জীবনের নতুন বাঁক

জীবনের নতুন বাঁক

গল্প নূরুল ইসলাম ডিসেম্বর ২০২৩

এখন ডিসেম্বর মাস। ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ। হাতে প্রচুর অবসর সময়। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে মুখে হাত দিয়ে গভীর চিন্তার রেখাপাত হচ্ছে আবিরের মাথায়। আজ খুব ভোরেই সে ঘুম থেকে উঠেছে। ফ্রেস হয়ে ফজরের সালাতও আদায় করেছে। প্রতিদিনের মতো আজ আর মা-বাবার সেই চির চেনা শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে না, আবির দ্রুত ওঠো, ফ্রেস হয়ে নাও, নামাজ আদায় করে কুরআন তিলাওয়াত করো, বই নিয়ে পড়তে বসো, কিছুদিন পর পরীক্ষা, স্কুলে যেতে হবে, প্রাইভট টিচার এখনই আসবে পড়া শেষ করো, কিছুদিন পর পরীক্ষা এখন আর খেলাধুলা চলবে না, মোবাইল আর টিভির কাছে যাওয়া চলবে না, সময়মতো গোসল করো, নাস্তা করো, অঙ্ক করো, বাংলা পড়ো, ইংরেজিতে নজর দাও, ঘোরাফেরা এখন বন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো কথা প্রতিদিন শুনতে হয়। গতকাল থেকে এত এত কথা সব যেন বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ রিল্যাক্স মনে হচ্ছে।

আবির এখন ক্লাস সেভেনে। সে যথেষ্ট ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। এক দুইদিন অবসর থেকে তার আর সময় যেন কিছুতেই কাটছে না। খেলাধুলা আর মোবাইল নিয়ে সময় কাটাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কি যেন এক শূন্যতা তাকে টেনে বেড়াচ্ছে। আজ হঠাৎই সে ভাবছে মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে আর কেনইবা চলে যেতে হয়! সময় গড়ালে তো মানুষ আস্তে আস্তে পূর্ণ বয়সের দিকে যেতে থাকে। আর এই মানুষই একটা সময় লেখাপড়ার পাঠ চুকে চাকরি জীবনে প্রবেশ করে। এরপর নিজের একটা সংসার হয়। আর আরো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সে একটা সময় বার্ধক্যে পরিণত হয়। সময় পেরিয়ে গেলে সে মৃত্যুবরণ করে। তাহলে এই মানুষের জীবনের মূল্য আসলে কী?

গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে আবির। সে আরো ভাবছে, পৃথিবীর এই অল্প সময়টিকে কিভাবে সে কাজে লাগাবে? সকাল সন্ধ্যা শুধু গেমস খেলবে, নাকি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারবে, নাকি ঘরে বসে আর ঘুমিয়ে সময় কাটাবে?

কোন কুল কিনারা সে পাচ্ছে না। কিন্তু চিন্তা করেই যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হলো, বাবার কাছে সবকিছু বলি। একটা উপায় মিলবে। বাবা তার বন্ধুর মতো। মা একটু একটু বকা দিলেও বাবার কাছে সে শতভাগ আদর, ভালোবাসা, উপদেশ সবকিছুই পায়। যাইহোক, তার এখন অবসর সময় চলছে কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারছে না আবার সারাদিন ঘরে থাকতেও তার ভালো লাগছে না। কিছুসময় মোবাইল টিপছে আবার বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলছে। অন্য দশটা ছেলে যা করে আবিরও তাই করছে। অথচ ছোট বেলা থেকেই তার বাবা এবং শিক্ষকরা বলেছেন, তোমাকে অনেক বড় কিছু হতে হবে। তাহলে সে কিভাবে তার সময়কে কাজে লাগাবে? এ কথাগুলো বাবাকে সে খুলে বললো।

অফিস থেকে এসেই বাবা ছেলের যত জমানো কথা মন দিয়ে শুনতে লাগলেন। ছেলের এমন ব্যাকুলতা দেখে বাবার খুবই ভালো লাগলো। আবিরের কথা শেষ হতেই তার বাবা তাকে বলতে শুরু করলেন।

মনে রাখবে আবির, সময় মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামত। রাসূল (সা) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন চারটি প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত বান্দার পা বিন্দু পরিমাণ নড়বে না। তার জীবন সম্পর্কে; সেটা কোন কাজে ব্যয় করেছে। তার যৌবন সম্পর্কে; কিভাবে তা ক্ষয় করেছে। তার সম্পদ সম্পর্কে; কিভাবে আয় করেছে এবং কী কাজে ব্যয় করেছে। তার জ্ঞান সম্পর্কে; সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে।”

আবির হাদিসটি শুনে খুব অবাক হলো। তার বাবাকে সে বলল, তাহলেতো জীবনের প্রতিটি সময়কে মেপে মেপে চলতে হবে। তার বাবা বললেন হ্যাঁ, তবেই তো তোমার জীবন সফল হবে। এ পৃথিবীতে আসার আসল অর্থ তুমি খুঁজে পাবে। শোনো, সময়ের ব্যাপারে হাসান বসরি সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন ঠিক এভাবে-

‘ফজর ভেদ করে আলোতে আসা প্রতিটি দিন ডেকে বলে, “হে আদম সন্তান! আমি এক নতুন সৃষ্টি। আমি তোমার কাজের ব্যাপারে সাক্ষী। আমার কাছ থেকে রসদ সংগ্রহ করো। কারণ, আমি বিদায় নেওয়ার পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কখনোই ফিরে আসব না।” আবির তার বাবার কথা ব্যাকুল হয়ে শুনছে আর মনে মনে কি যেন আবিষ্কার করে চলেছে। হঠাৎ তার বাবাকে সে বলে উঠলো, হ্যাঁ বাবা; রাত-দিন তো চলেই যায়, যা কখনো ফিরে আসে না। ফিরে পাবার আশাও থাকে না। এই যে আমি সময়ের কিছু সমষ্টি মাত্র। সময় চলে আর আমরাও  বেড়ে উঠছি। বাবা বললেন, হ্যাঁ এটাই আমাদের জীবনের বাস্তবতা।

বাবা আরো বললেন, দেখো আবির, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘যখন কারও নির্ধারিত সময় এসে যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে আর অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে খবর রাখেন।’

ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, ‘সাধারণত আমি কোন বিষয়ে আফসোস করতাম না। আমার আফসোস ছিলো একটা জায়গায় আর তা হলো- একটি দিনের সূর্য অস্তে চলে গেল, আমার জন্য নির্ধারিত সময় চলে গেল, কিন্তু আমার কর্মে কিছু যোগ হলো না।’

মনে রাখবে আবির, অবসর সময় একটা গনিমত। আদর্শ আর বিবেকবান মানুষেরা এই গনিমতকে ব্যবহার করে। আর অজ্ঞ মানুষেরাই কেবল তাকে অবহেলা করে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর দু’টো নিয়ামতের সাথে বহু মানুষ ধোঁকাবাজের মতো আচরণ করবে। নিয়ামত দু’টো হলো সুস্থতা ও অবসর।”

পৃথিবীতে যারা ইতিহাস গড়েছে তারা তাদের লক্ষ্য স্থির করে কঠোর পরিশ্রম আর সময়কে কাজে লাগিয়েছে। তাই তারা জীবনে সফল হয়েছে আর মানবতার জন্য কিছু করে গিয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, নাজিমুদ্দিন এরবাকান, আল রাজি, ইবনে বাত্তান, ইবনে খালদুন, হাসানুল বান্না, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, হাসান ইবনে হাইসাম, ওয়ালিদ ইবনে রুশদের কথা শুনেছো। তারা সকলেই খুব ছোট বয়স থেকে নিজেদের তৈরি করেছেন আর সময়কে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে পৃথিবী আজ তাঁদের স্মরণ রাখে। বাবার এ কথাগুলো আবিরের মনে বেশ গভীরভাবে দাগ কাটে। সে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। তার জীবনের শুরু হলো এক নতুন বাঁক। কাগজ কলম নিয়ে সে বসে গেল টেবিলে। তার সময়গুলোকে কিভাবে কাজে লাগাবে সেই চেষ্টায় বিভোর। সে ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা কিভাবে কাটাবে তার ছক কাটতে শুরু করে দিলো।

সে তার সময়গুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলল। প্রথমত, সে কত ঘণ্টা ঘুমাবে, গোসল, খাওয়া, নামাজে কতটুকু সময় ব্যয় করবে, কতটুকু সময় খেলাধুলা করবে তা ঠিক করলো। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীকে জানার জন্য এবং সময়গুলোকে কাজে লাগানোর জন্য এখন তাকে কী কী বই পড়তে হবে তা নির্ধারণ করলো এবং কোন কোন সময় সেটা করবে তাও ঠিক করলো। তৃতীয়ত, বই পড়ে সে যা শিখলো সেগুলো অন্যকে কিভাবে এবং কখন জানাবে তার পরিকল্পনা করলো। আর সর্বশেষ সে ঠিক করলো অষ্টম শ্রেণীতে যে সকল বই পড়ানো হয় রাতের বেলায় সেগুলো ধীরে ধীরে আয়ত্ত করে ফেলবে। তাহলে ক্লাস শুরু হলে সে অন্যদের চেয়ে আরো এগিয়ে থাকবে আর শিক্ষকরাও তাকে অনেক স্নেহ করবেন। এভাবেই চললো অদম্য স্প্রিহা নিয়ে এক আলোক উদ্ভাসিত তারুণ্যের নতুন জীবন আর এ বসুন্ধরা জয়ের নতুন যাত্রা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ