। বিজ্ঞানী ও দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেন, বৃষ্টির কণা বা জলীয় বাষ্প-মিশ্রিত বাতাসের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো যাওয়ার সময় আলোর প্রতিসরণের কারণে বর্ণালির সৃষ্টি হয়। এই বর্ণালিতে আলো সাতটি রঙে ভাগ হয়ে যায়। তখনই আমরা রঙধনু দেখি। রঙধনু সূর্যের চেয়ে ৪২ ডিগ্রি বিপরীতে সৃষ্টি হয়। রঙধনুর রকমভেদ : রঙধনু হতে পারে নানা রকমের। পুরোপুরি রঙধনু মানে সাত রঙ মিলেও হতে পারে। আবার অল্প কয়েকটি রঙের রঙধনুও হতে পারে। রেইনবো প্রধানত প্রাইমারি, ডাবল এবং ট্রিপলÑ এই তিন ধরনের হতে পারে। প্রাইমারি রঙধনুতে লাল ও বেগুনি রঙ দেখা যায়। পানির ফোঁটার মধ্যে সূর্যের আলো একবার পড়ে। আর ডাবল রেইনবো সৃষ্টি হয় তখন, যখন প্রাথমিক রঙধনুর ওপরে ও বাইরের অংশে রঙধনুর সৃষ্টি হয়। ডাবল রেইনবো দেখার কারণ হলো- পানির ফোঁটার ওপর দু’বার সূর্যের আলো পড়ে। আর ট্রিপল রেইনবো সৃষ্টি হয় আলো পানির ফোঁটার ওপর তিনবার প্রতিফলিত হলে। আরেক ধরনের রঙধনু আছে, যাকে একরঙা রঙধনুও বলা হয়। সূর্য ওঠার বা অস্ত যাওয়ার সময় এই রঙধনু সৃষ্টি হয়। এখানে থাকে নীল বা সবুজ রঙ। তবে এ ধরনের রঙধনু খুবই কম দেখা যায়। রঙধনুর ধনু : সূর্যের যে কোণ থেকে পানির ফোঁটার মধ্যে আলো অবস্থান করে, সেটি হলো ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি। সাতটি রঙে আলোর ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে কারণে এদের বেঁকে যাওয়ার পরিমাণে তারতম্য দেখা যায়। যেমন লাল রঙের আলোকরশ্মি ৪২ ডিগ্রি কোণে বাঁকা হয়ে যায়। অন্যদিকে বেগুনি রঙের আলোকরশ্মি ৪০ ডিগ্রি কোণে এবং অন্যান্য রঙের আলোকরশ্মি ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির মধ্যকার বিভিন্ন কোণে বাঁকা হয়। এ কারণে রঙধনুর রঙগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সারিতে ধনুকের মতো দেখা যায়। রঙধনু নিয়ে তো অনেক হলো, এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। এক পশলা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পর ঝলকানো রোদ উঁকি দিলে আকাশে দেখা যায় ধনুকের মতো সাতরঙা এক সেতু। রঙধনুর সেই সাত রঙ কিন্তু প্রকৃতির মধ্যেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর তা বিভিন্ন প্রাণীর গায়ে। এদেরকে আমরা ‘জীবন্ত রঙধনু’ নাম দিতে পারি, কী বলো? এমনই কয়েকটি জীবন্ত রঙধনুর সাথে আজ আমরা পরিচিত হবো। স্কারলেট ম্যাকো এমন এক ‘রংধনু প্রাণী’ স্কারলেট ম্যাকো। ম্যাকো তোতার জাতভাই। এই ম্যাকোরই রয়েছে ১৭টি প্রজাতি। এর একটি হচ্ছে ‘স্কারলেট ম্যাকো’। ওদের গোটা শরীর নানা রঙে রঙিন। বৃষ্টিবনে থাকতে পছন্দ করে স্কারলেট ম্যাকো। ওড়ায় খুব পটু ওরা। ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। মজবুত ঠোঁট দিয়ে ওরা শক্ত খোসার ফল ভেঙে খেতে পারে। শিকারির খপ্পরে না পড়লে একটি স্কারলেট ম্যাকো ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। বুলহেড প্যারটফিশ আরেক ‘রংধনু প্রাণী’ বুলহেড প্যারটফিশ। সামুদ্রিক এই মাছটি লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটারের মতো হয়ে থাকে। ওদের পুরো শরীরে রয়েছে রঙের বাহার। মাথার আদল বুলেটের মাথার মতো বলে নাম হয়েছে ‘বুলেটহেড’। এ পর্যন্ত ৯০ প্রজাতির প্যারটফিশের সন্ধান পাওয়া গেছে। মাছগুলো হাঁ মেলে যখন দাঁত বের করে, মুখের মধ্যে তোতাপাখির ঠোঁটের আদল ফোটে। এ জন্য ওরা প্যারটফিশ বলে পরিচিত। বুলেটহেড প্যারটফিশ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবাল প্রাচীরের অগভীর পানিতে বাস করে। দিনের বেলায় ওরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। প্রবালের পাথর চিবোনোর মতো শক্ত দাঁত রয়েছে ওদের। এসব পাথর পিষে নির্যাস খেয়ে বাকি অংশ ওরা বালুকণা আকারে বের করে দেয়। এসব বালুকণা দ্বীপ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। একটি প্যারটফিশ এক বছরে ৯০ কেজি পর্যন্ত বালুকণা বের করে থাকে। ওরা আমাদের আয়োডিনের উৎস সামুদ্রিক শৈবাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাতে প্রবাল প্রাচীরের ফাটলে পড়ে থাকে প্যারটফিশ। এ সময় শিকারিরা যাতে ওদের গন্ধ না পায়, এ জন্য স্বচ্ছ জেলির মতো এক ধরনের আবরণ দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে রাখে। লালচোখ গেছোব্যাঙ রঙধনুর ছিটেফোঁটা রয়েছে ‘লালচোখ’ গেছোব্যাঙের গায়েও। সুন্দর এই সবুজ ব্যাঙের চোখ আর পাতা টকটকে লাল। আত্মরক্ষায় বেশ কাজ দেয় এই রঙ। যখন এই ব্যাঙটি বিশ্রাম নেয়া অবস্থায় থাকে। তখন এটি চোখ বুজে রাখে। গুটিয়ে রাখে পায়ের পাতা। এতে লাল রঙ ঢাকা পড়ে যায়। এ সময় সবুজ পাতার মধ্যে ওদের অস্তিত্ব টের পাওয়া দায়। এর পরও যদি অপ্রিয় কারও আগমন ঘটে, অমনি এই গেছোব্যাঙটি চোখ মেলে তাকায়। পায়ের পাতা মেলে ধরে। তখন এই লাল রঙ দেখে ঘাবড়ে যায় অনাহূতেরা। ভাবেÑ বাপ রে, এটা আবার কী! এই তাক লাগানো ঘোরের মধ্যে পগার পায় হয় লালচোখ গেছোব্যাঙ। সিংহকেশর জেলিফিশ সাগরতলে বিচরণকারী ‘সিংহকেশর জেলিফিশ’ বলে পরিচিত এক ধরনের জেলিফিশের মধ্যেও রয়েছে রঙধনুর বর্ণালি ছটা। পিকক ম্যান্টিস শ্রিম্প আর ‘পিকক ম্যান্টিস শ্রিম্প’ বলে পরিচিত সামুদ্রিক চিংড়ি তো রঙের বাহারে আরেক কাঠি ওপরে। ওদের ডিমও রক্তরাঙা লাল!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ